যৌবন: জীবনের দুরন্ত অধ্যায়
মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে যৌবন। যৌবন একজন মানুষের জীবনের এক কথায় সবচেয়ে সুখময়, স্বপ্নময়, আনন্দময়, গভীর অর্থপূর্ণ ও তাৎপর্য সময়। সৃষ্টি ও কর্মকুশলতায় জীবনের দুপার উপচে পড়া যৌবনকালই একজন মানুষের জীবনের অর্থ-অনর্থের মূল, উত্থান-পতনের আঁধার। মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনের অট্টালিকাটি যৌবনের কর্ম, চেষ্টা সময়ের সদ্ব্যবহার, উপলব্ধি ইত্যাদির মাধ্যমেই গড়ে ওঠে। অর্থাৎ যৌবনের ছোঁয়াতেই মানবজীবনের মূলভিত্তি গড়ে ওঠে।
মানুষকে জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আশা-নিরাশা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির যে অম্লমধুর ফলাফল ভোগ করতে হয়, তা নির্ভর করে যৌবনে করা কর্ম-অকর্ম ও বোধশক্তির ওপর। যৌবন এক ধরনের দর্পণ। একজন মানুষের যৌবনের কাজের প্রতিফলনই তার ভবিষ্যৎ জীবনে ফুটে ওঠে। মানুষকে নিজের জীবনটা মসৃণভাবে এবং সুন্দর ও কোনো জটিলতা ছাড়া এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে তাকে যৌবন থেকেই যত্নবান, তৎপর হওয়া খুব জরুরি। অন্যথায় জীবনে ভোগ করতে হয় নানা সমস্যা। আর সে সব সমস্যা মোকাবিলা করতে হলে একজন মানুষকে প্রবল আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। নতুবা সে সমস্যার মুখোমুখি হওয়াটা তার কাছে বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
যে সব মহান ব্যক্তি কিংবা লেখক-সাহিত্যিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁদের ১০ ভাগের ৯ ভাগই যৌবনের মূল ভিতটা গড়ে তুলেছিলেন শক্ত ভাবেই। আর সেই যৌবনে করা কাজই তাদের জীবনকে সৌন্দর্যময় ও অর্থবহ করে তুলেছিল। এমন অনেক ব্যক্তিত্ব আছেন যারা যৌবন থেকেই তাঁদের রচিত অসংখ্য রচনা আমাদের সাহিত্য সম্ভারে রেখে গেছেন। এর মূল কারণ হচ্ছে, তাঁরা তাঁদের যৌবনের সদ্ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। যৌবনের অজেয় তেজ-বল-শক্তিকে তাঁরা হেয় না করে, সে শক্তিকে তাঁরা সৃষ্টিশীল কর্মে রূপান্তরিত করেছিলেন। এক কথায় যৌবনের সব শক্তিকে সৃজনশীলতার অম্লান শক্তিতে পরিণত করেই তাঁরা বিখ্যাত হয়েছেন।
বর্তমান সময়ের বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী যৌবনের সর্বাঙ্গ সুন্দর সময়টুকু পার করে দেয় শুধু আনন্দের সন্ধানে, ফুর্তি-তামাশায়। সৃষ্টিশীল ও স্থায়ী কর্মের সৃষ্টিতে খুব কমসংখ্যক মানুষকে লেগে থাকতে দেখা যায়। অনেকে আবার বিভিন্ন ধরনের নেশা সেবনের মাধ্যমেই যৌবনের সৌন্দর্যময় দিনগুলোকে কাটিয়ে দিতে চান। এসব কিছু জীবনে খুব কম সময়ের জন্যই তাদের আনন্দ দিয়ে থাকলেও ভবিষ্যতের জন্য বিপদের সন্দেশ নিয়ে আসে, আবার অনেক সস্তা চলচ্চিত্র, বই ইত্যাদির মাধ্যমে জীবনের মহামূল্যবান সময় পার করে যৌবনের সুন্দর সময়টুকুতে শুধু কিছু অর্থহীন কাজে ব্যস্ত রাখতে ভালোবাসেন। যৌবনের সৃষ্টিক্ষম সময়টুকু অর্থহীনভাবে পার করে দেওয়ার মাধ্যমে তারা পার করে দেয় তাদের যৌবনের মহামূল্যবান সময়ের সৌন্দর্য। এতে তাদের ধ্যানধারণার স্বল্পতারই পরিচয় পাওয়া যায়। একটি অর্থপূর্ণ, সফল তথা জীবনের মূল আঁধার যে যৌবনকাল, সেটি তারা একবারের জন্যও তাদের সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে ভেবে দেখে না। চিন্তা শূন্যভাবে শুধু আনন্দের মধ্য দিয়ে সময় পার করে দেয় বলে তারা প্রকৃত অর্থে জীবন গড়ার ক্ষেত্রে একবারও চিন্তা করে দেখে না।
তবে সময় পেরিয়ে গেলে বারবার তাদের ‘এটা হলো না’, ‘এটা করতে পারলাম না’, ‘সিস্টেম খারাপ’, কপাল মন্দ, ‘আমার ক্ষেত্রেই এমন হয়’—ইত্যাদি ভাবনা দেখা দেয়। তারা তখন হীনম্মন্যতায় ভোগে। এর ফলে তারা কর্মোদ্যমহীন হয়ে পড়ে। তখন এমন কাজ করে বসে যা মোটেই উচিত নয়। যৌবনে করা এ ধরনের কিছু কাজের জন্য তারা জীবনের পরবর্তী সময়ে অনুশোচনা করে, অনুতপ্ত হয়। যদিও সে সময় অরণ্যরোদন ছাড়া আর কিছুই নয়। সে সময় অনুতাপ করলেও তার কোনো অর্থ থাকে না।
যেহেতু যৌবনের সময়টুকু জীবনের মূল আঁধার, তাই প্রত্যেক তরুণ-তরুণীকে একটা সফল, অর্থপূর্ণ, সৌন্দর্যে ভরপুর জীবন গড়তে, জীবনের প্রকৃত সুধা পান করতে হলে জীবনের তাৎপর্যকে অনুধাবন করতে হবে, তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। যৌবনের সব চঞ্চলতাকে সংযম আর সৃষ্টিশীল কর্মের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যৌবনে অহর্নিশ একটি সৃজনশীল ও অর্থবহ কাজে সময় ব্যয়ে যত্নশীল হওয়া খুবই প্রয়োজন। কারণ অনুপম জীবনের সৃষ্টির যৌবনই হচ্ছে প্রকৃত যৌবন।