বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ভারতের বিরুদ্ধে দিল্লির অরুণ জেটলি স্টেডিয়ামে প্রথম টি২০ জিতে যে আশার আলো জাগিয়েছিল, প্রথম টেস্টের পর তা অনেকটাই স্তিমিত। আশা করা হয়েছিল, বাংলাদেশ ভারতের মাটিতে ভারতকে বড় চ্যালেঞ্জ দেবে। পরের দুটি টি২০–তে বাংলাদেশের হারের পর এবং বিশেষ করে প্রথম টেস্টে তিন দিনের মধ্যে খেলা শেষ হয়ে যাওয়াতে সেই আশা এখন অনেকটা জলে। পরের ও শেষ টেস্ট ম্যাচটি খেলা হবে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে। এই প্রথম দিন-রাতের আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ হবে ভারতে এবং এই প্রথম ভারত খেলবে গোলাপি বলে। সব মিলিয়ে দারুণ উত্তেজক ও উপভোগ্য ম্যাচ হওয়ার কথা যদি দুই দল তাদের সেরাটা দিতে পারে।
ক্রিকেটের সেরা লড়াই হলো টেস্ট ক্রিকেট। কারণ, একটি টেস্ট ম্যাচেই বলা ভালো টেস্ট সিরিজেই খেলোয়াড়দের মানের সঠিক বিচার সম্ভব। টেস্ট ম্যাচ খেলাও অত্যন্ত কঠিন। টানা পাঁচ দিন খেলতে হয়। বোলিং এবং ফিল্ডিংয়ে রেস্ট্রিকশান অনেক কম। ফলে ওয়ানডে এবং বিশেষত টি২০ যেখানে পুরোটাই ব্যাটসম্যানদের খেলায় পরিণত হয়েছে, টেস্ট ম্যাচে বোলাররা ব্যাটসম্যানদের প্রকৃত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে। সময়, রানের গতি, উইকেট বাঁচিয়ে রাখা এ কয়টা ব্যাপারকে মাথায় রেখে সেখানে খেলতে হয়। ব্যাটিং–বোলিং দুক্ষেত্রেই শক্তিশালী লাইনআপ না থাকলে ভালো টেস্ট দল হয়ে ওঠা অত্যন্ত কঠিন।
আর সেই টেস্ট সিরিজের প্রথম টেস্টের ফল দেখে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত অখুশি ও হতাশ। আমি একজন ভারতীয় হিসেবেও এই খেলার ফলাফলে হতাশ। আজ কুড়ি বছর ধরে টেস্ট খেলার পর এবং এত দিন পর ভারতে টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়ে আশা করা হয়েছিল, বাংলাদেশ ভালো খেলবে। ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে পঞ্চম দিন অবধি খেলা দেখার আনন্দই আলাদা। শুধু পাঁচ দিনের পর কি ফল হলো, সেটা দেখার থেকেও ব্যক্তিগতভাবে আমার যেটি বেশি প্রিয় তা হলো, এই পাঁচ দিনের খেলায় তৈরি বিভিন্ন ঘটনা। টেস্ট ক্রিকেটেই তো আসল গল্পগুলো তৈরি হয় যা বহু বছর পরেও মনে থাকে। সেটিই করতে সফল হয়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। একটি সেশনেও মনে হয়নি, তারা জেতার জন্য বা কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে খেলছে। ময়াঙ্ক আগরওয়ালের ডাবল সেঞ্চুরি বা দ্বিতীয় ইনিংসে শামির আগুন জরানো স্পেলের কথা মনে থাকবে অনেক দিন। বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রেমীদের পক্ষেও ভোলা সম্ভব হবে নয়, ইমরুল কায়েসের ময়ান্ক আগরওয়ালের সহজ ক্যাচ ফেলে দেওয়ার ঘটনাটি।
ভারতকে ভারতের মাটিতে টেস্টে বেকায়দায় ফেলা চিরকালই খুব কঠিন কাজ। আমরা সবাই জানি, ভারতের বেশির ভাগ পিচ ব্যাটিং সহায়ক। তার ওপরে উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়ায় বোলার এবং ফিল্ডারদের অস্বস্তি আরও বাড়ায়। শুধু শেষের দুই দিন ভাঙা পচে স্পিনাররা খুব সুবিধা পায় এবং প্রথম দিন প্রথম দু-এক ঘণ্টা পেসারদের জন্য বরাদ্দ থাকে। ভারত চিরকালই দারুণ ব্যাটিং লাইনআপ নিয়ে খেলেছে। এখনকার ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা তো সারা ক্রিকেট বিশ্বে সমাদৃত। এ ছাড়া অশ্বীনের মতন বিশ্বমানের স্পিনার ছিল ভারতের দলে। ভারতের পেস অ্যাটাক অপেক্ষাকৃত দুর্বল হলেও কপিল দেব, শ্রীনাথ, জাহির খানের মতন অন্তত একজন স্ট্রাইক ফাস্ট-পেস বোলার ছিল এই দলে। সেই দলে এখন চাঁদের হাট বসেছে। ‘ইন্ডিয়ান পেস ব্যাটারি’ শব্দ সমষ্টি এর আগে আমাদের অজানাই ছিল। এ রকম দলকে দেশের মাটিতে হারাতে গেলে বা অন্তত চ্যালেঞ্জ দিতে গেলে যেগুলো ঘটা দরকার, তার একটিও বাংলাদেশের পক্ষে ঘটেনি।
নানা কারণে একদল প্রথম সারির খেলোয়াড়কে পায়নি বাংলাদেশের এই টেস্ট টিম। নামগুলো নিয়ে আর ভারাক্রান্ত করতে চাই না পাঠকদের। তাঁরা থাকলে টেস্টের ফল অন্যরকম হতো কিনা জানি না, তবে ভারত বোধহয় এত সহজে জিততে পারত না। এক-আধটা সেশনে বাংলাদেশ অন্তত ভালো ক্রিকেট খেলতো, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। তা ছাড়া বোলিং, ব্যাটিং এবং বিশেষ করে ফিল্ডিংয়ে ভালো কিছু দেখাতে পারেনি বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। খেলোয়াড়রা তাঁদের সম্পূর্ণ খেলা দিতে পারেননি। সব থেকে খারাপ লেগেছে উইকেটের পেছনে দুই দলের ফিল্ডিং দেখে। রেগুলেশন ক্যাচ ছেড়ে দিয়েছেন স্লিপে দাঁড়িয়ে থাকা ফিল্ডাররা। তার মাশুল কড়ায়-গন্ডায় শোধ দিতে হয়েছে বাংলাদেশ টিমকে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কখনই দেখে মনে হয়নি, বড় ইনিংসের জন্য মাঠে নেমেছে তারা। সত্যি বলতে, বাংলাদেশ দলকে দেখে মনে হয়নি, এত বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ সিরিজের জন্য তারা তৈরি। পরের কলকাতা টেস্টে ঘুরে দাঁড়াতে পারে কিনা এখন সেইটাই দেখার।