অনেকে বলেন, খ্যাতির মধ্যগগনে থেকে যিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, তাঁকে মনে রাখে মানুষ। পৃথিবীতে কারও অকালমৃত্যু কাম্য নয়। সুচিত্রা সেন অকালে মারা যাননি। তিনি ৮২ বছর বেঁচে ছিলেন। তবু তাঁর বার্ধক্যের নয়, সবার মানসপটে চিরজাগরূক যৌবনের মোহনীয় ও শাশ্বত বাঙালি রূপ। কারণ তিনি জানতেন, কখন থামতে হয়। কতটুকুতে সন্তুষ্ট হতে পারে একজন মানুষ। পশ্চিম বাংলার আরেকজন নামকরা অভিনেত্রী মাধবী চট্টোপাধ্যায় আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘উনি (সুচিত্রা) জানতেন, কখন থামতে হবে। আমরা অনেকে তা পারিনি। আসলে এই থেমে যাওয়াটাও জীবন ও শিল্পের অনুষঙ্গ। থামতে না জানলে পচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।’
পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়াতে যেখানে আমার জন্ম, তার খুব কাছেই সুচিত্রা সেনের দাদাশ্বশুরের বাড়ি। গেন্ডারিয়াকে আবাসিক এলাকার রূপ দেওয়ার পেছনে মানিকগঞ্জের জমিদার দীননাথ সেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রেখেছিলেন। ওনার নামে গেন্ডারিয়াতে একটা রাস্তার নাম আছে। সেই রাস্তার ওপরে গেন্ডারিয়া হাইস্কুল ছিল দীননাথ সেনের জমিদার বাড়ি। ওনার নাতি দিবাকর সেনের সঙ্গে বিয়ের পরে সুচিত্রা সেন কিছুদিন সেই জমিদার বাড়িতে ছিলেন। ছোটবেলায় অন্য এলাকা থেকে কেউ বেড়াতে এলে ইনিয়ে–বিনিয়ে সেই কথা বলতাম। আমরা সুচিত্রা সেনের শ্বশুরবাড়ির এলাকার মানুষ, এটা কি কম গর্বের ব্যাপার! ৬ এপ্রিল সুচিত্রা সেনের জন্মবার্ষিকী। ভেতর-বাইরের শূন্যতার মধ্যে কদিন ধরে খুব মনে পড়ছে তাঁকে।
মোট ৬১ সিনেমায় অভিনয় করলেও সুচিত্রা সেন বেশি বিখ্যাত হয়েছেন উত্তমকুমারের সঙ্গে জুটিবদ্ধ সিনেমাগুলোতে। ২৫ বছর সিনেমাতে অভিনয়ের পর ১৯৭৮ সালে চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরে যান তিনি। এরপর আর তাঁকে জনসমক্ষে দেখা যায়নি। এ সময় তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায় ব্রতী হয়েছিলেন বলে শোনা যায়। ২০০৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য সুচিত্রা সেন মনোনীত হয়েছিলেন, কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে সশরীরে পুরস্কার নিতে দিল্লি যেতে আপত্তি জানানোর কারণে, তাঁকে পুরস্কার দেওয়া হয়নি।
দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পাওয়া যেকোনো ভারতীয়র জন্য আজীবনের স্বপ্ন। কেবল সশরীরে যাবেন না বলে সুচিত্রা সেন পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। যেটা সবাই পারেন না। পুরস্কার প্রত্যাখ্যান দূরের কথা, এলেবেলে একটা পুরস্কার জেতার জন্য কতজনের কত রকম তৎপরতা চলে। আর একটা না হলে, অন্য আরেকটা পুরস্কার তাঁরা ঠিকই জিতেই ফেলেন। কারণ এখন একজন শুধু সিনেমার নায়িকা হয়েই যথেষ্ট নন। টেলিভিশনেরও নায়িকা। আবার উপস্থাপনা, গান করা, নৃত্য পরিবেশন, কবিতার বই বের করা সবই করেন। নতুন আগতদের জায়গা করে দিতে চান না। সবকিছু তাঁরা হাতের মুঠোয় রাখতে চান। অভিনেত্রী, উপস্থাপিকা, নৃত্যশিল্পী, সংগীতশিল্পী, আবৃত্তিকারসহ সর্বগুণে গুণান্বিতা তাঁরা!
সুচিত্রা সেন সিনেমা ছাড়ার পর প্রায় ৩৫ বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন। এমনকি মৃত্যুকালে কফিনেও ছবি তোলার সুযোগ পাননি কেউ। এই যে রহস্যময়তা, এই যে আড়াল—এটাই তাঁকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে করে তুলেছে দুর্লভ-আকর্ষণীয়। সুচিত্রার ছিল সুকঠিন ব্যক্তিত্ব। সবার সঙ্গে তিনি মিশতেন না। সত্যজিৎ রায়, গুলজার, রাজকাপুরের মতো মানুষের ছবিও তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর রোমান্টিক সম্পর্ক নিয়ে চলেছে নানা জল্পনা-কল্পনা, সুচিত্রা সেসব নিয়ে কোনো উত্তর দেননি।
পুরোনো দিনের এক সিনেমা তারকার সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম, তিনি কখনো স্টেশনে তেল নেওয়ার সময় গাড়ি থেকে বের হতেন না। কারণ ওখানে সবাই তাহলে তাঁকে দেখে ফেলবে। উনি বলতেন, ‘সবাই যদি আমাকে বিনা খরচেই দেখে ফেলে, তাহলে আর টাকা খরচ করে টিকিট কেটে হলে কেন দেখতে যাবে।’ হ্যাঁ, এটাকে কারও কাছে স্টান্টবাজি মনে হতে পারে। কিন্তু তারকারা যত তাঁদের চারপাশে রহস্যের মেদুরতা সৃষ্টি করে রাখবেন, ততই তাঁদের প্রতি ভক্তকুলের আকর্ষণ বাড়ে। সুচিত্রা সেন সেটা পেরেছেন। উনি লোভকে জয় করতে পেরেছেন। উনি জানতেন কোথায় থামতে হয়। চাইলেও কেউ সুচিত্রা সেন হতে পারে না।