ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারী হত্যা ১০ বছরে সর্বোচ্চ
>
- কাপেং মানবাধিকার প্রতিবেদন।
- গত বছর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ৯ নারী হত্যার শিকার হয়েছেন।
- গত বছর ৫৮ জন নারী ও মেয়েশিশু যৌন বা শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার হন।
- বাড়ছে ভূমি অধিগ্রহণ।
দেশের সমতল ও পার্বত্য চট্টগ্রামে গত বছর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নয়জন নারী হত্যার শিকার হয়েছেন। গত ১০ বছরের মধ্যে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ। ২০১৭ সালে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের যে পরিমাণ ভূমি অধিগ্রহণ বা অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা হয়েছে, তাও এর আগের বছরের তুলনায় বেশি।
ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানবাধিকার সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। সংগঠনটি ২০০৭ সাল থেকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আসছে। এসব পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবছরই কাপেং মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০১৭ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কাপেংয়ের প্রতিবেদন আজ বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা হবে রাজধানীর ডেইলি স্টার ভবনে।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে কাপেং মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। সংগঠনটির মানবাধিকারকর্মীদের দল এ তথ্য সংগ্রহ করেন। এবারের প্রতিবেদন নিয়ে কাপেংয়ের ব্যবস্থাপক হিরন মিত্র চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৭ সালে বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের ওপর নিপীড়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। এসব প্রতিরোধে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল, তা নিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। নারীর প্রতি সহিংসতা আগের তুলনায় আরও বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
কাপেংয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘নারীদের প্রতি সহিংসতা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র।’ নারীদের প্রতি সহিংসতার মধ্যে আছে ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, ধর্ষণের চেষ্টা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, অপহরণ ও পাচার। গত বছর ৪৮টি ঘটনায় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ৫৮ জন নারী ও মেয়েশিশু যৌন বা শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার হন। ঘটনাগুলোর মধ্যে ২৮টি ঘটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে, ২০টি সমতলে। আর এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযুক্ত ৬৮ জন অপরাধীর মধ্যে ৫৪ জনই বাঙালি, চারজন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার।
২০১৭ সালে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার যে নয় নারী হত্যার শিকার হয়েছেন, তাঁদের ছয়জনই পাহাড়ি। বাকি তিন ঘটনা ঘটেছে হবিগঞ্জ, দিনাজপুর ও সিরাজগঞ্জ জেলায়।
কাপেংয়ের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০৮ সালে একজন নারী হত্যার শিকার হন। এর পরের বছর হত্যার শিকার হন চারজন নারী। ২০১৬ সালে হত্যার শিকার হওয়া নারীর সংখ্যা ছিল ছয়।
বিচারহীনতার ফলেই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীদের হত্যার ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শুধু ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মধ্যেই নয়, নারী নিপীড়ন সর্বত্র বাড়ছে। তারপরও বিভিন্ন জাতিসত্তার নারীদের নিগ্রহ বেড়ে যাওয়ার কারণ তাঁরা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর নন। অপরাধীরা ধরেই নিয়েছে, এঁদের নির্যাতন করলে কিছু হবে না।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘স্বীকার করি, কাঙ্ক্ষিত ফল কমিশন দিতে পারে না। আমাদের সুপারিশে অনেক সময় কাজ হয় না। রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে সহনশীল হতে হবে।’ তিনি বলেন, নয়জন নারী হত্যার শিকার হওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে আতঙ্কজনক।
বাড়ছে ভূমি অধিগ্রহণ
২০১৭ সালে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রায় ২০ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ বা অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ার অধীনে আনা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, পর্যটন কমপ্লেক্স, ব্যবসায়িক কাজ এবং সংরক্ষিত বনভূমির নামে এসব অধিগ্রহণ হয়। মৌলভীবাজার জেলার খাসিপুঞ্জির খাসি এবং টাঙ্গাইলের মধুপুরের গারোরা অধিগ্রহণ এবং সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণার কারণে উচ্ছেদের আতঙ্কের মধ্যে আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনের জন্য শত শত একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্থাপনা নির্মাণের জন্যও উচ্ছেদ হতে হয়েছে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষকে।
২০১৬ সালে বিভিন্ন ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ৪২৯ একর। পরের বছর অন্তত পাঁচ হাজার একর বেশি ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ায় গেছে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, লংগদু ও গোবিন্দগঞ্জের ঘটনা প্রমাণ দেয় এ দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষ কতটা অনিরাপদ। অপরাধ করে বড় শাস্তি হবে না, এমন নিশ্চয়তা দুষ্কৃতকারীরা পায় বলেই এসব ঘটনা ঘটে।
অধিগ্রহণ বা ভূমির বিরোধ মেটাতে কতটুকু সজাগ সরকার? উত্তরে ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘এখন অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ তিন গুণ বাড়ানো হয়েছে। উন্নয়নের জন্য তো জায়গা লাগবে। তবে যাতে কারও মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয়, সে বিষয়ে আমরা সজাগ।’