এআই বস হলে কেমন হবে
প্রতিষ্ঠানে তাঁর অধীন ৮৩ জন কর্মী। এই কর্মীদের ব্যবস্থাপনার কাজের চাপে হান্নু রউমা মাঝেমধ্যে হতোদ্যম হয়ে যান ও হতাশ বোধ করেন।
কানাডার ভ্যানকুভারে অবস্থানরত রউমা বলেন, কর্মীদের নানা ভুলভ্রান্তিতে তিনি মানসিকভাবে জর্জরিত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর নিরাশার অনুভূতি হচ্ছিল।
স্টুডেন্ট মার্কেটিং এজেন্সি নামের একটি কোম্পানির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক রউমা। কোম্পানিটি ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপণনসহায়তা দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়।
রউমা বলেন, সেবা নেওয়ার জন্য নতুন গ্রাহক (ক্লায়েন্ট) কোম্পানিতে এলে তিনি কিছুটা উদ্বেগ বোধ করতেন। মনের উদ্বিগ্ন অংশ বলত, তাঁরা বুঝি ভুলভ্রান্তি করতে যাচ্ছেন। আর এটাই তাঁর কাজের উৎসাহ অনেকটা কমিয়ে দেয়।
রউমা বলেন, তবে গত নভেম্বর থেকে সবকিছু বদলে যেতে থাকে। তখন তাঁর কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইনসপাইরার তৈরি একটি স্বনির্ভর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবস্থাপকের ব্যবহার শুরু করে।
এআই ব্যবস্থাপক এজেন্সিটির সেসব কর্মীকে সাহায্য করে, যাঁরা দূরে থেকে নিজেদের সুবিধাজনক সময়ে কাজ করেন। এই কর্মীদের কাজের সময় তালিকা নির্ধারণ, কর্মপরিকল্পনা আগেই ঠিক করার মতো বিষয়ে সহায়তা করে এআই ব্যবস্থাপক।
এআই ব্যবস্থাপক আরও যেসব কাজ করে, তার মধ্যে আছে—কর্মীদের সময় পরিপালন যাচাই, সুনির্দিষ্ট কাজ শেষ করতে বেঁধে দেওয়া সময়সীমা মনে করিয়ে দেওয়া, কাজের হালনাগাদ অগ্রগতি জানাতে কর্মীদের নিয়মিত বার্তা পাঠানো, বিভিন্ন গ্রাহকের পেছনে ব্যয় করা সময়ের রেকর্ড রাখা, যাতে পরবর্তী সময় সঠিকভাবে বিল করা যায় ইত্যাদি।
কর্মীর লেখার উন্নতিরও পরামর্শ দেয় এআই। কাজ-সম্পর্কিত কর্মীর প্রশ্নের উত্তর দিতে এআই সব সময় প্রস্তুত থাকে। এ ছাড়া একটি কেন্দ্রীয় পোর্টালে প্রত্যেক কর্মীর কাজের অগ্রগতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হালনাগাদ করে এআই।
স্টুডেন্ট মার্কেটিং এজেন্সির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক রউমা বলেন, এআই ব্যবস্থাপক তাঁর কাজের চাপের মাত্রা কমিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি কর্মীদের দ্রুত কাজ করতে সক্ষম করে তুলেছে। কর্মীদের আরও বেশি উৎপাদনশীল বানিয়েছে।
রউমার ভাষ্য, তিনি এখন কোম্পানির উন্নতি-অগ্রগতিসহ সব ইতিবাচক বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিতে পারেন। তিনি নিশ্চিত, এআই ব্যবস্থাপকের সংযোজন তাঁর আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে দিয়েছে।
রউমা বলেন, এআই ব্যবস্থাপক আসার পর কর্মীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে এখন তাঁরা সবাই সমান। প্রত্যেকের সমান সুযোগ। আগে তা ছিল শুধু সমস্যার সমাধান-কেন্দ্রিক। কিন্তু এখন তাঁরা আরও হালকা আলোচনা করতে পারেন।
কিন্তু স্টুডেন্ট মার্কেটিং এজেন্সির সবাই এখনো এআই ব্যবস্থাপক ব্যবহার করেন না।
রউমা ও তাঁর এজেন্সির ৮৩ কর্মীর মধ্যে ২৬ জন একটি গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন। গবেষণাটি করে ইনসপাইরা ও কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি এবং অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি ও উইসকনসিন ইউনিভার্সিটির শিক্ষকেরা। গবেষণায় মানুষ ব্যবস্থাপকের সঙ্গে এআই ব্যবস্থাপকের কর্মদক্ষতা (পারফরম্যান্স) তুলনা করা হয়।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের তিনটি দলে ভাগ করা হয়েছিল। একটি দল পরিচালনায় ছিল মানুষ ব্যবস্থাপক। আরেকটি দল পরিচালনায় ছিল এআই ব্যবস্থাপক। তৃতীয় দলটির ব্যবস্থাপনায় এআই ও মানুষ উভয়ের অংশীদারত্ব ছিল।
এআই ব্যবস্থাপকেরা কর্মীদের তাঁদের কর্মদিবসের পূর্বপরিকল্পনা আগে থেকে করানোর ক্ষেত্রে ৪৪ শতাংশ সাফল্য অর্জন করে। আর কর্মীদের ঠিক সময়ে কাজ শুরু করতে অনুপ্রাণিত করার ব্যাপারে ৪২ শতাংশ ক্ষেত্রে সফল হয়।
এসব পরিসংখ্যান মানুষ ব্যবস্থাপকের সঙ্গে তুলনাযোগ্য। গবেষণায় মানুষ ব্যবস্থাপক এই দুটি ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৪৫ ও ৪৪ শতাংশ স্কোর অর্জন করেছিলেন।
আর যখন এআই ব্যবস্থাপক একজন মানুষ ব্যবস্থাপকের সঙ্গে অংশীদারত্বে কাজ করেছিল, তখন উভয়ে একত্রে কর্মীদের কর্মদিবসের পূর্বপরিকল্পনা করানোর ক্ষেত্রে ৭২ শতাংশ সাফল্য অর্জন করেছিল। সময়মতো কাজ শুরু করানোর ক্ষেত্রে সাফল্য ৪৬ শতাংশ।
গবেষণাটি পরিসংখ্যানগতভাবে ছোট। তা ছাড়া গবেষণাটি একটি নির্দিষ্ট ধরনের কর্মী ও ক্ষেত্রকেন্দ্রিক। তা সত্ত্বেও গবেষণার ফলাফল ব্যবস্থাপনায় এআই প্রযুক্তি প্রবর্তনকারী কোম্পানিগুলোর জন্য আকর্ষণীয় প্রভাবের দিক নির্দেশ করে।
ইউপিএস, ডেলসহ অন্য কোম্পানি চলতি বছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মী কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। কোম্পানিগুলোর উদ্দেশ্য হলো, মানুষের অনেক কাজ এআইকে দিয়ে করানো। তবে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পল থারম্যানের মতে, ব্যবস্থাপনার ভূমিকা পুরোপুরি এআইনির্ভর করা হবে একটি ভুল।
অধ্যাপক পল থারম্যান বলেন, ব্যবস্থাপনার মধ্যম স্তরটি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর। এই স্তরে বদল আনলে তার ফলাফল ভালো হবে না। কর্মীরা ধারাবাহিকতা দেখতে পান না। তাঁরা মেন্টরিং ও কোচিং পান না। এগুলো মনুষ্য ব্যবস্থাপনাগত বিষয়। এসব বিষয়ের ক্ষেত্রে এআইয়ের চেয়ে মানুষই ভালো। আর তাতেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
অধ্যাপক পল থারম্যান আরও বলেন, এআই কিছু কাজ থেকে মানুষ ব্যবস্থাপকদের মুক্তি দিতে পারে। যেমন কোনো বিষয়ে কর্মীদের নিয়মিত স্মরণ করিয়ে দেওয়া, কাজের অগ্রগতির হালনাগাদ তথ্য চাওয়া। এসব ভার থেকে মুক্ত হলে মানুষ ব্যবস্থাপক আরও উদ্ভাবনী উপায়ে কাজ করার বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারবেন।
উদাহরণস্বরূপ, ব্যবস্থাপকেরা ব্যক্তিগত দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে কোনো প্রকল্পের জন্য সেরা কর্মীদের বাছাই করতে পারেন। এই দলকে তাঁর সারাক্ষণ তত্ত্বাবধান করতে হবে না। কাজ শেষ করার সময়সীমা দেখভালসহ কর্মী দলের বিভিন্ন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব তাঁরা এআইকে দিতে পারেন।
এ ছাড়া দলে কে পিছিয়ে পড়ছেন, তা শনাক্ত করতে পারে এআই। কাকে একজন মানুষ কর্তৃক আরও নিবিড়ভাবে পরিচালনা করা দরকার, তা চিহ্নিত করার কাজ এআই করতে পারে। আবার তারকা পারফরমার কর্মীদের মধ্যে কাদের অতিরিক্ত স্বীকৃতি দরকার, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে এআই।
তবে কোম্পানিগুলোকে এআই ব্যবস্থাপকনির্ভর নজরদারি হাতিয়ার বসানো থেকে দূরে থাকা উচিত বলে মত দেন অধ্যাপক পল থারম্যান।
পল থারম্যান বলেন, কে দুপুরে খাবার খেতে বেশি সময় নিল, এমন বিষয় নিশ্চয়ই নজরদারির আওতায় আনা ঠিক হবে না। এআই ব্যবস্থাপক ব্যবহারের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত, কর্মীর সঠিক আচরণ উৎসাহিত করার সঠিক উপায় খুঁজে পাওয়া।
যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক মানবসম্পদ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এইচআর হ্যাবিট্যাটের প্রতিষ্ঠাতা টিনা রহমান বলেন, এআই ব্যবস্থাপকেরা এমন মানুষকে সহায়তা করতে পারে, যারা ‘দৈবক্রমে ব্যবস্থাপক’ হয়ে উঠেছেন। অর্থাৎ ব্যবস্থাপনা যাঁদের স্বাভাবিক দক্ষতা নয়।
টিনা রহমান জানান, তাঁরা একটি সমীক্ষা করেছেন। এতে লোকজনের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কারণ খতিয়ে দেখা হয়। উত্তরদাতাদের প্রায় ১০০ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা বাজে ব্যবস্থাপনার কারণে চাকরি ছেড়েছেন।
টিনা রহমান বলেন, সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছিলেন, তাঁদের যেভাবে পরিচালনা করা হচ্ছিল, তা তাঁরা পছন্দ করছিলেন না। বেশির ভাগ উত্তরদাতা এ কথাও বলেছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে কী আশা করা হচ্ছিল, তা তাঁরা জানতেন না। আবার তাঁরা ভালো কাজ করছিলেন কি না, তা–ও জানতেন না।
এসব ব্যাপারে সঠিক দিকনির্দেশনা, প্রয়োজনীয়তা ও ফলাফলের বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার জন্য একজন এআই ব্যবস্থাপক থাকার কথা ধারণা করতে বলেন টিনা রহমান। তিনি বলেন, কর্মীরা সম্ভবত আরও উৎপাদনশীল হতে পারেন, যখন তাঁরা জানেন যে তাঁদের কাছ থেকে কী আশা করা হচ্ছে।
তবে এআই ব্যবস্থাপকদের ওপর অত্যধিক নির্ভরতা নিয়ে সতর্ক করেন টিনা রহমান। তিনি বলেন, এটি এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করে, কোম্পানি শুধু ফলাফল (আউটপুট) নিয়ে চিন্তা করে, মানুষ বা কর্মী নিয়ে নয়।
টিনা রহমান বলেন, একটি নতুন এআই ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। এটি পুরোপুরি কর্মী ব্যবস্থাপনার কাজ করতে যাচ্ছে। এমন ঘোষণা কর্মীদের উদ্দেশে দেওয়াটা কোম্পানির জন্য খুবই কঠিন একটা ব্যাপার হবে। তবে একই সঙ্গে এ কথাও কোম্পানির বলা উচিত, তারা কর্মক্ষেত্রে কর্মীর অভিজ্ঞতার বিষয়ে যত্নশীল।
সাইবার নিরাপত্তা পরামর্শক ফার্ম বোরস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেমস বোর সতর্ক করে বলেন, সম্ভবত এআই ব্যবস্থাপক নিয়ে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ মানুষ বা কর্মীর দিক থেকে নয়, বরং তা সাইবার নিরাপত্তার দিক থেকে।
জেমস বোর বলেন, যদি কোনো কোম্পানিতে এআই ব্যবস্থাপক থাকে, আর তাকে প্রতিষ্ঠানের সব প্রক্রিয়া, পদ্ধতি ও বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদ দেওয়া হয়, তাহলে এটিকে কেউ হ্যাক করতে পারে। এটির অপব্যবহার করতে পারে। এমনকি অর্থও দাবি করতে পারে।
জেমস বোর আরও বলেন, এআই ব্যবস্থাপকের ওপর নির্ভর করার অর্থ হলো মানুষের কাজের দায়িত্ব তাকে (এআই) দেওয়া। এটা করার অর্থ কোম্পানির একধরনের আটকে যাওয়া। কেননা, তখন তো কোম্পানির আর মানুষের কাছে ফিরে যাওয়ার বিকল্প থাকে না।
এআই-এর ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো আরও দক্ষ হওয়ার পরিবর্তে ব্যর্থ হতে পারে বলে সতর্ক করেন জেমস বোর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে ব্যবস্থা (সিস্টেম) ব্যর্থ হতে পারে, তার ওপর নির্ভর করলে অনভিপ্রেত পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে।