হঠাৎ করেই অধিবেশন কক্ষ থেকে একপ্রকার ছুটে বেরিয়ে গেলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। এক পুলিশ কর্মকর্তাকে চিৎকার করে বলতে শোনা গেল, ‘ভয়ংকর সমস্যা হয়েছে!’ এক কোণে দেখা গেল রিপাবলিকান সিনেটর মিট রমনি নিজ দলের কয়েকজন সিনেটরের উদ্দেশে করে চিৎকার-চেঁচামেচি করছেন, ক্ষোভে হাত ছুড়ছেন। তাঁকে বলতে শোনা গেল, ‘আপনাদের কারণেই এমনটা হয়েছে!’
এভাবেই সাংবাদিকের বয়ানে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ে হামলার শ্বাসরুদ্ধকর সময়ের চিত্র। গত বুধবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকদের এই হামলার সময় নিউইয়র্ক টাইমস-এর কংগ্রেস প্রতিবেদক নিকোলাস ফান্দোস ও এমিলি কচরান এবং চিত্রগ্রাহক এরিন স্কাফ ঘটনাস্থলে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস গত বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
সিনেটরের ভয়ার্ত চিৎকার, ‘গুলি’: নিকোলাস ফান্দোস
সবকিছুই যেন থমকে গেল। ১০ সেকেন্ডে সিদ্ধান্ত নিলাম ছুটে বেরিয়ে যাব, নাকি আটকা পড়ব। থেকে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। যা-ই ঘটুক, আমি সিনেটরদের ওপর চোখ রাখতে চেয়েছিলাম। সম্পাদককে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠালাম, ‘সিনেট লকডাউন করা হয়েছে।’
একপর্যায়ে ডেমোক্র্যাট সিনেটর প্যাট্রিক লিহিকে দেখা গেল আনাড়ি হাতে ছবি তুলতে। একটি বিকট শব্দ শুনে আরেক ডেমোক্র্যাট সিনেটর অ্যামি ক্লবচারকে ভীত কণ্ঠে বলতে শোনা গেল, ‘গুলি।’ বাইরে তখন সতর্ক ঘণ্টা বেজে চলেছে। আর সিনেট কক্ষে দমবন্ধ পরিবেশ। হঠাৎ পুলিশ কর্মকর্তারা আইনপ্রণেতাদের ঠেলে পেছনের দরজার দিকে নিতে লাগলেন। প্রেস বেলকনিতে (সাংবাদিকদের জন্য নির্ধারিত স্থান) আমার কাছেই একজন বলে উঠলেন, ‘আমাদের কী হবে?’
আমি আমার ল্যাপটপটা বগলদাবা করে কয়েকজন সাংবাদিককে একপ্রকার ঠেলেই নিচে চলে গেলাম। সেখানে একজন পুলিশ কর্মকর্তা দুটি দরজা একা আগলে রেখেছেন। এগুলো তৈরি করা হয়েছে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার পর। অনেকটা দুর্গের দরজার মতোই। বাঁয়ে দেখলাম সিনেটররা সরু এক গলিপথে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ওই গলি ক্যাপিটল ভবনের প্রাঙ্গণের সঙ্গে যুক্ত। রিপাবলিকান সিনেটর ৭৮ বছর বয়সী মিচ ম্যাককনেলকে (সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা) একপ্রকার কাঁধে তুলেই সরিয়ে নিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আর ডেমোক্র্যাট সিনেটর চাক শুমারকে (সিনেটে বিরোধী দলের নেতা) ঘাড় চেপে মাথা নিচু করিয়ে সরিয়ে নেন তাঁর দেহরক্ষীরা।
আমরা ওই কক্ষে প্রায় চার ঘণ্টা আটকে ছিলাম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আমাদের অবস্থান কাউকে জানাতে মানা করেছিলেন। হামলাকারীদের হটানোর পরই আমরা বের হতে পেরেছি। আমাদের সঙ্গে বেরিয়েছেন কংগ্রেসের সেই কর্মীরা, যাঁরা দুটো মেহগনি কাঠের বাক্সে সংরক্ষিত ইলেকটোরাল কলেজ ভোটগুলো আগলে রেখেছিলেন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশন আবার শুরু হয়। তা শেষ হতে হতে ভোর হয়ে গেল। আমি বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, সব এলোমেলো। বেঞ্চগুলো উল্টে পড়ে আছে। সিনেট অধিবেশন কক্ষে কোমল পানীয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অধিবেশন কক্ষে সিনেটরদের আসনগুলোর একটা জায়গায় কয়েকটি সিরিঞ্জ আর একটা ডিফিব্রিলেটর (হৃদ্যন্ত্র আবার সক্রিয় করতে বৈদ্যুতিক শকের সরঞ্জাম) পড়ে থাকতে দেখলাম। কাকে এই চিকিৎসা দিতে হয়েছে, ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এলাম আমি।
আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল: এরিন স্কাফ
ক্যাপিটল ভবনের প্রথম তলা থেকে হামলাকারীদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম আমি। ঘটনা কী জানতে আমি নিচে গেলাম। তবে ততক্ষণে তারা ওপরে উঠে আসতে শুরু করেছে। যে কক্ষে সিনেটররা বৈঠক করছিলেন, তার ঠিক বাইরেই তাঁরা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। এমনকি ওই কক্ষে ঢুকতে দরজার সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করলেন যেন তাঁরা। আমি হতভম্ব হয়ে সব দেখছিলাম। ভাবছিলাম, অল্প কয়েকজন বিক্ষোভকারী হয়তো কোনোভাবে ক্যাপিটল ভবনে ঢুকে পড়েছেন।
কিন্তু নিচে তাকিয়ে আমার ভুল ভাঙল।
হাজার হাজার মানুষ এদিক-সেদিক ছুটছে, চিৎকার করছে। একদলকে দেখলাম পডিয়াম তুলে একদিক থেকে আরেকদিকে যাচ্ছে। এসব ঘটনার কয়েকটি ছবি তুললাম। নিচে দরজার দিকে গিয়ে দেখি, মাত্র একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে শত শত হামলাকারীর সঙ্গে যুঝতে হচ্ছে। বেশিক্ষণ টিকতে পারলেন না তিনি। বিক্ষোভকারীরা ঢুকে পড়লেন। দৌড়ে ওপরে উঠে এলাম আমি। হঠাৎ দু-তিনজন মানুষ এসে আমাকে ঘিরে ধরলেন। আমি কী করি, জানতে চাইলেন। আমার পরিচয়পত্রে নিউইয়র্ক টাইমস-এর নাম দেখে তাঁরা আরও খেপে উঠলেন। আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন, ক্যামেরা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। সাহায্য পেতে আমি তখন চিৎকার করছিলাম। কিন্তু কেউ এগিয়ে এলেন না। মৃত্যুভয় চেপে বসল আমার। হামলাকারীরা আমার কাছ থেকে একটা ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে লেন্স ভেঙে চলে গেলেন।
এরপর যেন আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। কী করব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। দৌড়ে প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির কার্যালয়ে গেলাম। কিন্তু সেখানেও তাণ্ডব চলছিল তখন। বেরিয়ে ন্যাশনাল মলের দিকে যেতেই একটি দলকে দেখলাম, অভিষেক মঞ্চ ঢেকে দিতে। কাছেই একটা জায়গায় ক্যামেরা লুকিয়ে রাখলাম। এরপর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মুঠোফোনে ছবি-ভিডিও ধারণ করতে লাগলাম। আমার কাছেই একজনকে বলতে শুনলাম, ‘গৃহযুদ্ধের শুরু এখান থেকেই।’
ঠিক ওই মুহূর্তে পুলিশকে পেপার স্প্রে, কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে দেখলাম। ছুটে তৃতীয় তলায় উঠে একটা জায়গায় লুকালাম। এরপর আমার স্বামীকে ফোন করলাম। তিনি আমাকে শান্ত থাকতে এবং নিরাপদ একটা জায়গায় লুকাতে বললেন। কিন্তু পারলাম না। পুলিশ আমাকে ধরে ফেলল।
তাদের বললাম, আমি ফটোসাংবাদিক, হামলাকারীরা আমার পরিচয়পত্র ও পাস ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু তারা বিশ্বাস করল না। বন্দুক তাক করে চিৎকার করে আমাকে শুয়ে পড়তে বলল। আমি শুয়ে পড়লাম। ঠিক ওই মুহূর্তে পরিচিত দুজন ফটোসাংবাদিক ছুটে এসে বললেন, ‘তিনি সাংবাদিক।’ এরপর পুলিশ কর্মকর্তারা আমাদের দ্রুত সেখান থেকে সরে যেতে বললেন।
বাইরে তখন বিকট শব্দ: এমিলি কচরান
বেলা সোয়া দুইটার কিছু পরই প্রতিনিধি পরিষদের অধিবেশন কক্ষের সহকারীরা আমাদের সতর্ক করলেন। তাঁরা আমাদের কোথাও আশ্রয় নিতে বললেন। প্রতিনিধি পরিষদের ডেমোক্র্যাট সদস্য (সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা) স্টেনি হোয়েরসহ অন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের সরিয়ে নিতে দেখলাম। এক পুলিশ কর্মকর্তাকে বলতে শুনলাম, ‘ক্যাপিটল ভবনে কিছু মানুষ ঢুকে পড়েছে। সবাই এই কক্ষেই থাকুন, শান্ত থাকুন।’
কিন্তু আইনপ্রণেতারা শান্ত থাকতে পারেননি। তাঁরা চিৎকার-চেঁচামেচি করছিলেন। ততক্ষণে বাইরে কাঁদানে গ্যাস ছোড়া শুরু হয়ে গেছে। এক পুলিশ কর্মকর্তাকে বলতে শুনলাম, সবাই নিজ নিজ ডেস্ক কিংবা চেয়ারের নিচ থেকে গ্যাস মাস্ক বের করে পরে নিন। সাংবাদিকদেরও গ্যাস মাস্ক সরবরাহ করা হলো। বাইরে তখন বিকট শব্দ হচ্ছে। আত্মরক্ষার জন্য আমরা সবাই শুয়ে পড়েছিলাম।
পুলিশ কর্মকর্তারা বড় ও ভারী একটি কাঠের সিন্দুক পরিষদের অধিবেশন কক্ষের মূল দরজার সামনে এনে রাখলেন। কিছু আগে এই দরজা দিয়েই বেরিয়ে গেছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স।
আমি আমার ল্যাপটপ, ফোন আর গ্যাস মাস্ক নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দরজার দিকে গেলাম। কিন্তু চিৎকার করে কেউ আমাদের শুয়ে পড়তে বলল।
একটা চেয়ারের আড়াল থেকে দেখলাম, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন সদস্য কাঠের ওই সিন্দুকের আড়াল থেকে দরজার দিকে বন্দুক তাক করে রয়েছেন। কী ঘটতে যাচ্ছে, আমি বুঝতে পারছিলাম না।