অঘটনের বছর ২০২০ সাল

বিদায় নিচ্ছে ২০২০ সাল। নতুন আশা নিয়ে বিশ্ব বরণ করে নিতে যাচ্ছে খ্রিষ্টীয় নতুন বছর ২০২১ সালকে। তবে নানা অঘটনের বছর হিসেবে ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে বিদায়ী ২০২০ সাল। এসব অঘটনের মধ্যে করোনাভাইরাসের মহামারি অন্যতম। এ ছাড়া ইরানের প্রভাবশালী জেনারেল কাসেম সোলাইমানি হত্যা, ইরানে ইউক্রেনের যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ ভূপাতিত করার ঘটনা, অস্ট্রেলিয়ার দাবানল, বৈরুত বিস্ফোরণ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনসহ নানা ঘটনার কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে বিদায়ী বছরটি।

সুইজারল্যান্ডের জুরিখে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মারা গেছেন ৮৮৬ জন। তাঁদের স্মরণে জ্বালানো হয়েছে ৮৮৬টি মোমবাতি। ৩০ ডিসেম্বর জুরিখের গ্রসমুয়েনস্টার গির্জার সামনেছবি: রয়টার্স

১. করোনাভাইরাসের মহামারি
চীনের উহান থেকে চলতি বছরের গোড়ার দিকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাসের মহামারি। এরপর দেশে দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু ব্যাপক হারে বাড়তে শুরু করে। একপর্যায়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই মহামারিকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা দেয়। করোনা মহামারি এখনো নিয়ন্ত্রণে আসার কোনো লক্ষণ নেই। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, রথী-মহারথীরাও রেহাই পাননি সংক্রমণের হাত থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনসহ বেশ কয়েকজন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে আট কোটির বেশি মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যুও বাড়ছে প্রতিদিন।

তবে করোনার টিকা অন্ধকারের শেষে আশার আলো হয়ে এসেছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজারের টিকা প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। টিকাটি উদ্ভাবনে সহযোগিতা করেছে জার্মানির জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেক। আরেক মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মডার্নার টিকারও জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োগ শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকাও আশা জাগিয়েছে।

এই তিন টিকা ছাড়াও চীন, রাশিয়ার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও টিকা উদ্ভাবন করেছে। রাশিয়ার গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের টিকাটি স্থানীয়ভাবে প্রয়োগ শুরু হয়েছে বেশ আগেই। চীনে সিনোভ্যাক, সিনোফার্মসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান টিকা উদ্ভাবন করেছে। এই দেশেও স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া ভারতে ভারত বায়োটেকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান টিকা নিয়ে কাজ করছে।

কাসেম সোলাইমানি
ফাইল ছবি

২. ইরানের প্রভাবশালী জেনারেল হত্যা
ইরানের সশস্ত্র বাহিনী রেভল্যুশনারি গার্ডসের প্রভাবশালী ইউনিট কুদস ফোর্স। এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। গত ২ জানুয়ারি ইরাকে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সরাসরি নির্দেশে ঘটনাটি ঘটানো হয়। এর প্রতিক্রিয়া ছিল ব্যাপক। ইরানের সঙ্গে ছয় বিশ্বশক্তির করা পারমাণবিক চুক্তি হুমকিতে পড়ে। প্রতিশোধ নিতে গত ৮ জানুয়ারি ইরাকে দুটি সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ওই দুই ঘাঁটিতে ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন সেনারা ছিলেন। ওই হামলায় কেউ নিহত না হলেও শতাধিক সেনা নানাভাবে আহত হয়েছিলেন বলে জানা গেছে। ঠিক ওই দিনই ইরানের রাজধানী তেহরানে বিধ্বস্ত হয় ইউক্রেন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ। এতে নিহত হয় উড়োজাহাজটির ১৭৬ জন আরোহীর সবাই। প্রথমে ঘটনাটিকে দুর্ঘটনা বলে দাবি করলেও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পরে ইরান স্বীকার করে, ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতেই উড়োজাহাজটি ভূপাতিত হয়েছে। তবে দেশটির দাবি, ঘটনাটি ইচ্ছাকৃত হামলা ছিল না।

৩. রাজকীয় দায়দায়িত্ব থেকে হ্যারি-মেগানের প্রস্থান
ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য প্রিন্স হ্যারি ও তাঁর স্ত্রী মেগান মার্কেল গত ৮ জানুয়ারি আকস্মিক এক ঘোষণা দেন। এক বিবৃতিতে তাঁরা জানান, ‘আমরা রাজপরিবারের “জ্যেষ্ঠ” সদস্যের পদ থেকে সরে যাওয়ার এবং আর্থিকভাবে স্বাধীন হওয়ার অভিপ্রায় প্রকাশ করছি। তবে রানির প্রতি আমাদের সমর্থন অটুট থাকবে।’ তাঁরা আরও বলেন, ‘আমরা এখন যুক্তরাজ্য ও উত্তর আমেরিকায় আমাদের অবস্থানের মধ্যে ভারসাম্য আনার পরিকল্পনা করছি।’

প্রিন্স হ্যারি ও মেগান মার্কেল
ফাইল ছবি

হ্যারি-মেগানের এমন ঘোষণা সম্ভবত রাজপরিবারের কাছেও অপ্রত্যাশিত ছিল। আর তাই তাঁদের ওই বিবৃতি প্রকাশের কিছু পরই বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মুখপাত্র বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘ডিউক এবং ডাচেস অব সাসেক্সের সঙ্গে আলোচনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।’ তবে শেষ পর্যন্ত ফেরানো যায়নি হ্যারি আর মেগানকে। তাঁরা ঠিকই রাজপরিবার ছেড়েছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এই দম্পতি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলীয় এলাকায় বসতি গড়েছেন। এই দম্পতি আর্চওয়েল নামের একটি অলাভজনক সংগঠন গড়ে তুলেছেন।

৪. ব্রেক্সিট কার্যকর
২০১৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত গণভোটে যুক্তরাজ্যের জনগণ ব্রেক্সিটের (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ) পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। এর পরপরই ক্ষমতা থেকে সরে যান দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন কনজারভেটিভ পার্টির নতুন নেতা থেরেসা মে। মার্গারেট থেচারের পর তিনিই যুক্তরাজ্যে দ্বিতীয় নারী হিসেবে এই পদে আসীন হন। কিন্তু থেরেসা মে নানা জটিলতার কারণে ব্রেক্সিট কার্যকরে ব্যর্থ হন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ব্রেক্সিট বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। ৩০ ডিসেম্বর লন্ডনে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে
ছবি: রয়টার্স

২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে তিনিও সরে যেতে বাধ্য হন। এরপর দৃশ্যপটে আসেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। কিন্তু তিনিও পেরে উঠছিলেন না। ক্ষমতা সুসংহত করে ব্রেক্সিট কার্যকর করতে তিনি আগাম নির্বাচনের পথ বেছে নেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ওই সাধারণ নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি আবার ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি কার্যকর হয় ব্রেক্সিট। যদিও বিচ্ছেদ পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে মতবিরোধ রয়ে যায়। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার পর গত ২৪ ডিসেম্বর দুই পক্ষ চুক্তির ব্যাপারে একমত হয়। এরপর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেন, নতুন বছরে স্বাধীনভাবে যাত্রা শুরু করবে যুক্তরাজ্য।

৫. অস্ট্রেলিয়ার দাবানল
অস্ট্রেলিয়ায় দাবানলের সূত্রপাত ২০১৯ সালের শেষ দিকে। কিন্তু ২০২০ সালে এসেও সেই দাবানলে পুড়তে থাকে একরের পর একর এলাকা। গত মার্চ পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, এই আগুনে ১ কোটি ৮৬ লাখ হেক্টর এলাকা পুড়ে গেছে। ধ্বংস হয়েছে প্রায় ছয় হাজার ভবন। এসব ভবনের মধ্যে প্রায় ২ হাজার ৮০০ বাড়িঘর রয়েছে। দাবানলের কারণে প্রাণ গেছে অগ্নিনির্বাপণকর্মীসহ অন্তত ৩৪ জনের। এ ছাড়া পুড়ে অঙ্গার হয়েছে কোটি কোটি প্রাণী।

অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল
ফাইল ছবি

এই দাবানলের জন্য দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের জলবায়ু নীতিকে দায়ী করেছেন অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে দাবানল ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে উড়োজাহাজ থেকে পানি ফেলা হয়, কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। অনেক চেষ্টার পর গত মার্চের প্রথম দিকে নিউ সাউথ ওয়েলসের আগুন সম্পূর্ণরূপে নেভানো সম্ভব হয়। ওই সময় ভিক্টোরিয়া রাজ্যের আগুনও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। আগুন নেভাতে গিয়ে পানিবাহী একটি উড়োজাহাজ এবং দুটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়।

৬. যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ
যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশসহ কর্তৃপক্ষের বর্ণবাদী আচরণের কারণে কয়েক বছর ধরেই ক্ষোভ জমছিল। তা যেন বিস্ফোরিত হয় মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিসে পুলিশের হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনায়। গত মে মাসে ঘটনাটি ঘটে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলন ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস’ নাম পায়। অবশ্য কয়েক বছর আগে থেকেই এই নামে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন চলে আসছিল। গত মে থেকে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর দাবি জানানো হয়।

পুলিশের হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভ। ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসের কাছে
ফাইল ছবি

আন্দোলন চলা অবস্থায় এবং এর আগে-পরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কিছু বিতর্কিত মন্তব্য যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। ফলে সহিংসতার ঘটনাও ঘটে। ওয়াশিংটনসহ নানা জায়গায় হামলার ঘটনা ঘটে। ক্রমেই বর্ণবাদবিরোধী এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ নানা দেশে। তবে করোনার মহামারির কারণে শেষ পর্যন্ত আন্দোলনটি স্তিমিত হয়ে আসে।

৭. বৈরুত বিস্ফোরণ
২০২০ সালের ৪ আগস্ট স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ছয়টা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বাসিন্দাদের হঠাৎ যেন মনে হলো, পৃথিবীটা বিকট বিস্ফোরণে ফেটে পড়েছে। মুহূর্তে রাজধানী শহরটির বড় একটি অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। ঘটনার সূত্রপাত ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী বৈরুতের বন্দরে। সেখানে গুদামঘরে অরক্ষিত অবস্থায় রাখা ছিল ২ হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট। ওই জায়গায়ই অগ্নিকাণ্ড থেকে জোড়া বিস্ফোরণ ঘটে। এই দুর্ঘটনায় বৈরুতে দুই শতাধিক মানুষ নিহত হয়। আহত হয় সাড়ে ছয় হাজারের বেশি। রাতারাতি গৃহহীন হয়ে পড়ে প্রায় তিন লাখ মানুষ।

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডের একদল গবেষক প্রাথমিকভাবে নির্ণয় করেছিলেন, ওই বিস্ফোরণের শক্তি ছিল এক হাজার থেকে দেড় হাজার টন টিএনটি একযোগে বিস্ফোরণের সমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার ১০ ভাগের ১ ভাগ শক্তি ছিল বৈরুতের ওই বিস্ফোরণের।

বৈরুতের বন্দরে বিস্ফোরণের পর ধ্বংসস্তূপের একাংশ
ফাইল ছবি

ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অপারমাণবিক কৃত্রিম বিস্ফোরণগুলোর অন্যতম বৈরুতের বিস্ফোরণ। এর শক্তি এতটাই ছিল যে ভূমধ্যসাগরের অপর প্রান্তে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ সাইপ্রাস থেকেও এর শব্দ শোনা গেছে। দেশটি বৈরুত থেকে ২৪০ কিলোমিটার দূরে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) বিস্ফোরণের কারণে সৃষ্ট কম্পনকে ৩ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প হিসেবে শনাক্ত করেছিল। এই কম্পন অনুভূত হয়েছে তুরস্ক, সিরিয়া, ইসরায়েল, ফিলিস্তিনি এবং ইউরোপের একাংশেও। এক বিস্ফোরণেই লেবাননে দেড় হাজার কোটি মার্কিন ডলারের সম্পদের ক্ষতি হয়। বিস্ফোরণের পরপরই লেবাননের সরকার দুই সপ্তাহের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছিল।

এদিকে বেকারত্বসহ নানা কারণে ২০১৯ সাল থেকেই বিক্ষোভ দানা বাঁধছিল। বৈরুতের ওই বিস্ফোরণের পর তা যেন দাবানল হয়ে ফুঁসে উঠল। প্রতিবাদ জানালেন আইনপ্রণেতারাও। লেবাননের পার্লামেন্টের বেশ কয়েকজন সদস্য পদত্যাগ করলেন। ৯ আগস্ট থেকে শুরু হলো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াবের মন্ত্রিসভার সদস্যদের একে একে পদত্যাগ। রাজনৈতিক চাপে পড়ে পরদিন ১০ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করেন। পরে ক্ষমতায় আসেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি। তবে তিনিও বেশি দিন টিকতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত হাসান দিয়াব আবারও লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

৮. যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গত ৩ নভেম্বর ভোট গ্রহণ করা হয়। এই নির্বাচনে বিজয়ী হন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে ইতিহাসে নাম লেখান তাঁর রানিং মেট কমলা হ্যারিস। তবে নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন। ভোটের ফল পাল্টে দিতে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আইনপ্রণেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগের অভিযোগও উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। একের পর এক মামলাও ঠুকেছেন ট্রাম্প। তবে সব কটি মামলাতেই পরাজয়ের স্বাদ পেয়েছেন তিনি। ট্রাম্প পরাজয় স্বীকার না করে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এমন এক অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছেন, যা এর আগে দেখা যায়নি। প্রথম দিকে তাঁর প্রশাসন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের অন্তর্বর্তী দলকে সরকারি তহবিল ও কাজের জায়গা দিতেই অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। তবে পরে চাপে পড়ে নমনীয় হন ট্রাম্প।

দুই প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন (বাঁয়ে) ও ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউসের পথে অনেক এগিয়ে গেছে বাইডেন
ছবি: এএফপি

এর আগে গত বছরের শেষে একবার ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হয় ট্রাম্পের। দুই অভিযোগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিত হন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এবং মার্কিন কংগ্রেসের কাজে বাধা দিয়েছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তাঁর ছেলে হান্টার বাইডেনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনে তদন্ত শুরু করতে চাপ দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এই তথ্য ফাঁস হওয়ার পর তদন্তে তার প্রমাণ পেয়ে ডেমোক্র্যাট সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধি পরিষদে ট্রাম্পকে অভিশংসন করার প্রস্তুতি শুরু হয়। ডিসেম্বরে ট্রাম্পকে অভিশংসনের পর সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পাঠানো হয় কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে। তবে রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনেট গত ৫ ফেব্রুয়ারি ট্রাম্পকে অভিযোগ থেকে খালাস দেয়।

৯. ইরানের পরমাণুবিজ্ঞানী হত্যা
ইরানের শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসিন ফাখরিজাদেহ হত্যাকাণ্ডের শিকার হন গত ২৭ নভেম্বর। ইরানের অভিযোগ, ইসরায়েলের গুপ্তচরেরা কৃত্রিম উপগ্রহ নিয়ন্ত্রিত রাইফেল দিয়ে গুলি করে এই বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলি ফাদাভি দাবি করেছেন, একটি ট্রাকের ওপর স্থাপিত রাইফেল দিয়ে বিজ্ঞানী ফাখরিজাদেহর মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। এ সময় গাড়িতে তাঁর পাশে থাকা তাঁর স্ত্রী অক্ষত ছিলেন। এর আগে ইরান দাবি করেছিল, ফাখরিজাদেহর গাড়িবহরের ওপর হামলা চালিয়েছিল কয়েকজন বন্দুকধারী। এ সময় তাঁর দেহরক্ষীদের সঙ্গে দুর্বৃত্তদের বন্দুকযুদ্ধও হয়। ঘটনার সময় ফাখরিজাদেহ রাজধানী তেহরানের কাছে আবসার্দ শহরে ছিলেন। চলতি পথে তাঁর ওপর হামলা হয়। এ ঘটনায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছে ইরানের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে তাঁদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।

১০. ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ
মরক্কো ১০ ডিসেম্বর ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই চুক্তি হয়েছে। এ নিয়ে ২০২০ সালের শেষ চার মাসে চারটি আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিল। বাকি তিন দেশ হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও সুদান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১০ ডিসেম্বর মরক্কোর বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদের সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনা করেন। এরপরই সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘোষণাটি আসে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ওয়েস্টার্ন সাহারা অঞ্চলে মরক্কোর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেবেন ট্রাম্প। বিনিময়ে মরক্কো ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে এবং দুই দেশের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করার সুযোগ দেবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু
ফাইল ছবি

এর আগে ইসরায়েলকে নিজেদের আকাশসীমা ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা দেয় সৌদি আরব। ট্রাম্পের দাবি, এসব অগ্রগতি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বড় অর্জন। তবে ফিলিস্তিনের কর্তৃপক্ষ ও জনগণ এসব ঘটনাকে ভালোভাবে নেয়নি। তারা সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরক্কোর পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করেছে। মরক্কোর পরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটানও ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে চুক্তি করে।

এ ছাড়া আরও ঘটনায় ইতিহাসে স্থায়ী হয়ে থাকবে বিদায়ী ২০২০ সাল। তবে অঘটনই বেশি ঘটায় এই বছরকে হয়তো অনেকেই ভুলে যেতে চাইবেন।

তথ্যসূত্র: রয়টার্স, এএফপি, বিবিসি, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্ট