রাজনৈতিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত হয়নি
>* আ. লীগের আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি প্রায় চূড়ান্ত।
* বিরোধী জোটের গতিবিধি দেখে রাজনৈতিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত করতে চায় সরকারি দল। কৌশল নির্ধারণে অপেক্ষা
* পরিস্থিতি বুঝে অবস্থান জানাবে সম্ভাব্য মিত্ররা।
* নির্বাচনকালীন সরকার গঠনও আটকে আছে।
* মধ্য নভেম্বরে জট খুলতে পারে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণের জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি প্রায় চূড়ান্ত। কিন্তু রাজনৈতিক প্রস্তুতি শেষ করতে পারেনি সরকারি দল আওয়ামী লীগ। বিশেষ করে ভোটে কারা মিত্র হিসেবে থাকবে, তা এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি। সম্ভাব্য মিত্রদের কেউ কেউ আবার বিরোধী রাজনৈতিক জোটের গতিবিধি দেখে এবং পরিস্থিতি বুঝে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করতে চায়।
আওয়ামী লীগ, তাদের জোট ১৪ দলের শরিক এবং সম্ভাব্য মিত্রদের সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সবকিছু স্পষ্ট হতে পারে। এ জন্য মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ১৪ দল ও এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টি ছাড়াও এক ডজনের বেশি দল ও জোটের সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য করার আলোচনা চলছে। ওই দলগুলো ভেতরে-ভেতরে নিজেদের চাহিদা বলছে, দর–কষাকষি করছে, আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু এখনই প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতে চাইছে না। এ জন্য রাজনৈতিক কৌশল চূড়ান্ত করতে পারছে না সরকারি জোট।
এ জন্য নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া অনেকটা আটকে আছে। এর আগে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা কমিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ভাবনা ছিল সরকারের। কিন্তু এখন তফসিল ঘোষণার আগে এই সরকার গঠন অনিশ্চিত বলে সরকারের নীতিনির্ধারণী সূত্র জানিয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকারের আকার কেমন হবে, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, নির্বাচনকালীন সরকারের আকার ছোট হলে বাদ পড়া মন্ত্রীরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারেন, যা দলে অনৈক্যের জন্ম দিতে পারে। আবার মিত্র দলগুলো থেকেও এই মন্ত্রিসভায় থাকতে চান অনেকে।
বর্তমান সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার বলতে কিছু নেই। ২০১৪ সালের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা ৩০-এ নামিয়ে এনে এর নাম দেওয়া হয়েছিল নির্বাচনকালীন সরকার। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা নিয়ে যেহেতু কোনো আইন, নীতিমালা নেই; ফলে সরকার কী করবে, কখন করবে—এটা তাদের একান্ত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তবে সবাই চাইবে মন্ত্রী থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নিতে।
তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার কবে হবে, এর আকার কী হবে, সেটা প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী এখনো সিদ্ধান্ত জানাননি।
ভোট ও জোটের প্রস্তুতি সম্পর্কে নাসিম বলেন, ভোটের জন্য আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল প্রস্তুত। তবে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আরও মিত্র বাড়বে। বিরোধীদের কর্মকাণ্ডের ওপর তাঁরা নজর রাখছেন। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী ঐক্য চূড়ান্ত হবে।
সংবিধান অনুযায়ী, সংসদ না ভাঙলে ৩১ অক্টোবর থেকে আগামী ২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে।
ইসির সূত্র জানায়, ২৭ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণের কথা ভেবে রেখেছিল ইসি। কিন্তু সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী ২৭ ডিসেম্বর ভোট হতে পারে এমন বক্তব্য দেওয়ায় ইসিকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। সাধারণত তফসিল ঘোষণার দিন থেকে ভোট নেওয়া পর্যন্ত মোট ৪৫ দিন হাতে রাখা হয়। আর ভোট গ্রহণের দিন হিসেবে বৃহস্পতিবার বেছে নেওয়ার একটা রেওয়াজ আছে। কারণ ভোট গ্রহণের পর সাপ্তাহিক ছুটি থাকলে ধকল সামলানো সহজ হয়।
ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচনের কারিগরি প্রস্তুতি ৮০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনের জন্য ৪০ হাজার ভোটকেন্দ্রের জন্য প্রায় সাড়ে ৭ লাখ ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার তালিকা তৈরি করার জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে ইসি। ভোটার তালিকার সিডি, ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটার কাজ শেষ হয়েছে। ৩০ অক্টোবরের মধ্যে ভোটের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ইসি হাতে পাবে। আগামীকাল রোববার ইসির বৈঠকে সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, স্বতন্ত্র প্রার্থী (প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন যাচাই) সংশোধন এবং বিদেশি পর্যবেক্ষক নীতিমালা নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হতে পারে।
ইসির প্রস্তুতির পাশাপাশি ব্যাপক আপত্তির মধ্যেই সরকার সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করেছে। সম্প্রচার আইনও হওয়ার পথে। ভোট গ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে পছন্দমতো সাজানো হয়েছে। এ সব কিছু আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই করা হয়েছে বলে সরকার ও আওয়ামী লীগের সূত্র জানিয়েছে।
নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন ও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার অনেকটাই নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে। কারিগরি ও ভোটের আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নিলেও ইভিএম ব্যবহার, সেনা মোতায়েনসহ রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ে ইসি এখনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেনি। এর বাইরে নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য ইসির সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে যেসব সুপারিশ এসেছিল, সেগুলো নিয়েও তারা নিশ্চুপ। এ ধরনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের সঙ্গে অন্য কমিশনারদের বিরোধ তৈরি হয়েছে। বাক্স্বাধীনতা খর্ব করার অভিযোগ এনে মাহবুব তালুকদার সর্বশেষ কমিশন বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসেন। সরকার ও ইসি ভোট গ্রহণের জন্য আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নিলেও রাজনৈতিক যেসব দাবি বা সমঝোতার বিষয় রয়েছে, সে বিষয়ে তারা চুপ আছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত রুটিন কাজই করছে। ভোট গ্রহণের সরঞ্জাম সংগ্রহ বা লোকবল ঠিক করা কঠিন কাজ নয়। ইভিএম ব্যবহার ও সেনা মোতায়েনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না। আর হলে সেটা সবাইকে জানিয়েই করা উচিত। কারণ ইসি নিয়ে রাজনৈতিক দলের প্রশ্ন থাকে। তাই তাদের স্বচ্ছ থাকা ভালো।