করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বৈশ্বিক অর্থনীতি। এর মধ্যে শুরু হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত। মস্কোর ঘাড়ে চেপেছে নানান নিষেধাজ্ঞা। এ ছাড়া চীনের ‘করোনা শূন্য’ নীতি, মুদ্রাস্ফীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বৃদ্ধি অর্থনীতিকে আরও বিপাকে ফেলেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্ব কি আরেকটি অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়ছে?
মন্দা দেখা দেবে কি না, তা অনুমান করা খুবই কঠিন বলে উল্লেখ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক টারা সিনক্লেয়ার। তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, এমনকি অর্থনীতি নিয়ে যাঁরা পূর্বাভাস দেন, তাঁরাও আগেভাগে মন্দার বিষয়ে তেমন কিছু বলতে পারেন না। শুধু মন্দা দেখা দিলেই তা বোঝা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রে গত চার দশকের মধ্যে এই মুহূর্তে মুদ্রাস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কাজ করছে দেশটির ফেডারেল রিজার্ভ। মন্দা এড়াতে সুদের হার ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি।
বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির এই দেশের এমন নাজুক পরিস্থিতি সারা বিশ্বের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে করে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমতে পারে। মাত্র দুই বছর আগেই করোনার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি ৪ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল।
অর্থনৈতিক এমন টানাপড়েনের মধ্যে গত মাসেই মন্দা নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ডুডলে। ফেডারেল রিজার্ভ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা কঠোর করতে বেশি সময় নিচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি। বিল ডুডলে বলেন, অর্থনৈতিক মন্দা ‘অবশ্যাম্ভাবীই’ মনে করা হচ্ছে।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে ফেডারেল রিজার্ভের গড়িমসির বিষয়ে বিল ডুডলের সঙ্গে অনেকটাই একমত যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটির ফুকুয়া স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক ক্যাম্পবেল আর হারভি। আর্থিক মন্দার ঝুঁকি রয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন তিনিও। হারভি বলেন, ‘তারা (ফেডারেল রিজার্ভ) কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়েছে। আর তারা কি এ নিয়ে খুব দেরি করে ফেলেছে? উত্তরটি হচ্ছে, হ্যাঁ।’
মন্দার আশঙ্কা করছেন মার্কিনরাও। গত মাসেই মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি একটি জনমত জরিপ চালায়। দেখা যায়, দেশটির ৮১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মনে করেন, ২০২২ সালে আর্থিক মন্দার ঝুঁকি রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক বিনিয়োগকারী ব্যাংক ও আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রে মন্দার আশঙ্কা ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ।
এদিকে সামনের মাসগুলোতে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত ঘিরে উত্তেজনা বাড়লে এবং মস্কোর ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা এলে, বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। রাশিয়া থেকে এর মধ্যেই জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি বন্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে।
এখন পর্যন্ত রাশিয়া থেকে কয়লা আমদানি বন্ধ করেছে ইউরোপের দেশগুলো। তেল ও গ্যাস আমদানি বন্ধের জন্যও তাদের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে। ইউরোপের মোট গ্যাসের ৪০ শতাংশ আমদানি করা হয় রাশিয়া থেকে। আর তেল আমদানি করা হয় ইউরোপের মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ।
গত বুধবার ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট চার্লস মাইকেল ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন রাশিয়ার তেল ও গ্যাস নিয়ে ‘আগে হোক কিংবা পরে’ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আর এমনটি হলে জ্বালানির দাম বাড়বে। তাল মিলিয়ে বাড়বে পণ্যের দামও।
এদিকে করোনা সামাল দিতে চীনের কঠোর লকডাউন ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ দেশটির অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব ফেলছে। সাংহাইয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম বন্দর রয়েছে। গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এই বন্দর লকডাউনের আওতায় রয়েছে। মালামাল খালাসের অপেক্ষায় কয়েক সপ্তাহ ধরে সেখানে আটকা পড়ে আছে শত শত জাহাজ।
চলতি বছরে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সম্ভাবনা কম বলে মনে করছেন হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির চীনা অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ কার্সটেন হলজ।
আল-জাজিরাকে কার্সটেন হলজ বলেন, ‘মনে হচ্ছে চীন করোনাহীন অবস্থায় সহজে ফিরে যেতে পারবে না। ফলে সরবরাহব্যবস্থার ওপর প্রভাব পড়বে। বাড়বে জিনিসপত্রের দাম। সব মিলিয়ে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় পশ্চিমা দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর চাপ পড়বে।’
পশ্চিমে সুদের হার বৃদ্ধি পরিস্থিতি মন্দার দিকে নিয়ে যাবে কি না, তা মূলত চাহিদার ওপর নির্ভর করে বলে মনে করছেন কার্সটেন হলজ। তাঁর মতে, সামনের দিনগুলোতে চাহিদা ক্রমে বাড়তে পারে। এতে বাড়বে পণ্যের দাম।
এর পরও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য অর্থনৈতিক পূর্বাভাস সামগ্রিকভাবে আশা জাগানোর মতো অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ অনেকে।
গত বুধবার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরে এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে। ২০২৩ সালে তা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০২২ সালে এখন পর্যন্ত বিশ্বে আর্থিক মন্দার আশঙ্কা দেখছেন না হংকংয়ে অবস্থিত নাটিক্সিস ব্যাংকের এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ত্রিন নুয়েন। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, এশিয়ার প্রকৃত সুদের হার কম। এ ছাড়া চীন বাদে অন্য দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। এটা এশিয়ার জন্য সুসংবাদ। এগুলো আগামীতে আর্থিক সংকটের পূর্বাভাস দিতে সহায়তা করবে।
এসব কিছুর পরও বিশ্বজুড়ে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, সুদের হার ও ডলারের মান বেড়ে যাওয়ায় কঠিন আর্থিক অবস্থা এবং চীনের বর্তমান পরিস্থিতি অর্থনীতির গতি কমিয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ত্রিন নুয়েন।