প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধনীদের একজন তিনি। দাতব্য সংস্থা বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতাও বিল গেটস। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বিল গেটস নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। বিপুল কর্মব্যস্ততার মধ্যেও কীভাবে ব্যক্তিজীবনে সুখী হওয়া যায়, তা তুলে ধরেছেন তিনি। এ বিষয়ে ১০ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী জিকিউ।
সুখ কী? সুখ সম্পর্কে নানা ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। একটি সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, মানুষের পরিপূর্ণ তৃপ্ত হওয়ার অবস্থাই হলো সুখ; ইন্দ্রিয়কে যা আনন্দ দেয় অথবা যা নৈতিকভাবে ভালো, তা উপভোগ করা সুখ। আরেকটি সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, আনন্দ অথবা সুখানুভূতিকে তাড়িত করে যে আবেগ, তা অনুভব করার মধ্য দিয়ে যাওয়া বা অভিজ্ঞতা লাভ করা সুখ। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ডানিয়েল কেহনেম্যান বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে যে অভিজ্ঞতা লাভ করছি, তা–ই সুখ।’ তবে আমরা সবাই জানি, সুখের বিষয়টি এর চেয়ে জটিল এবং ভবিষ্যতে আরও অনেকভাবে সুখের সংজ্ঞা আসতে পারে।
যিনি অকপটে বলতে পারেন, তিনি ২৫ বছর বয়সে যতটা সুখী ছিলেন, এখন তার চেয়ে বেশি সুখী। সামনের দিনগুলোতেও তিনি তাঁর সবকিছু নিয়ে সুখী থাকবেন।
সুখের প্রশ্নে অনেকের সুনির্দিষ্ট ধারণা আছে, সুখের অনুভূতি কেমন বা তা কেমন হওয়া উচিত এবং সুখ পেতে কী কী করতে হবে বা কী কী করা যাবে না, তা তাঁরা জানেন। সুখ এমন কিছু, যা আমরা প্রতিদিন, প্রতিটা মুহূর্তে পেতে চাই। কিন্তু আমাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক মানুষই জীবনব্যাপী সুখ পাওয়ার জন্য অনুকূল অবস্থা বজায় রাখতে পারি। সুখী হতে পেরেছেন এমন দাবি করা সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের একজন মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস।
যিনি অকপটে বলতে পারেন, তিনি ২৫ বছর বয়সে যতটা সুখী ছিলেন, এখন তার চেয়ে বেশি সুখী। সামনের দিনগুলোতেও তিনি তাঁর সবকিছু নিয়ে সুখী থাকবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক রেডিট নামের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ‘আস্ক মি এনিথিং’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বিল গেটস সুখ নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁর কাছে একজন জানতে চেয়েছিলেন, তিনি যদি সুখী হয়ে থাকেন, তবে কী কী বিষয় তাঁকে সুখী করেছে। জবাবে বিল গেটস বলেন, ‘হ্যাঁ! আমার বয়স যখন ৩০-এর কোঠায় ছিল, আমি ভাবতেই পারতাম না যে ৬০-এর ঘরে থাকা মানুষও খুব স্মার্ট হতে পারেন বা অনেক মজা করতে পারেন। কিন্তু এখন আমি এর বিপরীত দিকটিই উদ্ঘাটন করেছি। ২০ বছর পর আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তখন আমি বলব, ৮০ বছরেও কতটা স্মার্ট হওয়া যায়।’ অপর এক প্রশ্নের উত্তরে বিল গেটস বলেন, ‘ইদানীং কেউ কেউ আমাকে বলেন, যখন আপনার সন্তানেরা ভালো কিছু করে, তখন তা সত্যিই বিশেষ কিছু হয়ে ওঠে। হ্যাঁ, বাবা হিসেবে আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত। আবার কিছু সময় নিজের জন্য কিছু করা, যেমন আরও বেশি ব্যায়াম করার বিষয়টিও আপনার সুখ বাড়িয়ে দেবে।’
বিল গেটস ব্যাখ্যা করেন, মানুষের অবস্থান ভেদে কীভাবে একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি হয়। নিজের উদাহরণ টেনে এই উদ্যোক্তা বলেন, তিনি যখন ত্রিশের ঘরের যুবক, তখন প্রতিটি বাড়িতে, প্রতিটি ডেস্কে কম্পিউটার দেখতে পাওয়ার বাসনা ছিল তাঁর। এতেই তিনি তখন সবচেয়ে বেশি মজে ছিলেন। কিন্তু যখন বিষয়টি পূর্ণতা পেল, সবার কাছে কম্পিউটার গেল, তখন তাঁকে অন্য কিছু খুঁজে নিতে হয়। বিল গেটসের ভাষায়, ‘২০–এর ঘরে এবং ৩০-এর শুরুর দিকে আমি ছিলাম সফটওয়্যার–পাগল একজন মানুষ। কোনো ছুটি নিতাম না, সাপ্তাহিক বিরতিও নিতাম না। এমনকি বিয়ে করতেও আগ্রহী ছিলাম না। (তবে মেলিন্ডার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সে মনোভাব বদলে গিয়েছিল!)’ বিল গেটস বলেন, তখন তিনি যেটা বেছে নিয়েছিলেন এবং যে পরিশ্রম করেছিলেন, তার ফল এখন পাচ্ছেন। এটা তাঁর সুখী হওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
আপনি হয়তো ভাবছেন, বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি বিল গেটসের সুখী হওয়ার পদ্ধতি আপনার ক্ষেত্রে খাটবে না। কিন্তু তিনি সবার জন্য সহজ চারটি পদ্ধতির কথা বলেছেন, যেগুলো মেনে চললে যে কেউ সুখের খোঁজ পেতে পারেন। এর জন্য তাঁকে কোনো অর্থ খরচও করতে হবে না।
হ্যাঁ! আমার বয়স যখন ৩০-এর কোঠায় ছিল, আমি ভাবতেই পারতাম না যে ৬০-এর ঘরে থাকা মানুষও খুব স্মার্ট হতে পারেন বা অনেক মজা করতে পারেন। কিন্তু এখন আমি এর বিপরীত দিকটিই উদ্ঘাটন করেছি। ২০ বছর পর আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তখন আমি বলব, ৮০ বছরেও কতটা স্মার্ট হওয়া যায়বিল গেটস
বিল গেটসের চার পরামর্শ: ১.নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুন
যেকোনো কাজ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে করুন। কোনো কিছুতে মনস্থির করুন এবং তাতে লেগে থাকুন। আপনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা রক্ষা করুন এবং শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাতে নজর রাখুন। আপনি যদি কিছু করতে চান, তাহলে সে লক্ষ্যে এগিয়ে যান এবং সেটি শেষ করুন। ‘যদি এমন হয়, ওমন যদি হয়’—এসব নিয়ে ভাববেন না। তবে যদি আপনার মনে হয় যে আপনি সঠিক অবস্থানে নেই, তাহলে অবশ্যই আপনি নিজেকে প্রশ্ন করুন, ‘যা আমি চাই, তা কি আমি করছি? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো কী কী?’
২. প্রতিদান দেওয়ার বিষয়ে ভাবুন
আপনি যখন অন্যদের কিছু দেবেন, তখন যা দেবেন তার চেয়ে সব সময় আপনি একটু বেশি ফেরত পাবেন। অন্যদের প্রতি উদার বা মহানুভব হোন। এটি আপনাকে তৃপ্ত হওয়ার অনুভূতি দেবে এবং ভালো রাখবে। এ ছাড়া (অন্যের প্রতি উদারতা) সুখী হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। গবেষণায়ও প্রমাণিত হয়েছে, উদার হওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা সুখী হওয়ার অনুভূতি পাই এবং তা আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
৩. শরীরকে প্রার্থনালয়ের মতো দেখুন
আপনাকে নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। আপনার স্বাস্থ্য, শারীরিক অবস্থার (ব্যায়াম মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও দারুণ উপকারী) প্রতি যত্নশীল হতে হবে। ফলে আপনার বয়স যখন বাড়বে, তখনো আপনি পছন্দের কাজগুলো করতে পারবেন।
সুখী হওয়ার জন্য এবং জীবনে তৃপ্ত হওয়ার জন্য ভালো বোধ করা জরুরি। তাই নিজের শরীরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন। এমন শারীরিক কর্মকাণ্ড করুন, যেগুলো আপনাকে ভালো রাখবে। এমনকি এ ক্ষেত্রে ছোট একটা কাজও বড় পার্থক্য গড়ে দেয়।
৪. পরিবার ও বন্ধুদের জন্য সময় বরাদ্দ রাখুন
কাজকর্মে সাফল্যের কোনো পরিমাপই আপনার পরিবারের বিকল্প হতে পারে না, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের বিকল্প হতে পারে না। তাঁদের অগ্রাধিকারে রাখতে হবে এবং তাঁদের জন্য সময় বরাদ্দ করতে হবে। নিশ্চিত হোন, আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো স্বাস্থ্যকর এবং আপনার জন্য তা ভালো পরিণতি বয়ে আনবে। আপনাকে অবশ্যই এমন একটি তর্কাতীত সীমানা নির্ধারণ করতে হবে, যা আপনাকে আপনার কাজ বা কাজের জায়গা এবং জীবনযাপনে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
বোনাস: রাতের ভালো ঘুম
বিল গেটস একবার বলেছিলেন, তিনি তরুণ বয়সে পর্যাপ্ত ঘুমানোর জন্য সময় পেতেন না এবং কাজ করে গোটা রাত পার করতেন। পরে তিনি বুঝতে পারেন, এভাবে দিনযাপন তাঁকে ক্ষয় করে দিচ্ছে, তাঁর সৃজনীশক্তি কমিয়ে দিচ্ছে এবং স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ কারণে এখন তিনি বিশ্রামের জন্য সময় বের করেন এবং পর্যাপ্ত সময় ঘুমান। এমনকি এটাও তিনি স্বীকার করেছেন যে রাতের খাবারের পর নিজেই থালা-বাটি পরিষ্কার করেন, যা তাঁকে মানসিকভাবে চাপমুক্ত হতে সাহায্য করে এবং রাতের ঘুম ভালো হয়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ হাসান ইমাম