থ্রিলারকেও হার মানানো বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা

ঢাকা বিমানবন্দরে জাপান এয়ারলাইনসের ছিনতাই হওয়া ফ্লাইট নং (ডিসি-৮)। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা বিমানবন্দরে জাপান এয়ারলাইনসের ছিনতাই হওয়া ফ্লাইট নং (ডিসি-৮)। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। জাপান এয়ারলাইনসের একটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে জাপানিজ রেড আর্মির একদল সদস্য। বিমানটিতে ছিলেন ১৩৭ জন যাত্রী এবং ১৪ জন ক্রু। ছিনতাইকারীরা নানা পথ ঘোরা শেষে বিমানটি অবতরণ করায় ঢাকার পুরোনো বিমানবন্দরে। সৃষ্টি হয় চরম উত্তেজনাকর ও আতঙ্কজনক এক পরিস্থিতির। জাপান ও বাংলাদেশ তো বটেই, আন্তর্জাতিক পরিসরেও এই বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা মহাভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা ছিনতাই করা বিমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যাত্রী ছিল। ফলে বিমান ছিনতাইয়ের এ ঘটনা প্রায় সারা বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।

ছিনতাইকারীরা যখন বাংলাদেশের কোনো বিমানবন্দরে অবতরণের লক্ষ্য স্থির করে এবং সেইমতো ঢাকার পুরোনো বিমানবন্দরে অবতরণ করে, তখন এ ঘটনার মুখে বাংলাদেশের নিশ্চুপ-নিঃসাড় থাকার অবকাশ ছিল না। ফলে ছিনতাইকারীরা যাতে তাদের হাতে জিম্মি যাত্রীদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে বা জানে মেরে ফেলতে না পারে, সেই লক্ষ্য থেকে বাংলাদেশের সামরিক-বেসামরিক পদস্থ কর্মকর্তাদের একটি দল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। চলতে থাকে দর-কষাকষি। এ ঘটনার তিন দিনের মাথায় এ বইয়ের লেখক জাপানের পরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিই একটি প্রতিধিদলসহ ঢাকায় এসে পৌঁছান। এ খবর বিমান ছিনতাইকারী রেড আর্মি জঙ্গিদের কাছে পৌঁছালে তারা সাফ জানিয়ে দেয়, তারা কেবল বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। জাপান তাদের শত্রু। ফলে জাপানি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কথা বলতে তারা রাজি নয়। তাদের সোজাসাপ্টা দাবি, জাপানে কারারুদ্ধ রেড আর্মির সদস্যসহ ৯ জনের মুক্তি এবং ৬০ লাখ মার্কিন ডলার তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। তাহলেই বিমানে জিম্মি করা সবাইকে তারা ছেড়ে দেবে। অবশ্য এরই মধ্যে তারা জানতে পেরেছিল, জাপান সরকার তাদের সব দাবি মেনে নিয়েছে। আর সে কারণেই পরিবহন প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিইর নেতৃত্বে জাপানি প্রতিনিধিদলের ঢাকায় আগমন। তবে জাপানি জঙ্গিরা দর-কষাকষির ব্যাপারে বাংলাদেশের তৎকালীন বিমানবাহিনী প্রধান এ জি মাহমুদের সঙ্গে কথা বলতে যতটা স্বচ্ছন্দ বোধ করেছে, জাপানি প্রতিনিধিদলের প্রধানের সঙ্গে ততটা নয়। একপর্যায়ে এ নিয়ে দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে রীতিমতো মনোমালিন্যেরও সৃষ্টি হয়। এ বইয়ের ‘এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ’, ‘কষ্টকর সিদ্ধান্ত’, ‘জিম্মি বিনিময়’ ও ‘ওকুদাইরার সঙ্গে আলোচনা’ শিরোনামের অধ্যায় চারটি পড়লে এমন এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠবে, স্মৃতি থেকে সহজে যা মুছে যাবে না। সে কথা বলেছেনও এ বইয়ের অনুবাদক কাজুহিরো ওয়াতানাবে তাঁর ভূমিকায়। বলেছেন, ‘...জিম্মিদের কীভাবে নিরাপদে উদ্ধার করা যায়, তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছিল। এ কারণে এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, যিনি বিমান ছিনতাইকারীদের সঙ্গে দর-কষাকষির দায়িত্বে ছিলেন এবং জাপানি প্রতিনিধিদলের প্রধান ও তৎকালীন পরিবহন প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিইর মধ্যে যে বিবাদ দেখা দিয়েছিল, সেই বর্ণনা আমরা মি. ইশিইর লেখার মধ্যে পাই।’ আসলে জাপানি জঙ্গিদের হাত থেকে জিম্মিদের মুক্তির ব্যাপারটা কোনোক্রমেই সহজ ছিল না। কী করে এই কঠিন সমস্যার সমাধান হলো, সে এক সত্যিই বিস্ময়কর ঘটনা।



উপর্যুপরি যখন এই নাটকীয় ঘটনা চলছে, তখনই বাংলাদেশে বিমানবাহিনীতে সংঘটিত হয় একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থান। এর সরাসরি প্রভাব পড়ে জাপানি জঙ্গিদের এই বিমান ছিনতাই ও জিম্মি ঘটনার ওপর। অবশেষে শ্বাসরুদ্ধকর এই জিম্মি-নাটকের অবসান ঘটে। জঙ্গিরা তাদের দাবি করা অর্থ ও তাদের দলীয় সদস্যদের নিজেদের নাগালে পাওয়ার পর জিম্মিদের মুক্ত করে দেয় কুয়েত, দামেস্ক ও শেষমেশ আলজেরিয়া বিমানবন্দরে—পর্যায়ক্রমে বিমান থামিয়ে। এভাবেই শেষ হয় জাপানি বিমান ছিনতাই ও জিম্মি-মুক্তি নাটকের।

এ ঘটনার আদ্যন্ত সাক্ষী জাপানি পরিবহন প্রতিমন্ত্রী হাজিমে ইশিই পরবর্তীকালে জাপানি ভাষায় এ নিয়ে একটি বই লেখেন। সে বইয়েরই স্বচ্ছন্দ বাংলা অনুবাদ করেছেন কাজুহিরো ওয়াতানাবে। তাঁর অনুবাদ করা এ বই পড়ে মনেই হয় না এটি অনূদিত বই।

প্রথমা প্রকাশন এ বই প্রকাশ করে নিঃসন্দেহে একটি গুরুদায়িত্ব পালন করেছে।

ঢাকায় জাপানি বিমান ছিনতাই ১৯৭৭: জাপানি মন্ত্রীর স্মৃতিকথা

হাজিমে ইশিই

জাপানি থেকে অনুবাদ: কাজুহিরো ওয়াতানাবে

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল: জুলাই ২০১৮, ১৯২ পৃষ্ঠা, দাম: ৩৮০ টাকা।