জলবায়ু–যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ বছর

টিকা আসায় করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে আশা জাগছে। আর সেটা হলে আবার আলোচনায় আসবে বিশ্বের অতিগুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু ইস্যু।

কমলা রঙের ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোর গোল্ডেন গেট সেতু। বিশেষজ্ঞদের মত, জলবায়ু পরিবর্তন, তেলের আস্তরণ ও বন উজাড়ের কারণেই সেখানকার আকাশে এমন রং লেগেছে। গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বরছবি: এএফপি
জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর প্রচেষ্টায় ২০২১ সালটা আসলেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, তার একটা ব্যাখ্যা মেলে জাস্টিন রৌলাটের এক বিশেষ লেখায়। তিনি বিবিসির প্রধান পরিবেশ প্রতিবেদক। লেখাটি গতকাল শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছে বিবিসি অনলাইনে। জাস্টিন রৌলাট মোটা দাগে পাঁচটি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।

২০২০ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের আলোচনা চাপা পড়ে গিয়েছিল করোনা মহামারিতে। এখন হাতে এসেছে টিকা। আশা করা হচ্ছে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। ফলে ২০২১ সালে জলবায়ু নিয়ে আলোচনা আবার গতি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর প্রচেষ্টায় ২০২১ সালটা আসলেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বৈশ্বিক উষ্ণতার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বিশ্বকে বাঁচানোর পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে হাতে আছে খুবই সীমিত সময়। এই লড়াইয়ের পথে বছরটা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, তার একটা ব্যাখ্যা মেলে জাস্টিন রৌলাটের এক বিশেষ লেখায়। তিনি বিবিসির প্রধান পরিবেশ প্রতিবেদক। লেখাটি গতকাল শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছে বিবিসি অনলাইনে। জাস্টিন রৌলাট মোটা দাগে পাঁচটি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।

১. গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলন

২০১৫ সালের ঐতিহাসিক প্যারিস সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় আসছে নভেম্বরে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে জড়ো হবেন বিশ্বনেতারা। প্যারিসে প্রথমবারের মতো বিশ্বের সব দেশই কার্যত জলবায়ু ইস্যুতে একমত হয়েছিল। ঘোষণা এসেছিল, সবাই একযোগে কাজ করবে। সমস্যাটা হচ্ছে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ঠিক হয়েছিল, শতাব্দীর শেষে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি শিল্পায়ন-পূর্ব সময়ের ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখবে সবাই। সম্ভব হলে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখা হবে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় ১২ বছরের মধ্যেই উষ্ণতা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়াবে; শতাব্দীর শেষে তা উঠবে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। আশার কথা, প্যারিস চুক্তির আওতায় দেশগুলো পাঁচ বছর অন্তর কার্বন নিঃসরণ কমানোর উচ্চাভিলাষ জানাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সে হিসাবে গ্লাসগো সম্মেলন হতে পারত ২০২০ সালের নভেম্বরে। করোনা পরিস্থিতিতে তা পিছিয়ে যায়। আসছে নভেম্বরের সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ কমানোর চেষ্টা জোরদারের ঘোষণা আসতে পারে।

২. বড়রা সঠিক পথে

ইতিমধ্যে অগ্রগতি দেখেছে বিশ্ব। অপ্রত্যাশিতভাবে বড় ঘোষণাটা এসেছে চীনের কাছ থেকে। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেন, ২০৬০ সাল নাগাদ কার্বন-নিরপেক্ষ হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে তাঁর দেশ। বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ২৮ শতাংশের জন্যই দায়ী চীন।

অবশ্য আগেই এমন ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতি যুক্তরাজ্য। ২০১৯ সালের জুনে প্রথম দেশ হিসেবে তারা কার্বন-নিরপেক্ষ দেশ হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০২০ সালের মার্চে একই ঘোষণা আসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকেও। পরে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ১১০টির মতো দেশ একই পথে হেঁটেছে। শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ কার্বন-নিরপেক্ষ দেশ হওয়ার লক্ষ্য তাদের। জাতিসংঘের হিসাবে, এই দেশগুলো বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের ৬৫ শতাংশের বেশি ও ৭০ শতাংশের বেশি অর্থনীতির প্রতিনিধিত্ব করে। আর জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই অর্থনীতিও কার্বন নিঃসরণ কমাতে বড় ভূমিকা রাখবে।

৩. সস্তায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি

এতগুলো দেশ থেকে কার্বন-নিরপেক্ষ হওয়ার ঘোষণা আসার পেছনে আছে বড় কারণ। নবায়নযোগ্য জ্বালানি এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে সস্তা। বিষয়টা কার্বন নিঃসরণ নিয়ে পুরো হিসাব-নিকাশই পাল্টে দিচ্ছে। অনেক দেশেই এখন জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কম। আগামী কয়েক বছরে বায়ু, সৌরশক্তি ও ব্যাটারি খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। দাম এতটাই কমবে যে সবাই বিদ্যমান কয়লা-গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গুটিয়ে নেবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির খরচটা উৎপাদন খাতের মৌলিক যুক্তিটাকে অনুসরণ করে—যত বেশি উৎপাদন, তত বেশি সস্তা। এর মর্মার্থটা ভেবে নিন। পরিবেশবাদীদের উৎপীড়ন আর সইতে হবে না বিনিয়োগকারীদের। তারা শুধুই অর্থের পেছনে ছুটতে পারবে। আর সরকারগুলো জানে, তাদের নিজস্ব অর্থনীতিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদান বাড়লে, বৈশ্বিকভাবেই জ্বালানি রূপান্তর ত্বরান্বিত হবে। ফলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি আরও সস্তা হবে।

৪. করোনা বদলে দিয়েছে সবকিছু

এত দিন হয়তো ভাবতাম, আমাদের শিকড়টা খুব মজবুত। সেই বিশ্বাসে চিড় ধরিয়েছে করোনাভাইরাস। এখন মনে হচ্ছে, পৃথিবীটা এমনভাবে শেষ পরিণতির দিকে যেতে পারে, যার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই। আবার, করোনায় ভর করে এসেছে বিরাট অর্থনৈতিক ধাক্কা, যা ত্রিশের দশকের মহামন্দার পর সবচেয়ে ভয়ংকর। অর্থনীতির ক্ষত সারতে সরকারগুলো বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়েছে। সুখবরটা হচ্ছে, এমন বিনিয়োগের পথটা খুব সহজ হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী সুদহার ঘুরছে শূন্যের কাছাকাছি, এমনকি নেতিবাচক দিকেও। এই সুযোগ নিচ্ছে ইইউ এবং বাইডেনের নেতৃত্বাধীন নতুন মার্কিন প্রশাসন। তারা অর্থনীতি সচল রাখতে ও কার্বন নিঃসরণ কমাতে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এসব পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য জ্বালানির দাম কমাবে। তারা খুব বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর পণ্যে বাড়তি কর বসানোর ঘোষণাও দিয়েছে। ফলে ওই দেশগুলো সোজা হতে বাধ্য হবে।

৫. পরিবেশবান্ধব ব্যবসায় ঝোঁক

জলবায়ু ইস্যুতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরে বরাবরই জনচাপ থাকে। এর সঙ্গে তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানির পড়তি দাম বিবেচনায় নিচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই পরিবেশবান্ধব হতে সচেষ্ট। এখানে আর্থিক কারণও রয়েছে। কিছুদিন বাদেই তেল-কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সেকেলে হয়ে যাবে। সুতরাং এমন প্রতিষ্ঠানে বা তেলকূপ খননে কেন অর্থ ঢালবেন? কেনই–বা কার্বন-ঝুঁকির বদনাম নেবেন? এসব যুক্তি বাজারে চলছেও বেশ। এ বছরই টেসলার শেয়ারের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। বিশ্বের গাড়ি কোম্পানিগুলোর মধ্যে এটি এখন সবচেয়ে দামি। অন্যদিকে এক্সন কোম্পানির শেয়ারের দাম তলানিতে ঠেকেছে। একটা সময় তারাই ছিল বিশ্বের সব খাতের মধ্যে সবচেয়ে দামি কোম্পানি। ‘ডো জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজ’ থেকে ছিটকে পড়েছে এক্সন।

ডো জোনস ইনডেক্সে স্থান পায় যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩০টি বৃহৎ করপোরেশন।
সার্বিকভাবে, জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর প্রচেষ্টায় আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে সবকিছু হয়ে গেছে, এটা বলার সময় আসেনি। অনেক দেশ উচ্চাভিলাষ নিলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাস্তবসম্মত কৌশল ঠিক করেছে হাতে গোনা কয়েকটি। এ অবস্থায় গ্লাসগো সম্মেলনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, দেশগুলোকে এমন নীতিমালায় সই করানো, যা কার্বন নিঃসরণ কমানোর কাজটা শুরু করাবে এখনই।