মিসরের একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। দেশটির রাজধানী কায়রোর উত্তরাঞ্চলের একটি বেসরকারি হাসপাতাল। সেখানে একটি রোবট প্রথমে এক রোগীর থুতনিতে হাত রাখছে। এরপর রোবটটি একটি হাত প্রসারিত করে মুখের ভেতর থেকে নমুনা সংগ্রহ করছে। মূলত করোনাভাইরাসে সংক্রমিত সন্দেহভাজন রোগীর নমুনা সংগ্রহে এই রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে। কাইরা-০৩ নামের রোবটটি দিয়ে শুধু করোনার পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহই নয়, রক্ত পরীক্ষা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ও এক্স-রেও করা যায়।
গত বছর এমন প্রযুক্তির ব্যবহার বিশ্বজুড়েই বেড়েছে। করোনাভাইরাসের মহামারিতে নাকাল বিশ্ব বাধ্য হয়েছে প্রযুক্তির ব্যবহারে। তার ছোঁয়া লেগেছে অপেক্ষাকৃত কম উন্নত দেশগুলোয়ও। যার প্রমাণ মিসরের ওই হাসপাতাল। সেখানকার এক প্রযুক্তিবিদই রোবটটির নকশা করেছেন।
চীনসহ বিভিন্ন দেশে যখন করোনার বিস্তার ব্যাপক আকার ধারণা করেছিল, তখন ‘মানুষের স্পর্শহীন’ পণ্য সরবরাহের চাহিদা বেড়ে যায়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ‘স্পর্শহীনভাবে’ পণ্য সরবরাহ কেন্দ্র খোলে দেশে দেশে। এর একটি পরিসংখ্যান দেওয়া যেতে পারে। আইএনসি ডটকমের খবরে বলা হয়েছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রে এই পদ্ধতিতে পণ্য সরবরাহের চাহিদা গত বছর বেড়েছে ২০ শতাংশ।
মহামারির এই সময়ে স্পর্শহীন পণ্য সরবরাহকেই নতুন বাস্তবতা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে এমন সেবা চালু হয় গত বছর। চীনে যে প্রতিষ্ঠানটি সেবাটি নিয়ে এসেছে, তারা গত বছরই এর পরীক্ষা চালায়। তবে মহামারির কারণে তড়িঘড়ি এই কার্যক্রম শুরু করে তারা। এ জন্য তারা যেসব গাড়ি ব্যবহার করেছে, সেগুলো চালকহীন গাড়ি। ২০২১ সালে এমন প্রযুক্তির চাহিদা আরও বাড়বে।
পণ্য সরবরাহের পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন আরেক ধরনের দোকান, যেখান কোনো বিক্রেতা থাকেন না। ক্রেতা দোকানে যাবেন, মুঠোফোনে থাকা দোকানের অ্যাপ স্ক্যান করে প্রবেশ করবেন এবং নিজে নিজেই পণ্য সংগ্রহ করবেন। দোকান পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয় উন্নত প্রযুক্তির ক্যামেরা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি। ওই সব ক্যামেরা ও এআই প্রযুক্তি দোকানে ক্রেতার হাঁটাচলার ওপর নজর রাখে। ক্রেতা কোন কোন পণ্য নিচ্ছেন, তা–ও লক্ষ রাখে। এমনকি ক্রেতা দোকানে কতক্ষণ অবস্থান করছেন, সেটিও পর্যবেক্ষণ করা হয়। এরপর ক্রেতা দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে মুঠোফোনে বার্তা দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়, তিনি কত টাকার কেনাকাটা করলেন। এই প্রযুক্তি ইতিমধ্যে ব্যবহার শুরু করেছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আমাজন। যুক্তরাষ্ট্রে এমন দোকান চালু করেছে তারা। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও এমন দোকান চালু হবে বলে জানা গেছে।
শুধু পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে চালকহীন গাড়ি ব্যবহার হচ্ছে, এমন নয়। যাত্রী পরিবহনেও যুক্তরাষ্ট্রের সড়কে নেমেছে এমন গাড়ি। গত অক্টোবরে অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের ফিনিক্স শহরে ৩০০ গাড়ি দিয়ে এই সেবার যাত্রা শুরু। এমন সেবা দেওয়া হচ্ছে চীনের সাংহাই শহরেরও। এই ট্যাক্সি সেবার চাহিদাও ২০২১ সালে বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মহামারিকালে প্রযুক্তির ব্যবহার অবিশ্বাস্য হারে বেড়েছে স্বাস্থ্যসেবা খাতে এবং সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায়। করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় দেশে দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্মীদের ‘হোম অফিসে’ পাঠিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বৈঠক এবং অফিসের প্রযুক্তি বাসা থেকে ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। এ ছাড়া রোগীদের পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে। একে ‘টেলিহেলথ সেবা’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এসব সেবার আওতা ২০২১ সালে আরও বাড়বে। এ ছাড়া স্পর্শ ছাড়া ওষুধ সামগ্রী রোগীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রবণতাও এ বছর বাড়বে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ২০২১ সালে ৭ কোটি মানুষ এমন সেবার আওতায় আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ছাড়া দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের আওতাও বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২১ সালে প্রযুক্তিগত যেসব উন্নয়ন হবে, তার অধিকাংশই ২০২০ সালের ধারাবাহিকতা। তবে করোনা মহামারির কারণে এই প্রবণতা নতুন মাত্রা পাবে।
সূত্র: ফোর্বস, বিবিসি, আইএনসি