দেশে প্রতিদিন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে রোগী মারা যাচ্ছে। কিন্তু সব মৃত্যু অনিবার্য নয়, কিছু মৃত্যু প্রতিরোধ ও ঠেকানো সম্ভব। জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের অনুমিত হিসাব বলছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে নিম্নমানের স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ব্যবহার না হওয়া এবং প্রতিরোধযোগ্য রোগে তিন লাখের কিছু বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সেবার মান উন্নত হলে এই মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হতো।
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ৬১টি দেশের মৃত্যু নিয়ে এই তথ্য প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট। দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ কমিশন অন হাই কোয়ালিটি হেলথ সিস্টেমস নামের একটি কমিশন দুই বছর ধরে কাজ করে এ তথ্য দিয়েছে। ৩০ জন গবেষক, নীতিনির্ধারক ও স্বাস্থ্য পদ্ধতি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত এই কমিশনকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। কমিশনের মূল প্রতিবেদনসহ একাধিক নিবন্ধ ৫ সেপ্টেম্বর ল্যানসেট প্রকাশ করেছে। বৈশ্বিকভাবে এমন মৃত্যুর তথ্য এই প্রথম প্রকাশিত হলো।
কমিশন বলছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে স্বাস্থ্য খাতে অনেক উন্নতি হয়েছে। নতুন চ্যালেঞ্জও দেখা দিয়েছে। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে নিম্নমানের স্বাস্থ্যসেবার কারণে। এ ছাড়া সেবা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ব্যবহার না হওয়ার কারণে ৩৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বিশ্বে এইচআইভি/এইডসে প্রতিবছর যত মানুষ মারা যাচ্ছে, তার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে নিম্নমানের স্বাস্থ্যসেবার কারণে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার মাধ্যমে সবাইকে মানসম্পন্ন সেবার আওতায় আনতে বৈশ্বিক প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে।
তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের সময় কমিশন যক্ষ্মা, এইচআইভি/এইডস ও টিকায় প্রতিরোধ সম্ভব এমন নয়টি রোগ, নিরক্ষীয় অঞ্চলের গুরুত্ব হারানো ১০টি রোগ, ছয়টি সংক্রামক ব্যাধি, নবজাতকের জটিলতা, সাত ধরনের হৃদ্রোগ ও স্নায়ুরোগ, পাঁচটি আন্ত্রিক রোগ, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, ১০ ধরনের ক্যানসার, অ্যাজমা ও দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ, চার ধরনের মানসিক রোগ, সড়ক দুর্ঘটনা, বিষক্রিয়া ও চিকিৎসার বিরূপ প্রতিক্রিয়া—এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়। রোগের প্রকোপ ও মৃত্যুহারের পরিসংখ্যান নেওয়া হয়েছে বৈশ্বিক উদ্যোগ গ্লোবাল ডিজিজ বার্ডেন থেকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য জরিপ, বিভিন্ন দেশের জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ, ইউনিসেফ, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ থেকে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ব্যবহারের তথ্য নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে মৃত্যু
জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৩২ লাখ শিশু জন্মগ্রহণ করে। আর নবজাতক থেকে বৃদ্ধ বয়সী ৮ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
ল্যানসেট কমিশনের হিসাবে, বাংলাদেশে ২০১৬ সালে এড়ানো বা ঠেকানো যেত এমন ৩ লাখ ৪৫৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এর মধ্যে মানুষকে টিকা, খাদ্যাভ্যাস, স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন করা সম্ভব হলে ১ লাখ ১৭ হাজার ৫৪৭টি মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব হতো। ১ লাখ ৮২ হাজার ৯০৬টি মৃত্যুর সঙ্গে সেবার মান ও প্রতিষ্ঠান ব্যবহারের সম্পর্ক ছিল। যেমন নিম্নমানের সেবার কারণে ৯১ হাজার ৬৩১ জনের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে হৃদ্রোগ ও স্নায়ুরোগ, টিকায় প্রতিরোধযোগ্য রোগ, নবজাতকের জটিলতা, মাতৃস্বাস্থ্য, সড়ক দুর্ঘটনা, যক্ষ্মাসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে নিম্নমানের সেবা বেশি দেখা যায়। আর প্রতিষ্ঠান থেকে স্বাস্থ্যসেবা নিতে না পেরে ৯১ হাজার ২৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। অর্থাৎ রোগী সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেনি বা হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও জনবলের সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়নি।
কমিশন বলছে, ক্যানসার, জন্মগত ত্রুটি, মানসিক রোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা থেকে মৃত্যু ঠেকাতে সেবার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি সেবা প্রতিষ্ঠানের ব্যবহার বাড়ানোর ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে। কিন্তু দেশে স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে অসন্তুষ্টি আছে। চার বছর আগে দেশের সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান নিয়ে এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে মৌলিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার দক্ষতা খুবই নিম্নমানের। ১০টির মধ্যে মাত্র একটি হাসপাতালে রক্তের হিমোগ্লোবিন পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে।
বাংলাদেশ হেলথ ফ্যাসিলিটি সার্ভে ২০১৪ নামের ওই জরিপ প্রতিবেদন তৈরি করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) ও যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি। জরিপে দেখা গেছে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে ৩৮ শতাংশ চিকিৎসকের পদ ও ২০ শতাংশ নার্সের পদ শূন্য। মাত্র ২৮-৩৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে সুইয়ের মাধ্যমে দেওয়া অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক এবং শিরায় দেওয়া তরল পাওয়া যায়। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ ও স্নায়ুরোগের মানসম্পন্ন চিকিৎসা দিতে প্রস্তুত থাকে না। যক্ষ্মার চিকিৎসা দেয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৪৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে যক্ষ্মা চিকিৎসার নির্দেশিকা জরিপের সময় পাওয়া যায়নি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে সেবার মান উন্নয়নে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি সেবার মানের ক্ষেত্রে ৩০টি দুর্বলতা চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ১০টি অকারিগরি দিক (যেমন রোগীর অসন্তোষ, স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন না, রোগীকে পর্যাপ্ত সময় দেন না ইত্যাদি) ও ২০টি কারিগরি দিক (যেমন যন্ত্র চালানোর জন্য দক্ষ জনবলের স্বল্পতা, বিদ্যুৎ-সংযোগ না থাকা)। এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখন অকারিগরি বিষয় নিয়ে কাজ করছি। সেবা প্রতিষ্ঠানের কাজের পরিবেশ উন্নত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলা, রোগীর আস্থা অর্জন করা।’