লিমন যখন 'অনুপ্রেরণা'
আমরা এই এক জীবনে আমরা কতবার হোঁচট খেয়ে পড়ি, আবার ঘুরে দাঁড়াই—তা আমরা নিজেরাই টের পাই না। জীবন একটি বিশাল আকাশের মতো। এই আকাশে নীলের মতো দেখতে একগুচ্ছ সুখ আবার সুখের রেশ কাটতে না কাটতে নীল আকাশে শুরু হয় কালো মেঘের খেলা।
সেই মেঘের মাঝে বৃষ্টি আবার রোদের ঝিলিক। তবে নীল আর কালো খেলার সঙ্গে জীবনকে যতটাই না মিলিয়ে নিই না কেন, বাস্তবতা ভিন্ন।
সেই ভিন্ন গল্পের আজকের বিষয় ‘অনুপ্রেরণা’। অনুপ্রেরণা নিয়ে লিখতে গিয়ে ক্লাইভ জেমসের বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে গেল। ‘বিখ্যাত না হয়ে জীবন কাটালেও সুন্দর জীবন কাটানো সম্ভব, কিন্তু জীবনের মতো জীবন না কাটিয়ে বিখ্যাত হওয়া কখনো সুন্দর জীবন হত না।’
সেই উক্তি অনেকেই হয়তো জানেন না, তবে কখনো কখনো নিজেরাই সেই বাক্যগুলোর মতো বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। সেই রকম একটি গল্প রচিত হলো বাংলাদেশে।
খুবে বেশি আগের ঘটনা নয়। খবরের পাতায় আর টেলিভিশনে সম্প্রচারিত একটি ঘটনা সবার মনে গেঁথে গিয়েছিল। নাম লিমন হোসেন। ১৬ বছরের দরিদ্র কিশোর র্যাবের গুলিতে পা হারিয়েছিল ২০১১ সালের ২৩ মার্চ। ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম সাতুরিয়ায় নিজের বাড়ির পাশে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল লিমন। এ কারণে ওই বছর সে আর এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারেননি। বাড়ির পাশের মাঠ থেকে গরু আনতে গেলে র্যাবের সদস্যরা তাঁকে ধরে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করেন বলে অভিযোগ ওঠেছিল।
সেই প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে কিশোর বয়সে ভেঙে পড়ার কথা, নিজেকে নিয়ে যখন আগামীর স্বপ্ন নিয়ে পথচলা শুরু করবে, ঠিক তখনই মাঝপথে হারিয়ে ফেলল ‘পা’। মৃত্যু হলো একটি স্বপ্নের, পরিবারের মাঝে সেই নীল আকাশের কালো মেঘের ভাঁজ। লিমন হল পঙ্গু, সমাজের চোখে বিনা দোষে র্যাবের একটি ভুলের কারণে বরণ করে নিল পঙ্গুত্ব। আবার ২০১৮ সালের অক্টোবরে সাভারে একদল উম্মত্ত গ্রামবাসী পা হারানো লিমনের হাত ভেঙে দেয়।
কিন্তু লিমনরা যে একবারই আসে আর সমাজে হাজার লিমনদের অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করে। যে লিমন বিচারের বদলে পেয়েছেন নিগ্রহ, তাও খোদ রাষ্ট্রের কাছে থেকে। কিন্তু লিমনকে দমিয়ে রাখা যায়নি। অদম্য সেই ১৬ বছরের লিমন এখন আইনের শিক্ষক। সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে শিক্ষকতা করছেন তিনি। একই প্রতিষ্ঠানে আইন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছেন লিমন।
লিমনের আজকের এই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পে আমেরিকান সাংবাদিক, লেখক ও নোবেলজয়ী আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একটি উক্তি মনে পড়ে গেল। ‘মানুষ পরাজয়ের জন্য সৃষ্টি হয়নি। তাকে হয়তো ধ্বংস করা যায়, কিন্তু হারানো যায় না।’
এই উক্তির হুবহু মিল যেন লিমনের মধ্যে খুঁজে পেলাম। লিমন পা হারিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু পঙ্গুত্ব বরণ করে পরাজয় মেনে নেননি। সেদিন হয়তো সে মরে যেতে পারত, কিন্তু বেঁচে গিয়ে আমাদের সমাজে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ইচ্ছাশক্তি থাকলে হারানো সম্ভব নয়। যে পরিবার সন্তানের পঙ্গুত্ব দেখে বাকিটা জীবন হতাশায় কাটাবেন বলে ভেবেই নিয়েছিল, সেই লিমন আজ হাজারো পরিবারের অনুপ্রেরণা। ১৬ বছর বয়সে পা হারানোর যন্ত্রণায় হাসপাতালের বিছানায় যখন কাতরাচ্ছিলেন অশুভ এক আগামীর লক্ষ্যে, সেই যন্ত্রণার মাঝেই কিন্তু খুঁজে পেলেন নতুন জীবনের।
হাসপাতালের বিছানা থেকে জিপিএ-৪ পেয়ে এইচএসসি পাস করেছেন। রাষ্ট্রের নিষ্ঠুরতার শিকার এই তরুণ স্বপ্ন দেখতে থাকেন আইন বিষয়ে পড়াশোনা করার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন, সুযোগ পাননি। তবে আইন বিষয়েই তিনি সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হলেন গণবিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি লিমনের। রোজ রোজ লিমনের মতো অনেকের জীবনে এমন ঘটনা ঘটছে, কিন্তু প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এ কারণে একটা সময় অনেকই নানা অজুহাতে হতাশার দিকে ঝুঁকছেন! আর সেই সময় একটা মানুষ যদি অনুপ্রেরণার দেবদূত হয়ে আবির্ভাব হন, তবে সেই গল্পের বাকিটা ইতিহাসও হয়।
লিমনের গল্পের পেছনের কারিগর ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। লিমনকে সযত্নে গড়ে তোলার বড় দায়িত্বটা পালন করেছেন তিনি। তাঁর গড়া গণবিশ্ববিদ্যালয়ে লিমনের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছেন। তাকে জুগিয়েছেন অদম্য সাহস, অনুপ্রেরণার দেবদূত হয়ে তৈরি করেছেন আজকের লিমনকে।
আমাদের বর্তমান সমাজে অনেকেই মোটিভেশনাল কথা বলেন, আবার এসব কথা বলে পেটও চালান। আমরা অনেকেই তাদের কথা শুনে অনুপ্রাণিত হই। কিন্তু বেশির ভাগ সময় আমরাই বলি, এসব কথা বলে কি জীবন চলে?
হ্যাঁ সত্যি, এসব কথা বলে জীবন চলে না। তবে জীবনকে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে নিজেকেই তৈরি করতে হবে। আমাদের জীবন ভালো–মন্দ মিলিয়েই। খারাপ সময়টা যে খুব কাছ থেকে হতাশার মাঝে আলোর পথ দেখাবে, সেই আলোর পথে বাতিটা নিজেকেই জ্বালিয়ে রাখতে হবে। নয়তো যতই অন্যের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হন না কেন, হতাশার কালো মেঘের আকাশ আর নীল হবে না।
লিমন নিজে তাঁর লক্ষ্য ঠিক রেখে পঙ্গুত্ব নিয়ে লড়াই করেছেন। সেই লিমনের আগামীর পথ তৈরি করতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর সেই বাড়ানো হাতে অনুপ্রেরণার নতুন গল্প শুরু। সবশেষে এটাই বলব, আমাদের জীবনে চলার পথ কোন না কোনোভাবে নানা সমস্যায় জর্জরিত। জীবনে চলতে গেলে সমস্যা থাকবে, সমাধান নিজেরই খুঁজে বের করতে হবে। জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না, শুধু নিজে চেষ্টা করে এগিয়ে নিতে হয়। যদি নিজের ইচ্ছাশক্তি প্রবল হয়, তবে কেউ ক্ষতি করলেও আপনার জীবনটাকে নতুন করে দাঁড় করানোর সাপোর্ট নিজেই মনে করুন। আর সেই বিশ্বাস, ধৈর্য, দৃঢ় মনোবল থাকলে লিমনের মতো সাফল্যের লক্ষ্যে পৌঁছতে বেশি দিন সময় লাগবে না।