বৈষম্য থেকেই আসবে মহাবিপদ, আশঙ্কা ধনকুবেরদের
বিশ্বের বহু দেশের রাজপথ এখন বিক্ষুব্ধ জনতার দখলে। নানা দাবিতে, নানা লক্ষ্যে তারা আন্দোলন করছে। এর কোনো কোনোটি চরিত্রের দিক থেকে সহিংস। এসব আন্দোলনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সম্ভাব্য রূপ নিয়ে চলছে নানা জল্পনা। ঠিক এই সময়েই বিশ্বের অন্যতম শতকোটিপতি রে দালিও বৈশ্বিক অর্থনীতি নিয়ে খোলাখুলি এমন কিছু কথা বলেছেন, যা নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করছে সবাইকে।
প্রথমেই শোনা যাক রে দালিওর বক্তব্য সম্পর্কে। গ্রিনউইচ ইকোনমিক ফোরামে আরেক শতকোটিপতি পল টুডোরের সঙ্গে আলাপচারিতায় রে দালিও বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামো নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন। এ প্রশ্নের কারণ হিসেবে তিনি সারা বিশ্বে বেড়ে চলা অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি এই বৈষম্যকে এতটাই গুরুতর হিসেবে শনাক্ত করেছেন যে, এ বিষয়ে তাঁর প্রস্তাব হচ্ছে, ‘মার্কিন রাজনীতিবিদদের উচিত বিদ্যমান সম্পদবৈষম্যকে জাতীয় জরুরি অবস্থা হিসেবে ঘোষণা করে এটি মোকাবিলায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, নয়তো সহিংস বিক্ষোভের জন্য প্রস্তুত থাকা, যেখানে আমরা সবাই পরস্পরকে হত্যায় উদ্যত হব।’
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রিনউইচ ইকোনমিক ফোরামে ১২ নভেম্বর পল টুডোর জোন্স ও রে দালিওর মধ্যে এই আলোচনা হয়। সম্পদবৈষম্য বর্তমানে ভয়াবহ রূপ পেয়েছে উল্লেখ করে রে দালিও বলেন, ‘বিশ্ব উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। পুরো ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে। আর এই ভেঙে পড়ার কারণ হচ্ছে এতে সবার জন্য সমান সুযোগ নেই। এটি এমনভাবে পুনর্গঠন করা জরুরি, যাতে তা আরও ভালোভাবে কাজ করে।’
এবার একটু রে দালিওর তত্ত্ব-তালাশ করা যাক। শুরুতেই বলা হয়েছে, রে দালিও একজন শতকোটিপতি বা বিলিয়নিয়ার। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার। ব্রিজওয়াটার অ্যাসোসিয়েটস নামে একটি হেজ ফান্ডের (একধরনের সমবায়ী বিনিয়োগ তহবিল) ব্যবস্থাপক তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় হেজ ফান্ড ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে, যার পরিমাণ ১৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এই বিনিয়োগ তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশেষ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। গত বছর ব্রিজওয়াটার তহবিলে থাকা নিজের অংশের মুনাফা ও পুরো তহবিলের ব্যবস্থাপক হিসেবে সম্মানী বাবদ পকেটস্থ করেছেন ২০০ কোটি ডলার। বছর বছর এই খাত থেকে তাঁর আয় বেড়ে চলেছে। এই যখন অবস্থা, তখন তিনি নিজের জন্য সোনার ডিম পাড়া ব্যবস্থাটি নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন। বলছেন, ব্যবস্থাটি ঠিকঠাক চলছে না।
কথা হচ্ছে, কোন ব্যবস্থা? এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে ‘পুঁজি’। সারা বিশ্বে রাজ করে চলা এই ব্যবস্থাটি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে প্রশ্ন তোলা ব্যক্তি কি শুধু এই রে দালিও? না, তাও নয়। শীর্ষ ধনীর তালিকায় থাকা অনেকেই তাঁর মতো করে প্রশ্নটি তুলেছেন। বিল গেটস থেকে শুরু করে অনেকেই সারা বিশ্বে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটি নিয়েও।
প্রশ্নটি প্রথম বড় আকারে সামনে আসে ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের সময়। এই দশকের শুরুর দিকে ২০১১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক নগরীর জুকুটি পার্কে তরুণ-যুবারা জড়ো হয়ে এক অভিনব আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, যার নাম তাঁরা দিয়েছিলেন ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’। এই আন্দোলনের মূল স্লোগান ছিল ‘উই আর ৯৯ পারসেন্ট’। এই আন্দোলনই প্রথম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল পুঁজির কেন্দ্রে বিদ্যমান বৈষম্যের মাত্রাটি। আয় ও সম্পদবৈষম্যের প্রধান কারণ হিসেবে ওই আন্দোলন সরাসরি আঙুল তোলে বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটির দিকে। এরপর বিশ্বব্যাপী আয় ও সম্পদবৈষম্যের নানা হিসাব প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা প্রতিবছর নানা পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বিশ্বে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। এসব প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতিবিদেরা দিচ্ছেন নানা পরামর্শও। এ বছর অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়া অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গবেষণার মূলেও রয়েছে এই বৈষম্য নিরসনের বিষয়টি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। লাগামহীন ঘোড়ার মতোই বৈষম্য ছুটেই চলেছে।
সে ক্ষেত্রে রে দালিওর কথাটি নতুন কিছু নয়। নতুন যদি বলতে হয়, তাহলে তা বক্তার সামাজিক অবস্থানের কারণে। একজন শতকোটিপতি, যাঁর সম্পদের কেন্দ্রেই রয়েছে পুঁজিবাদী কাঠামো, তিনিই যখন কাঠামোটি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তখন তা একটু বাড়তি মনোযোগ দাবি করবেই। তাই রে দালিওর বক্তব্য এবং তাঁর শঙ্কা ও প্রস্তাব—এসবকিছুই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার প্রয়োজন পড়ে। পুঁজিবাদী কাঠামো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে রে দালিও পাবলিক কোম্পানিগুলোকে নতুন করে সাজানোর কথা বলছেন। এই পুনর্গঠনের মধ্যেই তিনি মূলত সংকটের সমাধান খুঁজছেন। এ বিষয়ে রে দালিওর সঙ্গে একমত পোষণ করেন পল টুডোর। তাঁর দৃষ্টিতে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তাদের কর্মীদের সঙ্গে আরও উদার ও মানবিক আচরণ করে, তাহলে বৈষম্য কমাতে তা সহায়ক হবে। এ লক্ষ্যে পল টুডোর আরও কয়েকজন ব্যবসায়ীকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘জাস্ট ক্যাপিটাল’ নামের একটি সংগঠন, যার কাজ হচ্ছে কর্মীদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের ন্যায্য আচরণের ভিত্তিতে একটি তালিকা করা। এই তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে সংগঠনটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কর্মীদের সঙ্গে ন্যায্য আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করতে চায়।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিলিয়নিয়ার বা শতকোটিপতিরা পুরো ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়েছে বললেও তা বদলাতে চান না। তাঁরা বরং দান-অনুদান, ঋণ ইত্যাদির সম্প্রসারণের মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থাটি ঘষেমেজে চকচকে করে নতুন বলে হাজির করতে চান। এই চাওয়াটা অস্বাভাবিকও নয়। কারণ, যে ব্যবস্থা তাঁদের শতকোটিপতি বানিয়েছে, তার আগাপাছতলা বদলে দেওয়ার চেষ্টা বা তেমন পরামর্শ তাঁদের কাছ থেকে না আসাটাই বরং স্বাভাবিক। তাই তাঁরা বরং প্রস্তাব করেন, পুঁজিপতিরা যেন তাঁদের হাতটি আরেকটু আলগা করেন, যাতে দরিদ্রদের হাতে চুইয়ে পড়া অর্থের পরিমাণ ততটা বেশি হয়, যতটায় তাঁরা শান্ত থাকে। এই শান্ত রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণটি শুরুতেই রে দালিওর বয়ানে উঠে এসেছে, যখন তিনি বলেন, ‘বৈষম্যকে মোকাবিলা করতে না পারলে তা এক সহিংস পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে।’
এই একই মনোভঙ্গি থেকে আরেক শতকোটিপতি লিয়ন কুপারম্যান পাঁচ পাতার এক খোলা চিঠি লিখেছেন মার্কিন সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেনের কাছে। পুঁজিবাদী কাঠামোকে বদলে একটি কল্যাণ কাঠামোর প্রস্তাব নিয়ে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা করা এলিজাবেথ ওয়ারেনের এক টুইটের প্রত্যুত্তরে তাঁর এই চিঠি। সেখানে তিনি দরিদ্রদের জন্য তাঁর বিভিন্ন সাংগঠনিক তৎপরতার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি একই সঙ্গে ওয়ারেনের প্রস্তাবটিকে ‘রেডিক্যাল’ বলে তার বিরুদ্ধেও মত দিয়েছেন। ওয়ারেনের ধনীদের ওপর উচ্চ কর আরোপের প্রস্তাবের বিপরীতে তিনি ধনীদের দ্বারা আরও কল্যাণমূলক কাজের প্রস্তাব হাজির করেন। অর্থাৎ তিনি বৈষম্য হ্রাসের লক্ষ্যটিকে দান-অনুদানের পর্যায়ে সীমায়িত করতে চান।
এ ক্ষেত্রে রে দালিও অবশ্য প্রস্তাব করেন ক্ষুদ্রঋণের বিস্তৃতির। গ্রামীণ আমেরিকার ইমেরিটাস পরিচালক দরিদ্রদের ঋণের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই সংকটের সমাধান দেখেন। তাঁর পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, তিনি মূলত একটি বিনিয়োগ তহবিলের ব্যবস্থাপক।
পুঁজিবাদী কাঠামোয় প্রতিটি স্তরই সম্পদ ও আয়বৈষম্য তৈরির নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। উৎপাদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরই বৈষম্যের একেকটি উৎপাদন ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। মার্কিন রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে মাদকের ব্যবহার, এ থেকে মৃত্যুহার ইত্যাদি ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। কতটা ধারাবাহিক? যতটা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে আয় ও সম্পদবৈষম্য। বিষয়টা এমন সমাজের নিচের তলার লোকেরা অর্থাভাবে চিকিৎসাসেবা নিতে পারে না বলে সে রোগে ভুগে তার কর্মক্ষমতা হারায়। কর্মক্ষমতা হারানোয়, তার অবস্থান নেমে যায় আরও নিচে। আবার এই অবস্থানের কারণেই তার পক্ষে সন্তানের যথাযথ শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। ফলে পরের প্রজন্মে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাও তার কমতে থাকে। একটা দুষ্টচক্রের মতোই এটা চলতে থাকে।
গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দুটি বিষয় সামনে এসেছে। এর একটি হচ্ছে করপোরেট পুঁজির অতি মুনাফালোভী মনোভাব। অন্যটি শ্রমিক ইউনিয়নগুলো ভেঙে দেওয়া, যার ফলে শ্রমিকদের পক্ষে মজুরি নিয়ে দর-কষাকষি করাটা আর সম্ভব হচ্ছে না। এরই ফল হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে প্রায় দুই দশক ধরে ন্যূনতম মজুরি হার স্থির থাকা, যা চলতি বছর পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে।
এটা সত্য যে, মানুষের সমাজে সর্ব অর্থে বৈষম্য নিরসন প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। তবে এটিকে কমিয়ে আনা সম্ভব। একটি ন্যায়ানুগ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমান পুঁজি যে পথ পাড়ি দিয়ে যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে এর সম্ভাবনাটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না। যে বণ্টনব্যবস্থার পুনর্গঠন এ ক্ষেত্রে আশা দেখাতে পারে, তা নিয়ে এখনো কেউ কিছু বলছে না। একেবারে বলছে না, তা নয়। তবে যারা বলছে, তারা ক্ষমতার ঘনিষ্ঠ কেউ নয়। ফলে তাদের বলায় কিছু হওয়ার নয়। বৈষম্য নিরসনের জন্য ঋণ, দান-অনুদান ইত্যাদি তত্ত্ব বাদ দিয়ে বণ্টনব্যবস্থাটি নিয়ে কথা বলতে হবে রে দালিওসহ সেই সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের, যাঁরা সংকটটি অনুধাবন করতে পারছেন।