সে আজও আসে রংধনুর মতো ফিরে ফিরে
নিয়তি নির্ধারিত নিয়মে নতুন এক পরিবেশে এলাম। তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। সেখানে আমার ক্রিকেটে অভিষেক হলো। তবু ক্লাস ওয়ানে থাকতেই যে ফুটবলে ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল, তাও ভেতরে-ভেতরে জারি ছিল। একই ভবনের ওপেল ভাই, শ্যামলদা, রিপন, স্বপন, সুমনদের সঙ্গে বিকেলে ক্রিকেট খেলি। এদের কারও ফুটবলে ন্যূনতম আগ্রহ নেই। কী করি! কী করি! এল ১৯৯০ সাল; ইতালি বিশ্বকাপকে ঘিরে দেশজুড়ে ফুটবল উন্মাদনা। বাংলাদেশিদের আর্জেন্টিনাপ্রীতি যথারীতি তুঙ্গস্পর্শী। মূল কারণ অবশ্যই ৮৬’র তারকা ম্যারাডোনা। কেমন করে যেন খোঁড়াতে খোঁড়াতে তারা ফাইনালেও উঠে গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে গেলে সেই শোকে মুষড়ে পড়ল বাংলাদেশের কোটি ফুটবলপ্রেমী! এমনই একদিনের কথা।
সহপাঠী সুমন (মান্নান স্যারের ছেলে) খবর দিল ওরা কয়েকজন মিলে ভৈরব থেকে ডিয়ার বল কিনে আনবে। পাঁচ টাকা চাঁদা দিলে আমিও ওদের সঙ্গে মেডিকেলের মাঠে ফুটবল খেলতে পারব। ভাবলাম, যাক, আমার ফুটবল ক্যারিয়ারের পালে হাওয়া লাগল বলে। ‘ইতালিয়া ৯০’ লেখা ইতালি বিশ্বকাপের মনোগ্রাম সংবলিত আমার একটা শর্টস ছিল। সেটি পরে পরদিন বিকেলে মেডিকেলের মাঠে গেলাম। শর্টসে কোনো পকেট নাই। তাই পাঁচ টাকার রূপালি নোটটি আমার হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা। কিন্তু মাঠে গিয়ে শুনলাম ইতিমধ্যে বল কেনা হয়ে গেছে। অর্থাৎ আমি বাদ!
একটু দেন-দরবার করে আমার ভাগ্য খুলল। সুমন মধ্যস্থতা করে জানাল, আমি চাঁদা দিলে এখনো খেলতে পারব। যার হাতে টাকা দিলে ব্যবস্থা করে দেবে, তার নাম বাবুল। মো. মনিরুজ্জামান বাবুল। টাকা দিলাম, আর ওই মাঠে অভিষিক্ত হলাম। সেই থেকে বাবুলের সঙ্গে পরিচয়।
কলোনির স্বপন ভাই আমাদের নেতা। মাঝে মাঝে মণি ভাই (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ জাতীয় দলের স্ট্রাইকার, যিনি মালদ্বীপ সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন) যোগ দিতেন। বাকি সব মোটামুটি ক্লাস ফাইভ-সিক্সের ‘পোলাপান’। স্বপন ভাই সম্ভবত সেভেনে কি এইটে পড়তেন তখন। আমার চোখে তিনি বিশুদ্ধ এক ফুটবলার। আমরা কত কী যে খেলতাম; কিন্তু তাকে কখনো ফুটবল ছাড়া অন্য কিছুই খেলতে এমনকি অন্য কিছুর প্রতি আগ্রহ দেখাতেও দেখিনি। ফুটবল অন্তঃপ্রাণ বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তা-ই। তাঁর বাবা, আমাদের নিজাম চাচা একরকম শখের বশে প্রতিদিন বিকেলে কলোনির মাঠে ফুটবল কোচিং করাতেন। সবাই তাঁকে ‘কোচ’ হিসেবেই সমীহ করত। সে দিক দিয়ে স্বপন ভাই ছিলেন আমাদের মতো ছোটদের কোচ।
কোচিংয়ের ব্যাপারে স্বপন ভাইয়ের কোনো ক্লান্তি ছিল না। খেলাধুলার সার্বিক দিকগুলো তিনি খেয়াল রাখতেন। যেমন, আমি আগে বলতাম, ‘শট মারব’; তিনি ঠিক করে দিলেন, ‘কথাটা শট না, শুট।’ আমি বললাম, ‘আচ্ছা’। খেলা শেষে সারা রাস্তা বলটাকে লাথাতে লাথাতে ঘরে ফিরতাম। তা দেখে স্বপন ভাই রেগে গেলেন। বললেন, ‘স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় বই-খাতাও আমি এমন অসম্মান করে নিই কি না। আমার যা বোঝার বুঝে ফেললাম এবং তারপর থেকে বলকে যথাযথ ‘মর্যাদা’ দিয়েই মাঠে আনা-নেওয়া শুরু করলাম। স্বপন ভাই এখন অস্ট্রিয়াতে ফুটবল কোচিং করান। নিয়তি তাঁকে ঠিক জায়গাতেই পৌঁছে দিয়েছে; ভাবতে ভালোই লাগে।
আমাকে স্বপন ভাই স্নেহ করতেন, কিন্তু বাবুল ছিল তাঁর প্রিয় শিষ্য। বাবুল আমার এক ক্লাস নিচে পড়ত। সেদিন মাঠে পরিচয়ের পর বুঝতে দেরি হলো না যে, সে এক টপক্লাস বিশ্ব-বুলি! সারা দিন এর ওর পেছনে লেগেই থাকে, ছোট-বড় বাছবিচার নাই। কিন্তু সে-ই আবার খেলার মাঠে এক অন্য মানুষ। মাঝ মাঠে খেললে সৃষ্টিশীল এক প্লে-মেকার, আর ফরোয়ার্ডে খেললে দারুণ এক স্কোরার। এক অনন্য প্রতিভা! অসামান্য ম্যাচ রিডিং, ড্রিবলিং, পাসিং, শুটিং ও পজিশন সেন্স। ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়া একটা ছেলে যখন জায়গা বড় করে খেলার কথা বলে চেঁচাত, তখন বোঝা যেত তার সহজাত ফুটবল মেধা। যারা হুয়ান রোমান রিক্যুয়েলমের খেলা দেখেছেন, তারা বুঝবেন আমি কোন ধরনের ফুটবলের কথা বলছি।
বাবুলের সঙ্গে আমার পরিচয় ধীরে ধীরে বন্ধুত্বে রূপ নিল। একে অপরকে ‘দোস্ত’ বলতাম। এর উৎস খেলার মাঠেই। মাঠে স্বপন ভাই আমাকে প্রায়ই ফরোয়ার্ড পজিশনে দাঁড় করাতেন। আমার কাজ ছিল শুধু গোলে শট নেওয়া। আমি আমার কাজটি মোটামুটি দক্ষতার সঙ্গে করতাম। কিন্তু প্রধান কৃতিত্ব ছিল বাবুলের। কারণ আমি এমন সব জায়গায় বল পেতাম, যেখান থেকে একটা দুধের শিশুও গোল করতে পারত। সারা খেলায় বাবুল এভাবে আমাকে কখনো মাঝমাঠ থেকে, কখনো উইং থেকে বল জোগান দিয়ে যেত। তার সঙ্গে দোস্তি না হয়ে পারে? আমরা এতটাই ফুটবল নেশায় বুঁদ ছিলাম যে, ভোরবেলা কলোনির মসজিদে আরবি পড়তে গেলে হুজুর একটু ওদিকে গেলেই আমরা ঢুলে-ঢুলে পড়ার ভান করে খেলা নিয়ে গল্পে মেতে উঠতাম। হুজুর পড়া ধরতেন, আর ঠিকঠাক বেত পড়ত। গায়ে মাখতাম না। এভাবেই চলত।
সিক্সে উঠে বাবুল ঢাকা থেকে ফুটবলের এক জোড়া নতুন বুট কিনে আনল। শুনে আমি শিহরিত হলাম। আমার তখনো নিজের বুট হয়নি। সে আমাকে নিয়ে গেল তার নতুন বুটজোড়া দেখাতে। আমাকে অবাক করে দিয়ে ওর নতুন বুটজোড়া আমার হাতে ধরিয়ে দিল। বলল, ‘দোস্ত, তুমি আমার বুট পইরা খেলবা। না হইলে আমি এগুলি দিয়া খেলমু না।’ বড়দের সঙ্গে বড় মাঠে খেলার আমাদের যে অদম্য স্বপ্ন ছিল, বাবুলের সেটি পূরণ হতে যাচ্ছে। সে ঠিকই ধরেছিল যে, এ কারণে আমার মনে গভীর দুঃখবোধ থাকতে পারে। আসলে মহানুভবতার কোনো ন্যূনতম বয়স বা পরিবেশ লাগে না। সেদিন আমি খুব আবেগতাড়িত হয়ে আমার বন্ধুটিকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। অবশ্য আমার দুঃখ বেশি প্রলম্বিত হয়নি। মাস ছয়েক পরে আমার বিদেশ ফেরত এক মামাকে ধরে এক জোড়া নতুন বুট বাগিয়ে নিলাম। তা দেখে বাবুলের কী আনন্দ!
সে ছিল এমন এক বয়স, যখন শুধু সেই সময়ের জন্যই বাঁচতাম। আসলে তখনো জানতাম না জীবনের মানে কী। এখনো অবশ্য জানি না। তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সারা জীবন ফুটবল খেলব-রোদবৃষ্টি, ঝড়ঝঞ্ঝা যা থাকুক কপালে। সেই স্বপ্ন সত্যি করার পথে আমি মোটামুটি স্থির ছিলাম। বাবুল সেটিকে আরও উসকে দিল। একদিন পত্রিকার একটা কাটিং নিয়ে এল। বিকেএসপিতে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি। সে আবেদন করতে যাচ্ছে। আমাকে ধরল, ‘তুমিও আবেদন কর।’ মণি ভাই আগের বছর বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছেন। সেখানে জার্মান কোচ হলগার ওবারম্যানের কাছে কোচিং নিয়ে আরও তুখোড় ফুটবলার হয়েছেন তিনি। আমি ভর্তির জন্য বাবা-মায়ের কাছে আবদার করলাম, ‘আমাকেও সাভার নিয়ে যেতে হবে।’ বিনিময়ে প্রতিজ্ঞা করলাম খেলাধুলার জন্য পড়াশোনায় কোনো গাফিলতি হবে না।
আমার গাফিলতিটা ধরা পড়তে বেশি সময় লাগল না। ক্লাস সিক্সের টার্ম পরীক্ষায় অঙ্কে ফেল করলাম। এর জন্য প্রশ্নকর্তা সোহরাব স্যারের প্রতি আমার রাগটা এখনো পড়েনি। কী দরকার ছিল এমন খটমট প্রশ্ন করার! তখন একটা নিয়ম ছিল, পরীক্ষার খাতা বাবাকে দেখাতে হবে। আমাকেও দেখাতে হলো। বাবার অগ্নিমূর্তি দেখে বিষম খেলাম। সত্যি বলতে কি, আমার বাবাই ছিলেন আমার ফুটবল, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলার প্রথম তাত্ত্বিক শিক্ষক। বিকেএসপিতে আমার ভর্তির জেদকেও তিনি এত দিন প্রশ্রয় দিচ্ছিলেন। কিন্তু এভাবে ৩০ পেয়ে অঙ্ক পরীক্ষায় ফেল করা ছিল একরকম প্রতারণার মতো। ক্লাসের পরীক্ষায় ফেল মেরে ফুটবলের মাঠে পাস করলেও বাঙালি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে কোনো ক্ষমা পাওয়া যায় না। আমিও পেলাম না। ফুটবলে নিষেধাজ্ঞা এল; চাপ বাড়ল পড়াশোনার।
আমি ফুটবলের ওই গ্রুপটা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে লাগলাম, আর ক্লাসের ‘পড়ুয়া, ভালো ছেলেদের গ্রুপে’ ভিড়ে গেলাম। খেলার সঙ্গে সংযোগের সুতোটা ক্লাস সেভেন-এইটে এসে কেটেই গিয়েছিল। শুরু হলো অন্য জীবন। এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে উঠছি, পরিবারের নানা কাজে ব্যস্ত হচ্ছি। কখনো বাবার ব্যবসায় খাটছি। এ সব কারণে দোস্ত বাবুলের সঙ্গে কালেভদ্রে দেখা হয়। বেশির ভাগ সময় তাকে মাঠেই পাই। তত দিনে সে বিশাল নাম করে ফেলেছে। ওই বয়সে প্রায় পুরো জেলাই তাকে চেনে! এমনকি অন্য জেলা থেকেও ডাক আসে নানা স্কুল প্রতিযোগিতায় খেলার জন্য। কখনো ‘সর্বোচ্চ গোলদাতা’, কখনো ‘ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়’, কখনো ‘টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়’ ইত্যাদি পুরস্কার জিতে আসছে সে। স্কুল শেষে সামনের মাঠে বসে বসে আমাকে সেই গল্পগুলোর আদ্যোপান্ত জানাত। তার চোখমুখ অর্জনের গর্বে ঝলমল করত। গোলের বর্ণনা দিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে যেত বারবার। আর আমি রোমাঞ্চিত হতাম; ভেতরে-ভেতরে দীর্ঘশ্বাস লুকাতাম! লেখাপড়ার রোলার কোস্টারের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে তত দিনে আমার খেলার গতি কমে গিয়েছিল।
যথারীতি বাবুল বিকেএসপিতে চান্স পেল। ভর্তি হয়ে সে একদিন কলোনি ছেড়ে চলে গেল। তারপর থেকে সে শুধু ছুটিতে এলে মাঝে-মধ্যে দেখা হতো; কিন্তু খুবই কম। আমাদের বন্ধুত্ব থেকে শৈশবের সেই মিলের জায়গাগুলো কেমন করে যেন ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল। সে তখন পুরোদস্তুর খেলোয়াড়, আর আমি চশমা পরা পুরোদস্তুর ছাত্র। আমি এই পরিচয়ে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি, আর দেখছি আমার বন্ধুটিকে আমার কাঙ্ক্ষিত জীবনটি যাপন করতে। কখনোই ঈর্ষা হয়নি, গর্বিত হতাম। পারস্পরিক শ্রদ্ধার জায়গাটাতে কখনো টান পড়েনি। আমি একবার স্কুলে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক হলাম। সে তখন ছুটিতে ফিরেছে। আমাকে নিয়ে তার সে-কী উল্লাস! যার যার রিদম ঠিকঠাক থাকলেও হারমনিতে তবু গন্ডগোল হচ্ছিল; হয়তো সেটাই স্বাভাবিক।
কলেজে ভর্তি হয়ে আমি ঢাকায় অভিবাসী হলাম। আমার শৈশব-কৈশোরের প্রাণের মফস্বল শহর, প্রিয় নদী, বন্ধু-বান্ধব, আর হাসি-আনন্দের স্মৃতিগুলোকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিতে লাগল মহানগরীর পোড়া ডিজেলের গন্ধ আর কালো ধোঁয়া। জীবন মানে তখন ক্লাস, বইখাতা, আর পরীক্ষা। এল ১৯৯৭ সাল; এপ্রিলের ২৭ তারিখ। সকালে নাশতার টেবিলে ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় একটা খবর দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। ‘বিকেএসপির প্রতিভাবান ছাত্র ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তরুণ উদীয়মান খেলোয়াড় মনিরুজ্জামান বাবুল ছুরিকাঘাতে নিহত!’ সে সেবার ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিল। সম্ভবত কোনো একটি মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় বচসার জের ধরে স্থানীয় বখাটে কিছু তরুণ তার বুকে ছুরি মারে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার।
আমি ভাগ্যান্বেষণে এখন দেশ থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আমার শৈশবের প্রাণের বন্ধুকে কখনোই ভুলিনি। সে এখনো রংধনুর মতো ফিরে ফিরে আসে, তা থেকে আমার কখনো মুক্তি নেই।
‘April is the cruelest month, breeding
Lilacs out of the dead land, mixing
Memory and desire, stirring
Dull roots with spring rain.
Winter kept us warm, covering
Earth in forgetful snow, feeding
A little life with dried tubers’