'বাস্তবতার কোনো একমাত্র অর্থ হয় না'

মৃণাল সেন। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
মৃণাল সেন। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম


গেল মাসেই ছিল চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেনের জন্মদিন। তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের
 ফরিদপুরে। ফরিদপুরের সঙ্গে তাঁর অজস্র স্মৃতি। ২০১৩ সালের ১৪ মে কলকাতার গোর্কি সদনে নেওয়া এই সাক্ষাৎকারে তিনি মেলে ধরেছেন সেই স্মৃতির পসরা। 

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাসির আলী মামুন 

নাসির আলী মামুন: আপনি ফদিরপুরের, না কলকাতার?

 মৃণাল সেন: কী বলব। হা হা হা...। যদি বলি, আবার যদি পুনর্জন্ম লাভ করতে পারতাম। আবার যদি আবার ফিরে গিয়ে বাল্য, কৈশোর বা শৈশবে যেতে পারতাম, যদি আরেক জীবন পেতাম। যদি ঝিলটুলি, কলকাতায় বসবাস করতে পারতাম, তাহলে কেমন হতো! কিন্তু সেটি তো অসম্ভব। সৃষ্টিকর্তা পেছনে যেতে দেন না।

 মামুন: কিন্তু আপনি ভাবেন এখনো?

 মৃণাল: কল্পনা করি। স্বপ্ন দেখি। ভাবতে ভাবতে অন্য পৃথিবীতে চলে যাই। স্মৃতি বড্ড কুহেলিকাময়। ওটা তো কাছে আসতে দেয় না। শুধু ভাবায়।

 মামুন: ভাবতে ভালো লাগে?

 মৃণাল: কার না।

 মামুন: ৪৭ বছর পর জন্মস্থান ফরিদপুরে গিয়ে আপনাকে দেওয়া সংবর্ধনায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় বলেছিলেন, নস্টালজিয়ায় আমি ভুগি না। অতীতের স্মৃতি মনে করতে গিয়ে আমার চোখে জল আসে না।

 মৃণাল: বলেছিলাম নাকি?

 মামুন: হ্যাঁ, শুরুতেই বলেছিলেন ফরিদপুর টাউন থিয়েটারে। সেটি ১৯৯১ সালের ২৫ জানুয়ারিতে। আমি উপস্থিত ছিলাম।

মৃণাল: বেশ মনে আছে আপনাদের। আমার ফরিদপুর ভ্রমণ যে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, সেটা আগে কখনো ভাবিনি। ছবিগুলো দেখছি আর আমাকে কাতর করে দিচ্ছে। সেই ফরিদপুর শহর, কত কাল আগে ফেলে আসা, আমাকে এখনো টানে।

ঈশান স্কুলে থ্রিতে ভর্তি হয়ে একদিন ক্লাসে পায়খানা করে দিয়েছিলাম...হা হা হা। লজ্জায় স্কুলে যাইনি অনেক দিন। আপনি সে সময় উসকে দিলেন। আমার এক এক করে সব মনে পড়ে যাচ্ছে। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ, খেলার মাঠ...। অম্বিকাপুর রেলস্টেশনটা আছে?

মামুন: এখন নেই, কিছু চিহ্ন আছে।

মৃণাল: কুমার নদের ওপর কাঠের সেতু। পাশেই বাজার। বড় বড় লঞ্চ, গয়না নৌকা যাতায়াত করত। পদ্মার ইলিশ বাজারে বিক্রি হচ্ছে। মনে হতো চকচকে জ্যান্ত ইলিশ। সেবার ফরিদপুর গিয়েছিলাম গীতাকে নিয়ে। তার প্রথম ফরিদপুর ভ্রমণ। আগে অনেকবার সে যেতে চেয়েছিল, হয়নি। আমি ঢাকায় এসে নানা অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থেকে ফিরে আসতাম কলকাতায়। ফরিদপুর গিয়ে ছবির মতো মনে পড়তে লাগল। দেখা হলো অনেক পুরোনো মানুষের সঙ্গে। বেঁচে ছিলেন না অনেকেই। আমার দাদা বলেছিলেন, ফরিদপুর গিয়ে অনাথদার (অনাথের আচারের দোকানের প্রতিষ্ঠাতা) সঙ্গে যেন দেখা করে আসি। দেখা হলো তাঁর সঙ্গে। তিনি প্রথমে চিনতে পারেননি আমাকে। তারপর মুহূর্তেই জড়িয়ে ধরলাম। আমার শিক্ষিকা কিরণদির সঙ্গে দেখা। এমন আবহ তৈরি হলো আমার মধ্যে, এক দিনের ভ্রমণে আমি ভুলে যাচ্ছিলাম আমি ফরিদপুরের, নাকি কলকাতার। মানুষের জীবনে কখনো অতীত এসে এমনভাবে উপস্থিত হয়। সবকিছুকে তার প্রিয় ও আপন মনে হয় তাৎক্ষণিকভাবে। অতীতকে আমি মনে করি। কিন্তু নিজেকে দুর্দশাগ্রস্ত হতে দিই না। আমি সিনেমার মানুষ। কাতর হয়ে গেলে শিল্প ক্ষুণ্ন হয়, এটা আমি দেখেছি। চল্লিশে যখন কলকাতায় এলাম, ফরিদপুরে যেতে খুব ইচ্ছে হতো, কিন্তু মেনে নিয়েছিলাম কলকাতাকে।

 মামুন: আপনার চলচ্চিত্রে স্মৃতিকাতরতা আছে। আমি যদি কয়েকটা ডায়ালগ বলি...।

মৃণাল: আমাকে সিনেমা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবেন না। আমি বহুবার বলেছি, লিখেছি। ফরিদপুরেই থাকুন।

 মামুন: মাত্র একটা প্রশ্ন করতে দিন। আপনার ছবিতে বাস্তবতা...সাধারণ জনগণের জীবনের ভেতরকার আলো-আঁধারের বা ন্যায়-অন্যায়ের গল্পগুলো এমনভাবে তীব্র চলচ্চিত্রবোধের ওপর দাঁড় করিয়ে দেন। দর্শকেরা আপনার ছবি দেখতে এসে একটা শ্রেণির বিরুদ্ধে মনে মনে ঘৃণা ছুড়ে হল থেকে বের হয়। এটা আপনার বেশির ভাগ চলচ্চিত্রের কোনো হোমওয়ার্ক করা স্ট্র্যাটেজি কি না?

 মৃণাল: এমন প্রশ্ন করলেন, যেন আমি অভিযুক্ত হই। বিশেষ শব্দ ব্যবহার হলো ‘হোমওয়ার্ক’, এটা নির্দিষ্ট করে কোনো কাজ করি না আমি। তবে হোমওয়ার্ক তো সবাইকে করতে হয়। নিয়ম ও অনিয়ম মেনে একটি সার্থক চলচ্চিত্র তৈরি হয়। সবকিছুকে নিয়ম করে ভাবলে সেটি উত্তীর্ণ হয়ও না। আমি মিডল ক্লাসের। কিন্তু আমার চারপাশের জগতে কী ঘটছে, সেটা আমাকে দেখতে হয়। ভাবতে হয় দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, ধনীদের অবস্থান। শ্রেণি-সচেতন হয়েই আমার অবস্থান থেকে ধীরে ধীরে গল্প তৈরি হয়। যখন সিনেমা তৈরি করি, তখন সব বাস্তবতাই আমার সামনে আসে। ধনীদের এক রকম বাস্তবতা, দরিদ্রদের এক রকম আর মধ্যবিত্তদের আরেক রকম। সবই তো নিজ নিজ অবস্থানে সত্য। বাস্তবতার একমাত্র কোনো অর্থ হয় না, কোনো বিশেষ রূপে থাকে না। একেক শ্রেণির বাস্তবতা সমকালে বিভিন্ন ধরনের হয়। আমি যেহেতু মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে, কাজেই আমার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই সিনেমা তৈরির শিক্ষাটা পেয়েছি।

 মামুন: ফেলে আসা ছোট্ট শহরটার ‘অরোরা টকিজ’-এর সিনেমা দেখার কথা মনে পড়ে?

 মৃণাল: মায়ের সঙ্গে ছবি দেখতে গিয়েছি, সম্ভবত পাঁচ বছর বয়স। সিনেমা হলের ছাদ তখন টিনের ছিল। নির্বাক ছবি, সাদাকালো। কী যেন, নামটা মনে আসছে না। সম্ভবত নায়িকা আর তার বান্ধবী যখন একটা বিশেষ জায়গায় দৌড় দিল, হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। হলের দর্শকেরা সবাই বিরক্ত, আমি দেখলাম নির্বাক ছবিতেই তাদের যেন আনন্দ। কিন্তু ওই যে সিনেমা হলের টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে নায়িকার দৌড় যেন সিম্ফনির সৃষ্টি করল সেদিন। ওই ছোট্ট শিশুটি বুঝে ফেলল চলচ্চিত্রের জন্য শব্দ অপরিহার্য।

যখন রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র ছিলাম, তখন কয়েকবার অরোরায় সিনেমা দেখতে গিয়েছি। কলকাতা থেকে জাঁদরেল অভিনেতাদের ছবি আসত। তখনো কিছু নির্বাক ছবি দেখানো হতো। যাঁদের ছবিতে অভিনয় করতে দেখেছি, পরে ফিল্ম করতে গিয়ে তাঁদের অনেকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ফরিদপুরে রথযাত্রার সময় রথ দেখতে যেতে চাইতাম। মেলার জন্য ছিল আকর্ষণ। বায়না ধরলে আমার মা বলতেন, উল্টোরথ দেখে ফিরে আসার সময় পা উল্টে ভেঙে যায়। শহরের চৌধুরীবাড়ির পাশে রথখোলা হতো। নানা রঙের খেলনা পাওয়া যেত রথমেলায়। মহীম সেন আমার ঠাকুরদা। বাবার নাম দীনেশ সেন। ‘তীর্থ নিবাস’ ছিল আমাদের ফরিদপুরের বাড়ির নাম। ঠাকুরমার নাম তীর্থমণি, তাঁর নামে বাড়ির নাম। বাড়িটা ছিল ঝিলটুলিতে। বাড়ির পেছনে পুকুর ছিল। তখন প্রায় বাড়ির পেছনে একটা পুকুর থাকত। মাঝেমধ্যে ভোরে জেলেরা আসত। পুকুরে মাছ ধরে এক ভাগ আমাদের দিয়ে যেত। শীতের সকালে গাছি এসে খেজুরের রস দিয়ে যেত। রস আর চালের গুঁড়া দিয়ে মা হরেক রকমের পিঠা তৈরি করত। কলেজে পড়ার সময় বাড়ি থেকে বেশ দূরে বন্ধুদের সঙ্গে পদ্মা নদীর পাড়ে বেড়াতে যেতাম। তখন পদ্মা ছিল সমুদ্রের মতো। ইলিশ ধরা দেখে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতাম। কলকাতা থেকে বড় স্টিমার ভেঁপু বাজিয়ে চলে যাচ্ছে গন্তব্যে। এসব চোখে আটকে আছে।

সাতচল্লিশ বছর পর ১৯৯১ সালে ফরিদপুর গিয়ে অনাথদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার বাবা দীনেশ সেনকে মনে পড়ে? গণেশ, কার্তিক, মৃণাল—আমরা তাঁর সন্তান। অনাথ চিনতে পারলেন। সে সময় অনাথের পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানাল আমার স্ত্রী গীতা। সে তার শ্বশুরবাড়িতে এসেছে। আমরা পুকুরে স্নান করতাম। তমিজউদ্দীন খান সাহেব প্রায় এক ঘণ্টা পুকুরের পাড়ে সরষের তেল গায়ে মাখতেন। ঈদের দিনে, মহররমের সময় মুসলমানদের বাড়িতে যেতাম। শহরের চরকমলাপুরের কাছে গরুর গাড়ি ছিল। গারোয়ানদের এক মেয়ে খুব সুন্দর। ছোটবেলায় তাকে আমার ভালো লাগত। খান বাহাদুর ঈসমাইল সাহেবের বাড়িটা ছিল চরকমলাপুরেই। তাঁর বড় মেয়ে লিলির সঙ্গে বেশ ভাব ছিল আমার।

 মামুন: কবি জসীমউদ্‌দীন আপনাদের পরিবারের বন্ধু ছিলেন।

 মৃণাল: আমার বড়দার বন্ধু ছিলেন তিনি। আমাদের সাধুদা। একবার বড়দা তাঁর বন্ধুর একটি কবিতা বাবাকে পড়তে দিলেন। দশ লাইনের কবিতাটি পড়ে বাবা বললেন—ভালো হয়েছে কবিতাটি। কিন্তু অনেক বানান ভুল। সেটি ছিল কবর কবিতার প্রাথমিক খসড়া। বাবা বলেছিলেন, ওকে বাড়িতে নিয়ে আসিস। জসীমউদ্‌দীনকে আমরা সাধুদা বলে ডাকতাম। আমার মা কবিকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। আমাদের বাড়িতে এলে মা তাঁকে না খাইয়ে ছাড়তেন না। আমার ছোট বোন রেবা পাঁচ বছর বয়সে বাড়ির পেছনের পুকুরে ডুবে মারা যায়। খবর পেয়ে জসীমউদ্‌দীন এলেন আমাদের বাড়িতে। আমাদের বললেন, একটা পাটি দিতে। সেটা বিছিয়ে সেই পুকুরপাড়ে বসে অনেক কান্নাকাটি করলেন এবং রেবাকে নিয়ে লিখলেন একটি কবিতা। রেবা সাধুদার খুব আদরের ছিল। বাড়িতে এলে রেবা তাঁর কোলে বসে একবার জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, সাধুদা, ফুল কখন ফোটে। কবি বললেন, রাত্রিতে তুমি যখন ঘুমিয়ে থাকো, তখন ফুল ফোটে। তখন রেবা বলল, আমি তাহলে আজ রাতে ঘুমাব না। দেখব কীভাবে ফুল ফোটে। সাধুদার সেই কবিতাটি পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমি দাদাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাঁরাও বলতে পারেননি। সেবার ফরিদপুরে গিয়ে আমার স্ত্রী গীতা তাঁকে উপহার দেওয়া এক তোড়া ফুল রেবার বেদিতে রেখে এলেন।

 মামুন: সাতচল্লিশের দেশভাগ অনেকে মেনে নিতে পারেনি। আপনিও এর সপক্ষে লিখেছেন।

 মৃণাল: আমাদের সময়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল। হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে বসবাস করছে। ফরিদপুরের সুনাম ছিল। আমি যখন কলকাতায় পড়াশোনা করছি, তখন দাঙ্গা শুরু হয়। এর হাওয়াও আমার ছোট্ট শহরটায় লাগে। হিন্দু-মুসলমানের দূরত্ব তৈরি হতে থাকে সর্বত্র। সাতচল্লিশে আমার জন্ম-শহর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, আমি হলাম সে দেশে বিদেশি, এটা মেনে নেওয়া যায়নি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আবার আমাদের কাছে টেনে ধরল। আমি কখনো হিন্দু-মুসলমানের সংঘাত সমর্থন করিনি।