২০২০ সালের শুরুর দিকেই বিশ্ব থমকে গিয়েছিল মহামারির কবলে পড়ে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে দেশে লকডাউন দেওয়া হয়, আরোপ করা হয় চলাচলের বিধিনিষেধ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি শুরু হয়ে যায় কার্যকর ও নিরাপদ টিকা উদ্ভাবনের চেষ্টাও। বছরের শেষ দিকে এসে কয়েকটি টিকা আশার আলোও দেখিয়েছে। তবে টিকাকে রাজনীতির বাইরে রাখা যায়নি। ব্যক্তিস্বার্থ, বিশ্বমঞ্চে প্রভাব বিস্তারসহ নানা বিষয় জড়িয়ে গেছে করোনার টিকার সঙ্গে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ধনী দেশগুলোর টিকা কেনার ধুম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য অনুসারে, বিশ্বজুড়ে করোনার ২৩৩টি টিকা উদ্ভাবনের কাজ চলছে। এর মধ্যে মানবদেহে পরীক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে ৬১টি টিকা। এসব টিকার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজার ও মডার্নার দুটি টিকা, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথভাবে উদ্ভাবিত টিকা, রাশিয়ার গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের টিকা স্পুতনিক–ভি, চীনের সিনোভ্যাক ও সিনোফার্মের টিকা সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে।
এই টিকাগুলোর মধ্যে ফাইজারের টিকাটি এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমোদন পেয়ে গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও টিকাটি শর্ত সাপেক্ষে বাজারজাত করার অনুমতি দিয়েছে। আর বছরের শেষ দিনে এসে, গত ৩১ ডিসেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও ফাইজারের এই টিকা ব্যবহারে সম্মতি জানিয়েছে। জার্মানির জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেক টিকাটি উদ্ভাবনে সহযোগিতা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ মডার্নার টিকাও জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। এর বাইরে রাশিয়া ও চীনে স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত টিকার প্রয়োগও শুরু হয়েছে। বেলারুশেও শুরু হয়েছে রাশিয়ার টিকার প্রয়োগ। বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশ কিনেছে চীনের টিকা। এ ছাড়া ভারতও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবিত ও দেশটির সেরাম ইনস্টিটিউটে প্রস্তুতকৃত টিকার অনুমোদন দিয়েছে গতকাল শনিবার।
কোন টিকা কত দিনে উদ্ভাবন
চাইলেই নতুন একটি টিকা উদ্ভাবন করে ফেলা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন বিস্তর গবেষণা, ব্যাপক পরিসরে পরীক্ষা। করোনাভাইরাসের এক শতাব্দী আগে পৃথিবী নাকাল হয়ে পড়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু মহামারিতে। ওই মহামারিতে মাত্র দুই বছরে প্রাণ গিয়েছিল প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের। কিন্তু বিজ্ঞানীদের জোর চেষ্টা সত্ত্বেও স্প্যানিশ ফ্লুর টিকা উদ্ভাবনে লেগে গিয়েছিল ২৫ বছর। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, স্প্যানিশ ফ্লুর টিকা বিজ্ঞানীরা আনতে পেরেছিলেন ১৯৪২ সালে।
তবে সংক্ষিপ্ত সময়ে টিকা উদ্ভাবনের দিক থেকে এশিয়ান ফ্লু ও হংকং ফ্লুর টিকা এখনো সবার আগে রয়েছে। ১৯৫৭ সালে দেখা দেওয়া এশিয়ান ফ্লু ১১ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে চেষ্টা শুরু করে জুনেই, অর্থাৎ পাঁচ মাসের কম সময়ে এই ফ্লুর টিকা উদ্ভাবন করেছিলেন বিজ্ঞানীরা।
স্প্যানিশ ফ্লুর টিকা উদ্ভাবনে লেগে গিয়েছিল ২৫ বছর। এশিয়ান ফ্লুর টিকা উদ্ভাবন করেন বিজ্ঞানীরা পাঁচ মাসের কম সময়ে। আর করোনার টিকা উদ্ভাবনে লেগেছে প্রায় ১১ মাস। তবে ১৭ বছরেও উদ্ভাবন সম্ভব হয়নি সার্সের টিকা। এইচআইভি/এইডসের টিকা নিয়ে গবেষণা চলছে ৩৯ বছর ধরে। ইবোলার টিকা উদ্ভাবন হয়েছে ৪৩ বছরের গবেষণায়।
১৯৬৮ সালে দেখা দেওয়া হংকং ফ্লু মহামারিতে ১০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। এই ফ্লুর টিকাও বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছিলেন পাঁচ মাসের কম সময়ে। সোয়াইন ফ্লুর টিকাও ছয় মাসে উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে।
২০০৩ সালে ছড়িয়ে পড়া সার্স রোগের টিকা আজ পর্যন্ত উদ্ভাবন প্রক্রিয়ায় রয়ে গেছে। এর মধ্যে কেটে গেছে ১৭ বছর। এইচআইভি/এইডসের টিকা নিয়ে ৩৯ বছর ধরে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। এখনো সেই কাজ চলমান রয়েছে। ইবোলার টিকা উদ্ভাবন হয়েছে ভাইরাসটি শনাক্ত হওয়ার ৪৩ বছর পর, ২০১৯ সালে। মার্সের টিকা নিয়ে গবেষণা চলছে আট বছর ধরে। সেদিক থেকে স্প্যানিশ ফ্লুর পর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সবচেয়ে প্রাণঘাতী মহামারি হলেও তুলনামূলক কম সময়ে এর টিকা চলে এসেছে।
টিকার প্রতিযোগিতা
করোনা মহামারির শুরু থেকেই টিকা উদ্ভাবনের তোড়জোড় শুরু হয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে। তবে মানবহিতৈষী এই কাজে জড়িয়ে যায় রাজনীতি। রাশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশ সবার আগে করোনার টিকা আনার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। রাশিয়া তো ঘোষণাই দিয়ে বসে, করোনার প্রথম টিকা আনবে তারাই। এরই ধারায় বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে গত আগস্টের গোড়ার দিকে রাশিয়ার কর্তৃপক্ষ দেশটির গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের স্পুতনিক–ভি টিকার অনুমোদন দেয়। যদিও সে সময় টিকাটির মানবদেহে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষাই শুরু হয়নি। এরপর অক্টোবরে দেশটি অনুমোদন দেয় দ্বিতীয় একটি টিকার। এই টিকা উদ্ভাবন করেছে সাইবেরিয়ার ভেক্টর ইনস্টিটিউট। অথচ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টিকাটির মানবদেহে প্রাথমিক পরীক্ষা সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন উদ্ভাবকেরা।
এসব কারণে রাশিয়ার উদ্ভাবিত টিকা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর গবেষকেরা দাবি করেন, সবার আগে টিকা উদ্ভাবন করতে গিয়ে রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা হয়তো গবেষণা–প্রক্রিয়া সংক্ষেপিত করেছেন। আবার অনেক সমালোচক মন্তব্য করেন, রাশিয়া হয়তো বিশ্বমঞ্চে প্রভাব বিস্তারের অস্ত্র হিসেবে করোনার টিকাকে বেছে নিয়েছে।
অবশ্য এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন রাশিয়ার গবেষকেরা। পরবর্তী সময়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী ‘ল্যানসেট’–এ স্পুতনিক–ভি টিকার মানবদেহে পরীক্ষার ফলাফল–সংক্রান্ত গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, এই টিকার পরীক্ষায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে তাঁর এক মেয়েও অংশ নিয়েছেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও এএফপির খবর অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার সঙ্গে স্পুতনিক–ভি মিলিয়ে পরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছেন গবেষকেরা। এ ছাড়া রাশিয়ার এই টিকা প্রতিবেশী বেলারুশেও সরবরাহ করা হয়েছে।
উচ্চ আয়ের দেশগুলো কেনাকাটার ধুম লাগিয়ে টিকার তাকগুলো খালি করে ফেলেছে।
বসে নেই চীনও। তাদের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান টিকা উদ্ভাবনে একযোগে মাঠে নামে। এর মধ্যে সিনোভ্যাক ও সিনোফার্ম অন্যতম।
তবে টিকা নিয়ে মূল প্রতিযোগিতাটা শেষ পর্যন্ত তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ে। এগুলো হলো ফাইজার, মডার্না ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা। মানবদেহে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষায় টিকার কার্যকারিতার আংশিক ফলাফল নিয়ে তিন প্রতিষ্ঠানের পরপর ঘোষণাই তার প্রমাণ। গত নভেম্বরে প্রথমে ফাইজার ঘোষণা দেয় তাদের টিকাটি ৯০ শতাংশ কার্যকর। এরপর মডার্না ঘোষণা দেয়, তাদের টিকা ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ কার্যকর। তার পরপরই ফাইজার আবার ঘোষণা দেয়, তাদের টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর। পরে মডার্না জানায়, তাদের টিকা পরীক্ষায় ৯৪ দশমিক ১ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছে।
এদিকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা জানিয়েছে, তাদের টিকাটি ৬২ থেকে ৯০ শতাংশ কার্যকর। এ ক্ষেত্রে প্রথম ডোজ অর্ধেক মাত্রায় এবং পরের ডোজ পূর্ণ মাত্রায় দিলে কার্যকারিতা পাওয়া গেছে ৯০ শতাংশ। তবে দুই ডোজ টিকা পূর্ণ মাত্রায় দিলে কার্যকারিতা দেখা গেছে ৬২ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত।
ফাইজারের করোনার টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর। মডার্নার টিকা কার্যকর ৯৪ দশমিক ১ শতাংশ। আর অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ৬২ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর। ফাইজারের টিকাটি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। এই টিকা ব্যবহারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সম্মতি জানিয়েছে।
কার্যকারিতার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ায় প্রতিযোগিতা থেকেও কিছুটা পিছিয়ে যায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটি। সামনে চলে আসে ফাইজার ও মডার্নার টিকা। গত ২ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ফাইজারের টিকা জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োগের অনুমোদন দেয় যুক্তরাজ্য। ৮ ডিসেম্বর দেশটিতে টিকা দেওয়া শুরু হয়। এর তিন দিনের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদন পায় টিকাটি। তারপর শুরু হয় দেশে দেশে ফাইজারের টিকার অনুমোদন। তবে এই টিকা যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদন পাওয়ার কয়েক দিন পর মডার্নার টিকাও অনুমোদন পেয়ে যায়।
টিকা উদ্ভাবনের দৌড়ে এগিয়ে যাওয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিবেচনায়ও চলে আসে এই তিন টিকা। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে সংস্থাটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সৌম্য স্বামীনাথান বলেন, তাঁরা প্রথমে ফাইজারের টিকার তথ্যগুলো যাচাই করবেন। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসার পর তাঁরা মডার্না ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার বিষয়ে ভাববেন। সে অনুসারে গত ৩১ ডিসেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ফাইজারের টিকা ব্যবহারে সম্মতির কথা জানায়।
টিকা নিয়ে রাজনীতি
টিকা নিয়ে দেশে দেশে যে রাজনীতি হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্র। গত নভেম্বরের শেষ দিকে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘নিউইয়র্ক টাইমস’–এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, করোনার টিকা দিয়ে নির্বাচনের বৈতরণি পার হতে উঠেপড়ে লেগেছিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর প্রশাসনের উদ্যোগে মডার্না কেন্দ্রীয় সরকারের সহযোগিতা ও তহবিলও পেয়েছিল। তবে ফাইজারের প্রধান নির্বাহী আলবার্ট বৌরলা নিজের প্রতিষ্ঠান, বায়োএনটেক ও তাদের উদ্ভাবিত টিকাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন।
ধনী দেশগুলোর টিকা কেনার ধুমের পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। কারণ, তারা নিজেদের পুরো জনগোষ্ঠীর জন্য টিকা কিনে ফেলছে; যে সময় অন্য দেশগুলোয় সংক্রমণের সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোর টিকার তাৎক্ষণিক প্রয়োজন।
‘নিউইয়র্ক টাইমস’–এর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ফাইজারের প্রধান নির্বাহী আলবার্ট বৌরলার আশঙ্কা ছিল, তাঁদের উদ্ভাবিত টিকাটির মানবদেহে পরীক্ষার ফলাফল হয়তো আশাব্যঞ্জক হবে না। এ কারণে তিনি টিকার নিরাপত্তা ও কার্যকারিতার ফলাফল প্রকাশের তারিখ পিছিয়ে দেন। অথচ ট্রাম্প অপেক্ষায় ছিলেন নির্বাচনের আগেই এই বড় সুখবরটা দিয়ে ভোট টানবেন তিনি। শেষে দেখা গেল, নির্বাচনে জো বাইডেনের জয় নিশ্চিত হওয়ার পরপরই ফাইজারের ঘোষণাটি এল।
রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চাইলেও আলবার্ট বৌরলা তা এড়াতে পারেননি। তাঁরই প্রতিশ্রুতির কারণে এমনটা করার সুযোগ পেয়েছেন ট্রাম্প। বৌরলা ঘোষণা দিয়েছিলেন, অক্টোবরের শেষেই তিনি টিকা পরীক্ষার ফলাফল জানাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফাইজার ও মডার্না তা না করায় ট্রাম্প দাবি করেছেন, তাঁকে নির্বাচনে হারাতেই টিকা পরীক্ষার ফলাফল নির্বাচনের পরে জানিয়েছে ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘পলিটিকো’য় প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে মন্তব্য করা হয়েছে, জাতীয়তাবাদ, স্থানীয় রাজনীতি, আর্থিক মুনাফা এবং স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার তাগিদসহ নানা বিষয় জড়িয়ে গেছে করোনার টিকার সঙ্গে। চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত টিকা পররাষ্ট্রনীতির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে।
ধনী দেশগুলোর টিকা কেনার ধুম
বিশ্বের সবার জন্য করোনার টিকা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রায় সব বিশ্বনেতাই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। উল্টো ধনী দেশগুলো নিজেদের জনসংখ্যার কয়েক গুণ বেশি ডোজ কিনে রাখছে।
পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স নামের একটি জোট সম্প্রতি জানিয়েছে, ধনী দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ। কিন্তু তারা মোট চাহিদার ৫৩ শতাংশ টিকা কিনে রেখেছে। এতে স্বল্প আয়ের প্রায় ৭০টি দেশ তাদের জনগোষ্ঠীর প্রতি ১০ জনে একজনকে টিকা দিতে পারবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে পরিমাণ টিকা কিনেছে, তাতে এই জোটের দেশগুলোয় প্রত্যেক মানুষকে দুবার করে টিকা দেওয়া যাবে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিককে দিতে পারবে চার ডোজ করে টিকা। কানাডা যে পরিমাণ টিকা কিনেছে, তাতে দেশটির প্রতিজন নাগরিককে ছয় ডোজ করে টিকা দেওয়া যাবে।
মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, দাতব্য সংস্থা অক্সফামের মতো সংগঠন নিয়ে গড়ে উঠেছে পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স জোটের নেটওয়ার্ক। এই জোট বলেছে, মডার্নার উদ্ভাবিত টিকাটির শতভাগ ডোজ কিনে নিয়েছে ধনী দেশগুলো। এসব দেশ ফাইজারের টিকারও ৯০ শতাংশ কিনে ফেলেছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা অবশ্য উন্নয়নশীল বিশ্বেও তাদের টিকা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটি, ইউনিসেফ ও বিজ্ঞানবিষয়ক বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান এয়ারফিনিটি বিভিন্ন দেশের টিকা কেনার চুক্তি সংগ্রহ করেছে। এসব চুক্তি বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি ‘নিউইয়র্ক টাইমস’–এর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, বেশির ভাগ দরিদ্র দেশ ২০২১ সালে নিজেদের জনগোষ্ঠীর সর্বোচ্চ ২০ শতাংশকে টিকা দিতে পারবে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে পরিমাণ টিকা কিনেছে, তাতে এই জোটের দেশগুলোয় প্রত্যেক মানুষকে দুবার করে টিকা দেওয়া যাবে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র প্রতিজন নাগরিককে দিতে পারবে চার ডোজ করে টিকা। কানাডা যে পরিমাণ টিকা কিনেছে, তাতে দেশটির প্রতিজন নাগরিককে ছয় ডোজ করে টিকা দেওয়া যাবে।
এ ব্যাপারে ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আন্দ্রেয়া টেইলর বলেন, উচ্চ আয়ের দেশগুলো কেনাকাটার ধুম লাগিয়ে টিকার তাকগুলো খালি করে ফেলেছে।
অবশ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভ্যাক্স কর্মসূচির আওতায় টিকা সংগ্রহের চেষ্টা করছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, এই কর্মসূচির আওতায় এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ২০০ কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, কোভ্যাক্স কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী ১৯০টি দেশেই ২০২১ সালের প্রথমার্ধে টিকা সরবরাহ সম্ভব হতে পারে। এসব টিকা দেওয়া হবে সংক্রমণের সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে।
‘নিউইয়র্ক টাইমস’ জানায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ব্রুস আইলওয়ার্ড বলেছেন, ধনী দেশগুলোর টিকা কেনার ধুমের পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। কারণ, তারা নিজেদের পুরো জনগোষ্ঠীর জন্য টিকা কিনে ফেলছে, যে সময় অন্য দেশগুলোয় সংক্রমণের সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোর টিকার তাৎক্ষণিক প্রয়োজন।