মহাকাশে ওড়ার অপেক্ষায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট
এগিয়ে চলেছে দেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১-এর নির্মাণকাজ। মূল কাঠামো তৈরি থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এই স্যাটেলাইট প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে। বাকি কাজ শেষ করে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এই স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানোর আশা করছে সরকার। সফলভাবে মহাকাশে গেলে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক হবে বাংলাদেশ।
মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের অবস্থান হবে ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। এই কক্ষপথ থেকে বাংলাদেশ ছাড়াও সার্কভুক্ত সব দেশ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও কাজাখস্তানের কিছু অংশ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের আওতায় আসবে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এই স্যাটেলাইট দিয়ে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানা গেছে।
দেশের বেশ কয়েকটি স্যাটেলাইট চ্যানেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের বাইরে বাংলাদেশি চ্যানেলের সবচেয়ে বড় বাজার হলো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ। এখন দেশের প্রায় সব চ্যানেল হংকংয়ের অ্যাপস্টার-৭ নামের স্যাটেলাইট ব্যবহার করে। এই স্যাটেলাইট দিয়ে বাংলাদেশসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সেবা দিতে পারছে চ্যানেলগুলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দিয়ে সেটি করা সম্ভব হবে না।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স অব বাংলাদেশের পক্ষে কেউ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল ৭১-এর প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দিয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত সেবা ভালোভাবে পাওয়া যাবে। এখন আমরা যে স্যাটেলাইট ব্যবহার করি, সেটা দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত সেবা পাই, এই স্যাটেলাইট দিয়ে সেটি হয়তো পাওয়া যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্যাটেলাইটে যেহেতু আমরা পরে যাত্রা শুরু করেছি, তাই এর চেয়ে ভালো অবস্থা পাওয়া সম্ভব ছিল না, এই বাস্তবতাও স্বীকার করতে হবে। বিদেশি স্যাটেলাইটের জন্য দেশীয় চ্যানেলগুলোকে যে ভাড়া দিতে হয়, সরকার তার চেয়ে কম ভাড়া নিলে আমরা অবশ্যই নিজস্ব স্যাটেলাইট ব্যবহার করব।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সরাসরি সেবা না গেলেও বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যেসব স্যাটেলাইট আছে, সেগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে এই সেবা
দেওয়া যেতে পারে।
স্যাটেলাইট তৈরির এই পুরো কর্মযজ্ঞটি চলছে বিটিআরসির তত্ত্বাবধানে। তিনটি ধাপে এই নির্মাণকাজ চলছে। এগুলো হলো স্যাটেলাইটের মূল কাঠামো তৈরি, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি। স্যাটেলাইট তৈরি হচ্ছে ফ্রান্সের মহাকাশ সংস্থা থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসে। থ্যালেসে স্যাটেলাইট তৈরির কাজ শেষে এটি উৎক্ষেপণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় পাঠানো হবে। সেখানে আরেক মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের ‘ফ্যালকন-৯’ রকেটে করে স্যাটেলাইটটি মহাকাশে পাঠানো হবে। স্যাটেলাইট ওড়ানোর কাজটি বিদেশে হলেও এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে বাংলাদেশ থেকেই। এ জন্য গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙামাটির বেতবুনিয়ায় গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশন (ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা) তৈরির কাজ চলছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট খরচ হচ্ছে ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে দেওয়া হচ্ছে ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। আর ঋণ হিসেবে বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি দিচ্ছে বাকি ১ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা।
মোট প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সবচেয়ে বড় খরচ হচ্ছে থ্যালেস অ্যালেনিয়া থেকে স্যাটেলাইট সিস্টেম কেনায়। এ জন্য খরচ হচ্ছে ১ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। স্যাটেলাইটটি যে কক্ষপথ বা অরবিটাল স্লটে উড়বে, সেটি কেনা হয়েছে রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিক নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। এ জন্য খরচ হয়েছে প্রায় ২১৯ কোটি টাকা। বাকি প্রায় ৮০০ কোটি টাকা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে খরচ হচ্ছে।
২০১৫ সালে মূল স্যাটেলাইট তৈরির কাজ শুরু হলেও এর প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু হয় আরও তিন বছর আগে ২০১২ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল (এসপিআই) এই প্রকল্পে ২০১২ সাল থেকে বিটিআরসির পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত এসপিআই পরামর্শক হিসেবে কাজ করবে। এই প্রতিষ্ঠানের পরামর্শেই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই, অর্থায়ন, দরপত্র, অরবিটাল স্লট কেনাসহ অন্য সব কাজ করেছে বিটিআরসি।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট তৈরির কাজ খুব সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে চলেছে। এভাবে চললে নির্ধারিত সময়েই এটি মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা সম্ভব হবে। এই স্যাটেলাইট হবে বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক।’
প্রস্তাবিত স্যাটেলাইটের মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে। বাকি ২০টি ট্রান্সপন্ডার বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির জন্য রাখা হবে। ট্রান্সপন্ডার হলো একটি মাইক্রোওয়েভ অ্যানটেনা, যার মাধ্যমে ভয়েস, ডেটা ও ভিডিও সিগন্যাল গ্রহণ ও প্রেরণ করা হয়। ট্রান্সপন্ডারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র বেতার তরঙ্গকে সংকেত বা সিগন্যাল হিসেবে পাঠানো হয়।
নিজস্ব স্যাটেলাইট দিয়ে বাংলাদেশের কী লাভ হবে, সে বিষয়ে বিটিআরসির প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিদেশি স্যাটেলাইট ভাড়া নিয়ে ব্যবহার করে। এ জন্য বছরে ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা ১১২ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যায়। নিজস্ব স্যাটেলাইট থাকলে প্রতিবছর ১১২ কোটি টাকা হিসেবে স্যাটেলাইটের ১৫ বছরের জীবনকালে সাশ্রয় হবে ১ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। এ ছাড়া দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিতে ভূমিকা রাখবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। এ ছাড়া টেলিচিকিৎসা, ই-শিক্ষা, গবেষণা, ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) সেবা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পাওয়া যাবে। প্রতিরক্ষা ও দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় জরুরি যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যাবে এই স্যাটেলাইট।
মহাকাশে যাওয়ার পর স্যাটেলাইটটির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধু কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট বাংলাদেশ (বিসিএসবি) কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি গঠনের কাজ এখন চলছে। এটির লোকবল নিয়োগ ও তাঁদের প্রশিক্ষণের জন্য থ্যালেসের সঙ্গে ২০২০ সাল পর্যন্ত চুক্তি আছে। বিটিআরসির চেয়ারম্যান বলেন, নিজস্ব লোকবল দিয়েই যাতে ভবিষ্যতে স্যাটেলাইটটি চালানো যায়, সেই লক্ষ্য নিয়েই কোম্পানি গঠনের সব কাজ চলছে।
এদিকে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের একটি ‘রেপ্লিকা’ গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ‘রেপ্লিকা’ হস্তান্তর করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম।