মসজিদের মুয়াজ্জিন আবদুল জলিল (৫৮)। বাড়ি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের চর গোয়াদাহ গ্রামে। তাঁর কোনো সন্তান নেই। মসজিদে থাকেন। চোখে ঝাপসা দেখেন। টাকার অভাবে অস্ত্রোপচার করাতে পারছিলেন না। অনেকেই বলেছেন। একদিন এক প্রতিবেশী তাঁকে নিয়ে যান খায়রুল বাসার খানের কাছে। আবদুল জলিলের চোখে অস্ত্রোপচার হয়। তিনি এখন চোখে ভালো দেখেন।
খায়রুল বাসার খান কোনো চিকিৎসক নন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এ পর্যন্ত ২৬১ জন মানুষের চোখের ছানির অস্ত্রোপচার করিয়েছেন তিনি। নিজের মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, রাষ্ট্রপতি পদক ভাতা (এককালীন পাওয়া ৫০ হাজার টাকা), একমাত্র ছেলে এবং মেয়ের জামাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তিনি দুস্থ মানুষের জন্য এ কাজ করেন। শুরু করেছিলেন ২০১৫ সালে। করে যাবেন বাকি জীবন।
মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল বাসার খানের বাড়ি বালিয়াকান্দি উপজেলার খোদ্দমেগচামী গ্রামে। তিনি আনসার-ভিডিপির একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। ভিডিপি সেবার জন্য রাষ্ট্রপতি পদক পেয়েছিলেন এক ছেলে, এক মেয়ের জনক খায়রুল বাসার। ছেলে ও মেয়ে দুজনই বিবাহিত। স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন তিনি। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর যুক্ত হয়েছেন কৃষিকাজে। এখন চাষাবাদ আর অসহায় মানুষের সেবা করাই তাঁর কাজ।
দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, এখন করছেন মানুষের জন্য। কিন্তু এ নিয়ে বাগাড়ম্বরে গেলেন না খায়রুল বাসার। প্রথম আলোকে শুধু বললেন, ‘এখানে চোখের ছানি অস্ত্রোপচার করতে সাড়ে সাত হাজার টাকার মতো নেয়। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার কাছ থেকে এক মাসের ওষুধসহ চার হাজার টাকা নেয়। তাতে একটু বেশি মানুষের জন্য কাজ করতে পারি।’
খায়রুল বাসার জানান, তিনি নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছেন। রোগীদের অধিকাংশ রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি ও ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার। এ ছাড়া রাজবাড়ীর সদর উপজেলা, পাংশা, কালুখালী; ফরিদপুর সদর, বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা; গোপালগঞ্জ সদর ও মুকসুদপুর উপজেলা; মাগুরা সদর, শ্রীপুর ও মোহাম্মদপুর উপজেলার চোখের ছানি পড়া রোগীরা তাঁর মাধ্যমে অস্ত্রোপচার করিয়েছেন। যশোর থেকেও দুজন এসেছিলেন তাঁর কাছে। তাঁদেরও চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।
বয়স বেড়ে গেলে চোখে রোগ বাসা বাঁধতে শুরু করে। এর মধ্যে ছানি অন্যতম। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষগুলোর চিকিৎসার অভাবে সামান্য এই চিকিৎসা করাতে পারে না। অনেক সময় অনেকে দৃষ্টিও হারিয়ে ফেলে। যেমন রাজবাড়ী সদর উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের মিনু বেগমের স্বামী শারীরিক প্রতিবন্ধী। তাঁদের চার মেয়ে, এক ছেলে। মিনু বেগম চোখে ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছিলেন না। চিকিৎসক দেখাতে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার মালেকা চক্ষু হাসপাতালে যান। তাঁকে চোখের অপারেশন করতে বলা হয়। কিন্তু অপারেশন করানোর মতো টাকা তাঁর নেই।
মিনু বেগম বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে জানতে পারি বাসার খানের কথা। ঠিকানা নিয়ে যোগাযোগ করি। পরে তিনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেন।’ তিনি বলেন, গরিব মানুষ। পরের বাড়িতে কাজ করতে হয়। চোখের চিকিৎসা না করতে পারলে কাজকর্ম করাই বন্ধ হয়ে যেত।
এমন আরেক রোগী ওমর আলী শেখ (৬০)। তিনি কালুখালী উপজেলার মৃগী ইউনিয়নের চরঘেটি গ্রামের বাসিন্দা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে তালের পাখা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতাম। এখন আর ওই ব্যবসা নেই। মাঠে কাজ করে সংসার চালাতে হয়। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছেলের আলাদা সংসার। চোখে কম দেখি। চিকিৎসক দেখিয়ে জানতে পারি চোখে ছানি পড়েছে। পরে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে খায়রুল বাসারের খবর পাই। তিনি চোখের অপারেশন করিয়ে দিয়েছেন।’
খায়রুল বাসার খান বলেন, ‘টাকা দিলে খরচ করে ফেলবে, কাপড় দিলে কিছুদিন পরে ছিঁড়ে যাবে। কিন্তু চোখ মানুষের অমূল্য সম্পদ। চোখের মাধ্যমে মানুষ এই সুন্দর পৃথিবী দেখতে পায়। চোখে দেখতে না পেয়ে বেঁচে থাকা অত্যন্ত কষ্টের। এ কারণেই অসহায় মানুষের চোখের ছানি দূর করার এই কাজটি করছি। যত দিন পারি করে যাব।’