
হেমন্তের নরম রোদের দুপুর। আপন ছন্দে বয়ে চলেছে জনজীবন। এর মাঝেই ক্রিং ক্রিং শব্দ করে আমাদের রিকশা থামে শ্বেতশুভ্র দ্বিতল এক ভবনের সামনে।
কাঁঠাল, মেহগনি, বেল, লেবুগাছের ছায়ায় ঢাকা মায়াময় জনপদ। সামনে সিঁড়ি বাঁধানো পুকুর। নীরব, শান্ত।
ভবনটি খেলারাম দাতার বাড়ি ও বিগ্রহ মন্দির। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষিত একটি পুরাকীর্তি।
গুলিস্তান থেকে বাসে বড়জোর দেড় ঘণ্টার পথ ঢাকার নবাবগঞ্জ। উপজেলা সদর বাসস্ট্যান্ড থেকে দোহারের পথে যেতে একটু এগোলেই কলাকোপা ইউনিয়ন। কলাকোপা থেকে ছোট্ট একটি রাস্তা চলে গেছে বান্দুরার দিকে। সেই পথেই পড়বে খেলারাম দাতার মন্দির।
২৫ অক্টোবর দুপুরবেলা মন্দির ভবনে গিয়ে কিছু পর্যটকের দেখা মিলল। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সদলবলে এসেছেন মন্দিরটি দেখতে। এসেছেন আরও কিছু মানুষ। জানা গেল, লোক বেশি হয় শুক্রবার সকালে। ঢাকা থেকে অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠনের মানুষজন আসেন।
খেলারাম দাতা সম্পর্কে এলাকায় নানা কথা প্রচলিত। কেউ বলেন, তিনি ছিলেন জমিদার। আবার কারও মতে, তিনি ভয়ানক দস্যু ছিলেন। তবে খেলারামের দানের হাত ছিল বড়। তিনি ধনীদের কাছ থেকে ডাকাতি করে টাকাপয়সা, মালামাল গরিবদের বিলিয়ে দিতেন। শেষ জীবনে তিনি অতিশয় ধার্মিক ব্যক্তিতে পরিণত হন। কথিত আছে, খেলারাম দাতার বাড়ি থেকে ইছামতীর পাড় পর্যন্ত সুড়ঙ্গ পথ ছিল। নদীপথে ধনসম্পদ এনে এ সুড়ঙ্গ পথেই বাড়ি নিয়ে আসতেন তিনি।
নামটি নিয়েও আছে মতভেদ। কেউ বলেন, তাঁর নাম ছিল ‘খেলারাম দত্ত’। কেউ বলেন ‘খেলারাম দাদা’। আর স্থানীয় ব্যক্তিরা বলে থাকেন ‘খেলারাম দাতা’।
বাড়ি ও মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের তরফে একজন লোক আছেন। যাঁর কাজ পর্যটকেরা এলে খুলে দেওয়া এবং দেখানো। তবে অনেকেরই অভিযোগ, তাঁকে দায়িত্ব পালনে ঠিকমতো পাওয়া যায় না। তাই বাড়ির খোলা ফটক দিয়ে যে যখন খুশি ভেতরে ঢোকে। বিড়ি-সিগারেটের শেষ অংশ, পরিত্যক্ত পানির বোতল পড়ে থাকে যেখানে-সেখানে।
বর্তমানে ভবনের শুধু ওপরের দোতলা টিকে রয়েছে। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে গিয়ে কারুকার্যমণ্ডিত মন্দিরটির সৌন্দর্য দৃশ্যমান হয়। ভবনের ভারী দেয়াল ও পিলার দেখে নির্মাণকৌশল সম্পর্কে ধারণা মেলে। দোতলার চারপাশে ও চার কোণে বাংলা ঘরের আকৃতিতে এক কক্ষবিশিষ্ট আটটি ঘর। মাঝে মঠ আকৃতির আরেকটা ঘর।
মূল মন্দিরের রংটি ছিল লালচে। মন্দিরের গায়ে সাদা রঙের প্রলেপ পড়েছে, বছর খানেক আগে। কিছু কিছু জায়গায় দিতে হয়েছে আস্তর।
মন্দির ভবনটির নকশা সম্পর্কে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম শাহনওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ঔপনিবেশিক সময়ে নির্মিত ভবনগুলোর নির্মাণকৌশলে মোগল রীতির প্রতিফলন রয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউরোপীয় ধারা। মোগল যুগে চুন-সুরকির ব্যবহার ছিল। এর সঙ্গে এসেছে বিম-বর্গা। তাঁর মতে, খেলারাম দাতার মন্দিরটি উনিশ শতকের শেষ দিকে অথবা বিশ শতকের শুরুর দিকে নির্মিত।
এম এ করিমের লেখা ইছামতির বাঁকে বইতে খেলারাম দাতার মন্দির নিয়ে যৎসামান্য বর্ণনা রয়েছে।
এটি একটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হলেও এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ে না। এমনকি এটি যে একটি ‘সংরক্ষিত পুরাকীর্তি’, সেই ঘোষণাটিও কোথাও নেই।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আলতাফ হোসেন ১ নভেম্বর প্রথম আলোকে বললেন, তাঁরা মন্দিরটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অবগত। ভবনটির গায়ে ‘সংরক্ষিত পুরাকীর্তি’ সাইনবোর্ড স্থাপনের জন্য অচিরেই তাঁরা উদ্যোগ নেবেন।