বন্ধ হয়নি শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে ২০১১ সালে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। একই বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় আদেশ জারি করেছে। ২০১৩ সালের শিশু আইনের ৭০ ধারাতেও শিশুকে আঘাত বা অবহেলাসহ মানসিক বিকৃতির শিকার হলে তাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো শিশুদের প্রতি এ ধরনের নিষ্ঠুরতার অবসান হয়নি।
আজ বৃহস্পতিবার ‘শিশু সুরক্ষা এবং শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিরসন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা এসব কথা বলেছেন। বৈঠকটির আয়োজন করে প্রথম আলো, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট-ব্লাস্ট এবং আন্তর্জাতিক শিশু অধিকারবিষয়ক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন।
কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকটিতে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম এবং প্রথম আলোর উপদেষ্টা গওহার নঈম ওয়ারা।
বৈঠকের আলোচকেরা বলেন, আইন, নীতির পাশাপাশি শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিরসনে জাতীয় পর্যায়ে মোর্চা গঠিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ ধরনের নির্যাতন কমছে না। সরকারি পরিপত্র ও নির্দেশনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করা হচ্ছে না। ২০১৬ সালে ব্লাস্টের কর্ম এলাকায় পরিচালিত এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ৬৯ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের ভালোর জন্যই শাস্তির বিধান থাকা প্রয়োজন। তাই এ ধরনের নির্যাতন প্রতিরোধে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা তৈরি এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে বাড়িতে অভিভাবকের মাধ্যমে শিশুকে মারধর ও তাদের প্রতি কঠোর ব্যবহার, পথশিশু, গৃহকর্মী এবং প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেন আলোচকেরা।
বৈঠকের প্রধান অতিথি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক শিশুর সার্বিক সুরক্ষায় জাতীয় শিশু কমিশন এবং শিশু অধিদপ্তর গঠনের বিষয়টিতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, জেলায় প্রতি মাসে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি সমন্বিত সভা হয়। শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তির বিষয়টিকে এ সভায় একটি ‘এজেন্ডা’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে সুপারিশ করা হবে।
কাজী রিয়াজুল হক বলেন, বর্তমানের শিশুরা তাদের মর্যাদার বিষয়টিতে অত্যন্ত সজাগ। অভিভাবকসহ সবাইকে বিষয়টি মনে রাখতে হবে। শিশু নির্যাতনের এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেলে মামলা করে দৃষ্টান্ত তৈরি এবং সব স্তরে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
আলোচনায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট-ব্লাস্টের প্রধান আইন উপদেষ্টা এবং সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিম বলেন, আইন, হাইকোর্টের রায় থাকার পরও এ ধরনের নির্যাতন কমছে না। তবে একধরনের আন্দোলন শুরু হয়েছে। তিনি রংপুরে বৃহস্পতিবারই ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, দুই শিশু মারামারি করার পর শিক্ষক এক শিশুকে ঘুষি মারেন, এতে শিশুর কান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিক্ষক এ শিশুর অভিভাবককে পুলিশ দিয়ে ভয়ও দেখিয়েছেন বেশি বাড়াবাড়ি না করার জন্য।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের শিশু অধিকার কমিটির সদস্য নূরুন নাহার ওসমানী বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন গণমাধ্যম বিষয়টিতে সজাগ বলেই তা বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। তবে নির্যাতন আগেও ছিল, তাই বেড়েছে বা কমেছে তা বলা যাবে না। তিনি গৃহকর্মী, পথশিশুদের প্রতি যে নির্যাতন, তা নিরসনের জন্য আইনের পাশাপাশি নিজেদের বিবেককে জাগ্রত করা এবং শুধু শিক্ষক সচেতন হলেই হবে না, অভিভাবকদেরও সচেতন হতে বলে উল্লেখ করেন।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক যুগ্ম সচিব শেখ জসিমউদ্দিন আহাম্মেদ। অসুস্থতার জন্য তিনি বক্তব্য দেননি। বক্তব্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (বিদ্যালয়) মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুরা শারীরিক ও মানসিক শাস্তির হাত থেকে মুক্তি পেয়ে গেছে তা বলা যাবে না। তবে অভিযুক্ত শিক্ষকদের শাস্তি দেওয়া, নজরদারি করাসহ মন্ত্রণালয় বিষয়টিতে অনেক সচেতন।
ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের চেয়ারপারসন শিক্ষক নেতা কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, শাস্তি নিরসনে শুধু আইন বা নীতি থাকলেই হবে না, তা শিক্ষক ও অভিভাবকদের জানতে হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে এ বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেন তিনি।
সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স অ্যান্ড চাইল্ড প্রোটেকশন বিভাগের পরিচালক লায়লা খন্দকার বলেন, বর্তমানে ৫৩টি দেশ শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন করেছে। বাংলাদেশ এ তালিকায় নেই। শাস্তি থেকে শিশুর সুরক্ষা পাওয়া মৌলিক অধিকার। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদেও বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্যও এ ধরনের শাস্তি বন্ধ করতে হবে। তিনি শিশুদের প্রতি শাস্তি নিরসনে নতুন আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেন।
শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রতিরোধে আইন, নীতিসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে বৈঠকে ব্লাস্টের পক্ষ থেকে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ব্লাস্টের (অ্যাডভোকেসি) উপদেষ্টা তাজুল ইসলাম ও উপপরিচালক মাহবুবা আক্তার।
আলোচনায় বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুছ সহিদ মাহমুদ জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য উল্লেখ করে জানান, গত বছর প্রথম ছয় মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় ৪১ জন শিশু। চলতি বছরের একই সময় অর্থাৎ প্রথম ছয় মাসে সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৬৯ জনে। নির্যাতন বৃদ্ধির হার ৪১ শতাংশ। তাঁর মতে, আইনের প্রয়োগ নেই এবং শিশু অধিকার বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার ইনস্টিটিউটের জরিপের তথ্য উল্লেখ করে বলেন, দেশের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এদের বড় অংশই ছোটবেলায় কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার ছিল। আর শিশুদের নিয়ে আলাদা জরিপের তথ্য বলছে, দেশের ১৮ শতাংশ শিশুই কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। শিশুরা নির্যাতনের শিকার হলে তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, অল্পতেই রেগে যাওয়াসহ বিভিন্ন প্রবণতা দেখা দেয়। তাদের মানসিক গঠন ব্যাহত হয়। মেখলা সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিভাবক ও শিক্ষকদের জন্য কাউন্সেলিং বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করেন।
শিশু সংগঠন এনসিটিএফের চাইল্ড পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার ফেরদৌস নাঈম বলেন, শিক্ষকেরা মারধর করলে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করতে ভয় পায়, কেননা এতে করে শিক্ষকেরা তাকে আর সুনজরে দেখবেন না।
গণসাক্ষরতা অভিযানের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার রেহানা বেগম বলেন, সরকারের বিভিন্ন আইন, নীতিমালা—সবই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে প্রণয়ন করা হয়েছে। বাড়িতে শিশুদের নির্যাতনের বিষয়টি চোখের আড়ালে চলে গেছে। স্কুলে ফলাফল দেওয়ার দিন দুই-চার নম্বর কম পাওয়ার জন্য সন্তানকে সবার সামনে অনেক অভিভাবক মারতে থাকেন। তাঁর মতে, শিশুদের সব ধরনের শাস্তি থেকে রক্ষা করতে হলে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিকস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইআইডি) নির্বাহী প্রধান সাঈদ আহমেদ বলেন, নির্যাতন হয়ে যাওয়ার পরে নয়, শিশুরা যাতে কোনোভাবেই এ ধরনের নির্যাতনের শিকার না হয়, তা নিয়ে কাজ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতিটি আনন্দময় হলে এ ধরনের নির্যাতন অনেক কমে যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।