যেভাবে তিনি ম্যান্ডেলা হয়ে উঠলেন

প্রায় সারা জীবন সাদা-কালোর বৈষম্য ঘোচানোর জন্য লড়াই করেছেন নেলসন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসানে তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণও হয়েছিল। এভাবেই দেশের মানুষকে একসুতোয় বেঁধেছিলেন তিনি। ম্যান্ডেলার মৃত্যুসংবাদে তাঁর বাড়ির সামনে সব বর্ণের মানুষের অভিন্ন শোক যেন তারই সাক্ষ্য দেয় । রয়টার্স
প্রায় সারা জীবন সাদা-কালোর বৈষম্য ঘোচানোর জন্য লড়াই করেছেন নেলসন ম্যান্ডেলা। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসানে তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণও হয়েছিল। এভাবেই দেশের মানুষকে একসুতোয় বেঁধেছিলেন তিনি। ম্যান্ডেলার মৃত্যুসংবাদে তাঁর বাড়ির সামনে সব বর্ণের মানুষের অভিন্ন শোক যেন তারই সাক্ষ্য দেয় । রয়টার্স

রাষ্ট্রীয়ভাবে বর্ণবাদের ভূত দক্ষিণ আফ্রিকার ঘাড় থেকে নেমেছে। কিন্তু মানুষের মনে সাদা-কালোর বিদ্বেষ তখনো প্রচণ্ড। ১৯৯৪ সালে এমনই প্রেক্ষাপটে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রচারণায় ব্যস্ত নেলসন ম্যান্ডেলা।
এরই মধ্যে শ্বেতাঙ্গরা আরেকটি কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জোহানেসবার্গের আলেক্সান্দ্রা এলাকায় একদিন নির্বাচনী সমাবেশে ভাষণ দিতে গেলেন ম্যান্ডেলা। মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি যখন ভাষণ দিচ্ছেন, সমবেত বিশাল জনতা তখন শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে ফুঁসছে।
সমাবেশে মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল ম্যান্ডেলার বক্তৃতা। তাঁর দৃষ্টি গেল সমাবেশ মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক শ্বেতাঙ্গ নারীর দিকে। এরপর সমবেত জনতার উদ্দেশে নরম গলায় বক্তৃতা শুরু করলেন। বললেন, ‘ওই নারীকে দেখুন। আমার যক্ষ্মা হয়েছিল, তাঁর সেবায় আমার জীবন রক্ষা পেয়েছিল।’
ওই নারীকে মঞ্চে আহ্বান জানালেন ম্যান্ডেলা। গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। জনতার উদ্দেশে তিনি বললেন, ১৯৮৮ সালে কেপটাউনের পোলসমুর কারাগারে বন্দী থাকাকালে তাঁর যক্ষ্মা হয়েছিল। ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। সেখানকার সেবিকা ওই নারী পরম মমতায় তাঁর সেবা করেছিলেন।
ম্যান্ডেলার আবেগভরা কণ্ঠে তাঁর সেই দুর্দশাগ্রস্ত জীবনের গল্প শোনার পর কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে এল সমাবেশ। জনতার শ্বেতাঙ্গবিরোধী ক্রুদ্ধ রোষ পরিণত হলো শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ ভ্রাতৃত্ববোধে।
এই হলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। মহান ম্যান্ডেলা।
বর্ণবাদের বিষ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে রক্ষা করতে ম্যান্ডেলার ২৭ বছরের কারাবাসের কথা সবার জানা। জানে দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গদের মিলনে ‘রংধনু দেশ’ দক্ষিণ আফ্রিকা গঠনে তাঁর উদ্যোগের কথা। মাত্র পাঁচ বছর প্রেসিডেন্ট থাকার পর তিনি সরে গিয়েছিলেন সক্রিয় রাজনীতি থেকে। তাঁর মহত্ত্বকে ম্লান করতে পারেনি ক্ষমতার মোহ, যে মোহ শেষ করেছে বিশ্বের আরও অনেক বড় বড় নেতার মহত্ত্ব।
এসব বিষয় ছাড়াও ম্যান্ডেলার মধ্যে অবশ্যই এমন কিছু বিশেষত্ব ছিল, যা তাঁকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। তাঁকে বানিয়েছে সারা বিশ্বের মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র।
ম্যান্ডেলার তিন স্ত্রীর মধ্যে উইনি ম্যান্ডেলার ভূমিকা তাঁর জীবনে অন্য রকম। তাঁর রাজনৈতিক জীবন যখন তুঙ্গে, ফেরারি হয়ে আশ্রয় নিতে হচ্ছে গুপ্ত স্থানে, আটক হয়ে লড়তে হচ্ছে মুক্তির আইনি প্রক্রিয়া বা কারাগারে কাটছে বছরের পর বছর বন্দিজীবন—সেই সময় পরম মমতা আর ভালোবাসা নিয়ে পাশে ছিলেন উইনি। তাঁদের ৩৮ বছরের দাম্পত্য জীবনে ২৭ বছর ম্যান্ডেলাকে কাটাতে হয়েছে বন্দিজীবন। ১৯৯০ সালে ম্যান্ডেলা মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৯৬ সালে উইনির সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
বিচ্ছেদের সময় ম্যান্ডেলা প্রকাশ্যে বলেছিলেন, উইনিকে তিনি কতটা ভালোবাসেন। অথচ কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর একটা রাতও উইনি তাঁর সঙ্গে কাটাননি।
রোবেন দ্বীপের কারাগারে ম্যান্ডেলার সঙ্গে বন্দী ছিলেন রাজনৈতিক সহকর্মী স্ট্রিনি মুডলি। উইনির প্রতি ম্যান্ডেলার ভালোবাসার একটি দৃষ্টান্ত দেন তিনি। মুডলি জানান, ম্যান্ডেলার কক্ষে উইনির একটি ছবি ছিল। ছবিটি সব সময় পরম মমতায় আগলে রাখতেন তিনি। একদিন ম্যান্ডেলার কাছে ছবিটি চাইলেন মুডলি। উদ্দেশ্য, ছবিটি থেকে একটি স্কেচ তৈরি করা।
মুডলিকে ম্যান্ডেলা বললেন, ‘ছবিটি তুমি শুধু দিনের বেলায় নিতে পারো। কিন্তু রাত হওয়ার আগেই আমাকে ফেরত দিতে হবে। রাতে সে আমার সঙ্গে থাকবে।’
৯৫ বছর বয়সে চলে গেলেন ম্যান্ডেলা। দীর্ঘ সংগ্রামী ও বর্ণাঢ্য এই জীবনে যাঁরা তাঁর কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন, তাঁদের কাছে রয়ে গেছে ম্যান্ডেলার মহত্ত্ব ও ভালোবাসার আরও কত না দৃষ্টান্ত! এএফপি।