এই যে শুনুন।
মিলি শুনতে পেল না। যেমন হাঁটছিল, হাঁটতে লাগল।
ভদ্রমহিলা দ্রুতই হাঁটছিলেন। পরনে বেগুনি প্রিন্টের কামিজ আর সাদা সালোয়ার। পায়ে আরামদায়ক জুতো। অক্টোবরের শেষদিক। বিকেলবেলার পার্কে শীতলভাব। তারপরও তিনি বেশ ঘেমেছেন। মিলি শুনতে পায়নি দেখে দৌড়ে এসে তাকে ধরলেন। শুনুন।
মিলি যেন অন্য জগৎ থেকে ফিরল। ডাগর চোখে আত্মমগ্ন দৃষ্টি। বলুন।
আপনি মিলি না? সজলের ছোটবোন?
জি। কিন্তু আপনাকে চিনতে পারলাম না।
না পারারই কথা। দেখা হলো বহুবছর পর। আমারও তোমাকে চিনতে কয়েক দিন সময় লাগল। তুমি তেমন বদলাওনি। আগে স্বাস্থ্য একটু ভালো ছিল। এখন স্লিম, সুন্দর। তবে মুখটা ঠিক আছে। আমি শান্তি। তোমাদের সেগুনবাগিচার বাড়িতে ভাড়া থাকতাম।
মিলি তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, আপনি শান্তি আপা? কী আশ্চর্য! আপনাকে চেনাই যায় না।
শান্তি হাসলেন। চেনা যাবে কী করে? বুড়ো হয়ে যাচ্ছি না? আমরা যখন তোমাদের বাড়ি ছেড়ে আসি, তখন তুমি ফোর–ফাইভে পড়ো। আমি অনার্স পড়ছি ইডেনে। বিয়ে হয়ে গেল। স্বামীর সঙ্গে চলে গেলাম লিবিয়ায়। তোমার দুলাভাই মারা গেলেন দু–বছর আগে। দুটোই ছেলে। ওরা সিডনিতে। বছরে ছয় মাস আমি গিয়ে ওদের সঙ্গে থাকি। বিদেশে থাকতে ভালো লাগে না। ইস্কাটনে ছোট একটা ফ্ল্যাট কিনেছিলেন তোমার দুলাভাই। তাঁর কত স্মৃতি সেখানে। ছয় মাস ওই ফ্ল্যাটে থাকি। বাকি সময় ফ্ল্যাটটা বন্ধ থাকে। আমার ছোট ভাই হারুন দেখাশোনা করে। ডায়াবেটিসে ধরেছে সাত–আট বছর হলো। সিডনিতে থাকলে তো হাঁটিই। দেশে থাকলে রমনা পার্কে আসি।
মিলি বুঝল শান্তি আপা বেশি কথা বলা মানুষ। বারো–তেরো বছর বয়সের পর তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়েছে কী, না মনে নেই। তখনো বেশি কথা বলতেন কি না, কে জানে। কিন্তু শান্তি আপার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছিল না তার। নিজের জগৎ থেকে ফেরার কারণে একটু বুঝি বিরক্ত।
শান্তি আপা বললেন, চলো, হাঁটি।
না থাক। দাঁড়িয়েই কথা বলি।
তোমার হাঁটা শেষ? কখন হাঁটতে আসো? কতক্ষণ হাঁটো। ডায়াবেটিস হয়নি তো?
না তা হয়নি। বিকেলেই আসি। যতক্ষণ ইচ্ছা হাঁটি। সময় মনে রাখি না।
শান্তি আপা অবাক। সময় মনে রাখো না?
না। এক–দু ঘণ্টা, কখনো কখনো তিন–চার ঘণ্টাও থাকি পার্কে। কখনো হাঁটি, কখনো বসে থাকি।
এতটা সময় পার্কে কাটাচ্ছ, তোমার ফ্যামিলি, হাজব্যান্ড বাচ্চাকাচ্চা? হাজব্যান্ড কী করে? ছেলেমেয়েরা কত বড় হলো? থাকো কোথায়?
বেইলি রোডে ফ্ল্যাট। ও বিজনেস করে। আচ্ছা যাই।
মিলি হাঁটতে শুরু করল।
শান্তি আপা অবাক। আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও। না ঠিক আছে, চলো হাঁটতে হাঁটতেই কথা বলি। এত দিন পর দেখা। আমার কথা তো বলেই ফেললাম। তোমার কথা তেমন শোনা হলো না। বাচ্চাকাচ্চাদের ব্যাপারে তো কিছু বললে না।
হাঁটার সময় কথা বলতে ভালো লাগে না।
তাহলে চলো কোথাও বসি।
না থাক। আমি একটু লেকের দিকটায় যাই।
চলো আমিও যাই। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালোই হলো। একা একা হাঁটতে ভালো লাগে না। আমিও তো বিকেলেই আসি। দুজন একসঙ্গে হাঁটা যাবে।
মিলি দাঁড়াল। আই অ্যাম সরি। আমি আপনার সঙ্গে হাঁটতে পারব না। আমি অন্য একজনের সঙ্গে হাঁটি।
মিলি হন হন করে হেঁটে লেকের দিকে চলে গেল। শান্তি আপা খুবই অবাক। মিলি দেখি একদম বদলে গেছে! কিশোরী বয়সে অতি উচ্ছল প্রাণবন্ত মেয়ে ছিল। তার ছুটোছুটি হইহল্লা আর হাসির শব্দে মুখর থাকত বাড়ি। বয়স কত হবে এখন? চল্লিশ–বিয়াল্লিশ। দেখে আরও কমবয়সী মনে হয়। চেহারা–ফিগার সুন্দর। হাইট ভালো। নীল টাউজার্স আর সাদা ফুলস্লিভ শার্ট পরে হাঁটছে। পায়ের কেডসটাও বেশ দামি। স্বামী যে অবস্থাপন্ন বোঝা যায়। কিন্তু সমস্যা কী মেয়েটার? কার সঙ্গে হাঁটে সে? তিন–চার দিন ধরে মিলিকে ফলো করার পর নিশ্চিত হয়েই তো তার সঙ্গে আজ কথা বললেন শান্তি! কই এ কদিন তো কাউকে তার সঙ্গে হাঁটতে দেখেননি? একা একাই তো হাঁটছে। মাঝে মাঝে একা একা বিড়বিড় করে। মুখটা হাসি হাসি হয় কখনো, কখনো স্নিগ্ধ মায়াবি। যেন নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছে বা ডুবে আছে কোনো মধুর স্মৃতিতে, এ রকম একটা ভাব হয় মুখের। একটু দূর থেকে নিবিড়ভাবেই মিলিকে খেয়াল করেছেন শান্তি।
কোনো মানসিক সমস্যা হয়নি তো মিলির? কথা বলে তেমন মনে হলো না। খুবই স্বাভাবিক সুন্দর ভঙ্গিতে কথা বলল। শান্তি যা যা জানতে চাইলেন সংক্ষেপে জবাব দিল। শুধু বাচ্চাকাচ্চার প্রসঙ্গে কিছু বলল না। দিনে দিনে কত যে বদলায় মানুষ!
শান্তি অন্যদিকে হাঁটতে লাগলেন।
পরদিনও মিলিকে তিনি দেখলেন। দূর থেকে হাত তুললেন। মিলি তাঁর দিকে ফিরেও তাকাল না। নিজের মতোই পা চালিয়ে হাঁটছে। স্নিদ্ধ মুখখানা হাসি হাসি। মাঝে মাঝে একটু যেন বিড়বিড় করছে। কখনো কখনো একটু থেমে এক পাশে তাকাচ্ছে। যেন কাউকে দেখছে। যেন পাশে কেউ আছে। তার সঙ্গে যেন বিড়বিড় করে কথাও বলছে।
সেদিনের পর থেকেই কৌতূহল হয়েছিল শান্তির। মিলি বলেছে সে একজনের সঙ্গে হাঁটে। তার হাঁটার সঙ্গীটা কে? হাজব্যান্ড যে না তা বোঝা গেছে। হাজব্যান্ড হলে সঙ্গে সঙ্গেই বলে দিত। তাহলে কি কোনও বন্ধু? বন্ধুটা কি মেয়ে না পুরুষ? নাকি পরকীয়া করছে মিলি? আজকাল ওদের বয়সী মহিলারা অনেকেই জড়িয়েছে পরকীয়ায়। স্বামী তার জগৎ নিয়ে ব্যস্ত। বাচ্চাকাচ্চারা বড় হয়ে গেছে। স্ত্রীটির সময় কাটে না। এ জন্য অনেক মহিলাই নাকি ওসব করছে। ফেসবুকের কারণেও ঘটছে এসব...
কিন্তু বেশ কয়েক দিন ফলো করেও মিলির সঙ্গে কাউকে দেখতে পেলেন না শান্তি। মিলি তার মতো একা একা হাঁটে। বিড়বিড় করে, পাশে তাকায়। নির্জন কোনো বেঞ্চে একা বসেও বিড়বিড় করে। যেন পাশে কেউ বসে আছে। কারও সঙ্গে যেন কথা বলছে। সূক্ষ্মভাবে খেয়াল না করলে ব্যাপারটা বোঝাও যায় না। সমস্যা কী মিলির?
দিন কয়েক পর এক বিকেলে মিলিকে ধরলেন শান্তি। বকুলতলার ওদিককার একটা বেঞ্চে বসে আছে। শান্তি এসে পাশে বসলেন। কেমন আছ, মিলি?
ভালো আছি। আপনি?
চলে যাচ্ছে। মাসখানেক পর ছেলেদের কাছে যাব।
খুব ভালো।
আজ মিলিকে সেদিনের তুলনায় আন্তরিক মনে হচ্ছে। শান্তি খুশি হলেন। তাহলে কথা বের করতে সুবিধা হবে। ব্যাপারটা জানার খুবই কৌতূহল শান্তির। বললেন, সেদিন বললে তুমি আমার সঙ্গে হাঁটবে না, কারণ তুমি আরেকজনের সঙ্গে হাঁটো...
তারপর আপনি আমাকে ফলো করলেন এবং দেখলেন আমি একা একাই হাঁটছি, এই তো?
তাই দেখলাম।
ও রকমই দেখবে সবাই। আসলে আমি একা হাঁটি না, আমার সঙ্গে আরেকজন হাঁটে।
কে হাঁটে তোমার সঙ্গে?
আমার মেয়ে। ওর বয়স এখন সতেরো বছর।
কই ওকে তো এক দিনও দেখলাম না!
আমি ছাড়া কেউ ওকে দেখতে পাবে না।
মানে কী? চোখের সামনে তোমাকে হাঁটতে দেখছি একা, তুমি বলছ তোমার সতেরো বছরের মেয়েও তোমার সঙ্গে হাঁটছে...তুমি ছাড়া কেউ কেন তাকে দেখতে পাবে না?
না পাবে না। ওকে শুধু আমিই দেখতে পাই। আমার সঙ্গে হাঁটে, কথা বলে, এ রকম বেঞ্চে আমরা মা–মেয়ে বসে থাকি। কত গল্প করি!
শান্তি তীক্ষ্ণ চোখে মিলির দিকে তাকালেন। তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?
জানি কী প্রশ্ন করবেন? আমার কোনো মানসিক সমস্যা হয়েছে কি না, এই তো? আমি পাগল কি না? হ্যাঁ, এই প্রশ্ন আপনি করতে পারেন। যে কেউ এমন কথা শুনলে এই প্রশ্নটাই করবে। হতে পারে এটা আমার মানসিক সমস্যা। কিন্তু এই সমস্যার কথা আমি কখনো কাউকে বলি না। আমি একটা কলেজে পড়াই, ফ্ল্যাটে কাজের লোকজন আর হাজব্যান্ডকে নিয়ে ব্যস্ত থাকি। ভাইবোনদের বাড়ি যাচ্ছি–আসছি। ভদ্রলোক বিজনেসের পাশাপাশি পলিটিক্স করেন। আমার ফ্ল্যাটে অনেক লোক আসে রোজ। ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা, বোনদের ছেলেমেয়েরা আসে, ছাত্রছাত্রীরা আসে, আমি সব নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকি। আমার নিজস্ব সময় এই বিকেলবেলাটা। যত ব্যস্তই থাকি বিকেলে পার্কে আমি আসবই। কারণ, মেয়ের সঙ্গে পার্কেই আমার দেখা হয়। সে আমার জন্য অপেক্ষা করে। আমি না এলে কাঁদে, মন খারাপ করে। কোনো কারণে পার্কে না আসতে পারলে আমারও হয় একই অবস্থা। এসব কথা আমি কখনো কাউকে বলি না।
তাহলে আমাকে বলছ কেন?
জানি না। বলতে ইচ্ছা করছে। আমার এখন একচল্লিশ বছর বয়স। বিয়ে হয়েছে আটাশ বছর বয়সে। ওই একটাই মেয়ে আমার। আর কোনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। তাও মেয়েটা আমার স্বামীর না।
ছোটখাটো একটা ধাক্কা খেলেন শান্তি। এমনিতেই পুরো ব্যাপারটা তাঁর কাছে রহস্যময়। অন্যে দেখতে পায় না এমন মেয়ের সঙ্গে পার্কে হাঁটে মিলি, কথা বলে, হাসে। তার ওপর বলছে সেই মেয়ে আবার ওর স্বামীর না। পুরোটাই রহস্যময়। মিলিকে মনে হচ্ছে সূক্ষ্ম জটিল মানসিক রোগী।
মিলি বলল, ঘটনাটা শুনুন। একুশ বছর বয়সে সাজিদ নামের একটা ছেলের সঙ্গে আমার প্রেম হয়েছিল। গভীর প্রেম। দুজন দুজনার জন্য পাগল। সাজিদ ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে আর আমি পড়ছি ভিকারুন নিসায়। ওদের পরিবারটা ভালো। মা স্কুল টিচার, বাবা উপসচিব। দুটো মাত্র ভাই। সাজিদ বড়। দেখতে যেমন ভালো, মানুষ হিসেবেও তেমন। আমাদের বাড়ির সবাই ওকে পছন্দ করত। ওর সঙ্গে বিয়েতে আমাদের পরিবারের কারও আপত্তি ছিল না। ওর মা আমাকে একটু কম পছন্দ করতেন, কিন্তু বাবা আর ভাইয়ের খুবই পছন্দ আমাকে। কথা হলো, আমার মাস্টার্স শেষ হলেই বিয়ে। সাজিদ পাস করে বেরোল। ভালো একটা চাকরি পেল। অফিসের কাজে প্রায়ই বাইরে যেতে হয় তাকে। আমরা অবাধ মেলামেশা করছি। রংপুর থেকে রাতেরবেলা অফিসের গাড়ি নিয়ে ফিরছিল সাজিদ। ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ। স্পটেই মারা গেল। আমি গেলাম পাগল হয়ে। তখন আমার চব্বিশ বছর বয়স। কয়েক দিন পর শুরু করলাম বমি...
তার মানে তুমি কনসিভ করেছ?
হ্যাঁ। প্রথমে বুঝতে পারিনি। বাড়ির লোকজন বুঝে গেল। প্র্যাগনেন্সি টেস্ট করা হলো। কী কেলেঙ্কারি! এ মেয়ের কী হবে এখন? বিয়ে হবে কী করে? শেষ পর্যন্ত যা হয় আর কী! ওয়াশ করানো হলো। মুক্ত হয়ে গেলাম আমি। কিন্তু...
একটু থামলো মিলি। উদাস হলো, বিষণ্ন হলো। হেমন্তকালের শেষ হয়ে আসা বিকেলের আকাশে তাকিয়ে বলল, যখন সবাই বলাবলি করছিল আমি কনসিভ করেছি, আমি টের পাচ্ছি শরীরের ভেতরে কী যেন একটা ঘটে গেছে, আমি মা হব, ঠিক তখন থেকেই মনে হতে লাগল ফুটফুটে একটা মেয়ে হবে আমার। ভারি সুন্দর, ফর্সা গোলগাল পুতুলের মতো মেয়ে...। আমি কিছুতেই ডাক্তারের কাছে যেতে চাইনি, ওয়াশ করাতে চাইনি। কিন্তু মা–বাবা, ভাইবোন, সমাজ! বিয়ে হতে হবে মেয়ের। কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না এই ঘটনা ঘটেছে মেয়ের জীবনে...। যেদিন কাজটা হয়ে গেল, মনে হলো আমার আত্মার শেষ অংশটাও চলে গেল। প্রথমে গেল সাজিদ তারপর তার চিহ্ন। আমি একা হয়ে গেলাম। তারও চার বছর পর আমার বিয়ে হলো। আশ্চর্য ব্যাপার, আমি আর কনসিভ করি না। ঢাকা–কলকাতা–ব্যাংকক, কত হাসপাতাল, কত বড় বড় ডাক্তার। কত চিকিৎসা, কত ওষুধ, কিছুই হলো না। এই নিয়ে একটু কষ্টও পেতাম। সেই কষ্ট শেষ হয়ে গেল এক বিকেলে। কলেজ, সংসার, লোকজন—সব নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি, নিজের সময় বলতে গেলে নেইই। নিজের একটু সময় দরকার। একটু একা থাকা দরকার। এই কারণে পার্কে আসতে লাগলাম। হাঁটাও হলো, একা থাকাও হলো। হাঁটতে এসে দেখি পুরোনো দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। সাজিদের কথা মনে পড়ে, যে মেয়ের স্বপ্ন দেখতাম সেই মেয়ের কথা মনে পড়ে। একদমই চলে যাই সেই সময়ে, সেই কল্পনায়। পার্কে সকাল–বিকেল অনেক লোক থাকে আজকাল। পুরুষ–মহিলা অনেক। আমি একটু নির্জন জায়গা বেছে হাঁটি। একা একা। একদিন হঠাৎ শুনি কে আমাকে কাতরকণ্ঠে ডাকল, মা, ওমা। এদিক–ওদিক তাকিয়ে দেখি, কই কোথাও কেউ নেই তো! কে ডাকল তাহলে? আমি যে পরিষ্কার শুনলাম! ভাবলাম মনের ভুল। মেয়েটির কথা ভাবছিলাম বলে এমন হয়েছে। আবার হাঁটতে লাগলাম। কিছুক্ষণ আবার সেই ডাক। মা, ওমা। এই ঘটনা ঘটল তিন–চার দিন। তারপর সেই কণ্ঠ এক বিকেলে বলল, আমাকে তুমি চিনতে পারছ না, মা? আমি তোমার সেই মেয়ে, যাকে ভ্রূণেই হত্যা করেছিলে। কিন্তু আমি মারা যাইনি। আমি তোমার আত্মার অংশ হয়ে আছি। তোমার সঙ্গেই আছি। দিনে দিনে বড় হচ্ছি। আমার এখন সতেরো বছর বয়স। মাগো, তুমি আমাকে হত্যা করেছিলে কেন? মানুষ কি তার আত্মার অংশকে হত্যা করে?
মিলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর থেকে ধীরে ধীরে মেয়ের সঙ্গে আমি জড়িয়ে গেলাম, আপা। বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর থেকে পরদিন বিকেলের জন্য শুরু হয় আমার অপেক্ষা। কখন পার্কে যাব, কখন মেয়ের সঙ্গে আমার দেখা হবে। কখন সে মা ডাকে আমাকে ভরিয়ে দেবে। কখন গাল ফুলাবে, আবদার করবে, হাসবে, আমাকে জড়িয়ে ধরবে। রাগ করবে, অভিমান করবে, কাঁদবে...। আর কী যে সুন্দর হয়েছে আমার মেয়ে। যেমন আমি কল্পনা করেছিলাম ঠিক তেমন। আমি তার সঙ্গে হাঁটি আপা, তার সঙ্গে কথা বলি। মা–মেয়ে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে একজন তাকাই আরেকজনের মুখের দিকে। আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময় পার্কের বিকেলগুলো। আমার মেয়ে...। মেয়ের কথা কখনো কাউকে বলি না। আপনাকে বললাম। কেন, তা–ও জানি না।
শান্তি ফ্যাল ফ্যাল করে মিলির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।