রাজনৈতিক সংকটে পাকিস্তান

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান

অনাস্থা প্রস্তাবকে পাশ কাটিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আপাতত তাঁর পদচ্যুতি ঠেকাতে পারলেও দেশটির রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতি একদিকে যেমন রাজপথে উত্তাপ ছড়াতে পারে, তেমনি আইনি লড়াইয়ে দেশের জন্য বয়ে আসতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত ফল। বিরোধীরা বলছেন, তাঁরা কোনোভাবেই বর্তমান পরিস্থিতির শেষ না দেখে ছাড়বেন না। খবর রয়টার্স, এএফপি ও আল-জাজিরার।

পাকিস্তান এমনিতেই এখন উচ্চ মুল্যস্ফীতিতে নাস্তানাবুদ। অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি তালেবান নিয়েও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে দেশটি। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের শক্ত ভূমিকা প্রত্যাশিত হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা দেখতে পাচ্ছে না। আবার তালেবানের ভাবাদর্শে পরিচালিত তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানও (টিটিপি) নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে। এমন অবস্থায় নতুন করে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট পারমাণবিক শক্তিধর দেশটিকে আরও বেকায়দায় ফেলেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদে প্রধানমন্ত্রী ইমরানের বিরুদ্ধে বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাবকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যায়িত করে রোববার তা খারিজ করে দেন ডেপুটি স্পিকার কাসিম খান সুরি। আর ইমরানের পরামর্শ মেনে পার্লামেন্ট ভেঙে দেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। এখন স্বাভাবিকভাবেই আগাম নির্বাচনের জন্য দলগুলোর প্রস্তুতি নেওয়ার কথা। সংবিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে বলে জানিয়েও দিয়েছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ফারুক হাবিব।

তবে বিরোধীরা ডেপুটি স্পিকার সুরির সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন। তাঁরা আবেদনে উল্টো ডেপুটি স্পিকারের পদক্ষেপকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যায়িত করে এর প্রতিকার চেয়েছেন। আজ সোমবার এ ব্যাপারে শুনানি হওয়ার কথা। রোববার সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) হয়ে একটি নোটিশ করেন। সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর তাঁরা নজর রাখছেন।

‘পরিণতি হবে ভয়ানক’

ইমরানবিরোধীরা বলছেন, নির্বাচনের ময়দানে নামার ব্যাপারে তাঁরা ভীত নন। কিন্তু ইমরানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সদস্য ডেপুটি স্পিকার সুরির সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছেন না তাঁরা। তাঁদের দাবি, পরাজয় নিশ্চিত জেনেই ইমরানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন সুরি।

অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করার পরপরই বিরোধী পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বলেন, তাঁরা এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় পার্লামেন্টে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন। আইনিভাবেও এর মোকাবিলা করবেন।

পার্লামেন্টে বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লিগের (নওয়াজ) সভাপতি শাহবাজ খানের মতে, তাঁদের আনা অনাস্থা প্রস্তাবকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যায়িত করে খারিজ করে দেওয়ার বিষয়টি চরম বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়। এক টুইটে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘নির্লজ্জভাবে এ সংবিধান লঙ্ঘনের পরিণতি হবে ভয়ানক।’ তবে তিনি এ আশাও করেন, সংবিধান সমুন্নত রাখতে সুপ্রিম কোর্ট নিশ্চয়ই ভূমিকা রাখবেন।
পাকিস্তানের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রাজা খালিদ এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন। তাঁর দাবি, সরকারের আচরণ চূড়ান্তভাবে অসাংবিধানিক। তাঁর ভাষায়, ‘যা ঘটেছে তা কেবল একজন স্বৈরশাসকের জমানায় হওয়া সম্ভব।’

আরও পড়ুন

ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর থেকে শরিক দলগুলো তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করায় প্রথমে বিপাকে পড়েন ইমরান। এরপর নিজ দলেরই একটা অংশ তাঁকে ছেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি প্রতিকূল হয়ে ওঠে তাঁর। অনাস্থা ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ১৭২ ভোট ইমরানের পক্ষে ছিল না। এ কারণে ভোটাভুটি হলে তাঁর ক্ষমতাচ্যুতি অনেকটাই নিশ্চিত ছিল বলে মনে করা হচ্ছিল।

সম্প্রতি পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকাও এমন কথা লিখেছে, ‘ইমরানের বিদায় আসন্ন।’ তবে এ পরিস্থিতিতে অনাস্থা ঠেকাতে নিজের সমর্থকদের রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান ইমরান। অন্যদিকে পার্লামেন্টে স্পিকারের ডায়াসের কাছে জড়ো হয়ে ইমরানের দলের সদস্যরা বিরোধীদের উদ্দেশে স্লোগান দেন, ‘আমেরিকার যারা বন্ধু হয়, তারা পাকিস্তানের দুশমন’। এ অবস্থায় ডেপুটি স্পিকার অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করে দেন। এতে বিরোধী দলের এমপিরা এতটাই অবাক হন যে তাঁদের বেশির ভাগই চেয়ারে স্থাণু হয়ে বসে থাকেন।

আরও পড়ুন

আবার সেনাশাসন?

বিরোধীদের অভিযোগ, ইমরান অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে পারেননি, দুর্নীতিরও মূলোৎপাটন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে ক্ষমতায় থাকার উপযুক্ত নন তিনি। তবে ইমরান বলে আসছেন, তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এরই মধ্যে ওয়াশিংটন এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

বিরোধীদের পাশাপাশি বিশ্লেষকদের একটা অংশেরও ভাষ্য, ২০১৮ সালে পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সমর্থনে ক্ষমতায় এসেছেন ইমরান। এখন তাঁর মাথার ওপর থেকে সামরিক বাহিনীর ছায়া সরে গেছে। যদিও কোনো পক্ষ বিষয়টি স্বীকার করেনি।

আরও পড়ুন

রয়টার্সের এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে সামরিক বাহিনীর জনসংযোগ শাখার প্রধান মেজর জেনারেল বাবর ইফতিখার বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সেনাবাহিনীর কিছু করার নেই।’

১৯৪৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী তাঁর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। জেনারেলরা নানা অসিলায় দেশের শাসনভার হাতে নিয়েছেন। এ উদাহরণ টেনে বিশ্লেষকদের একটা অংশ বলছে, এবারও তেমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

ইতিমধ্যে তথ্য প্রতিমন্ত্রী ফারুক হাবিব এক টুইটে জানান, মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত হলেও ইমরানই প্রধানমন্ত্রী থাকছেন। কিন্তু সমীকরণ এতটা সরল নয়—ভাবছেন অনেকেই।