মানসিকতার বদল জরুরি

রাজা বলিলেন, ‘এমন পাখি তো কাজে লাগে না, অথচ বনের ফল খাইয়া রাজহাটে ফলের বাজারে লোকসান ঘটায়।’
মন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘পাখিটাকে শিক্ষা দাও।’
রাজা এ কথা বলার পর পাখিটি শেষমেশ কী শিক্ষা পেয়েছিল তা যাঁরা রবীন্দ্রনাথের তোতাকাহিনি পড়েছেন, তাঁদের সবারই জানা। মুখস্থসর্বস্ব বিদ্যাশিক্ষাকেই আমরা চিরকাল মেধার পরিমাপক হিসেবে ধরে এসেছি। মান্ধাতা আমলের এই মানসিকতার সঙ্গে জুটেছে সন্তানের মাধ্যমে নিজের অসাফল্যকে পূরণ করার এক অদ্ভুত প্রবণতা। যেখানে সন্তান কী চায় তার চেয়ে মুখ্য বিষয় হলো তার অভিভাবক কী চান!
নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের জুইশ সেন্টারে স্ট্যান্ড আউট মেন্টোরিং অ্যান্ড টিউটোরিংয়ের উদ্যোগে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষক সম্মেলনের আলোচনা ও কথাবার্তা সেটাই স্মরণ করিয়ে দিল। অনুমিত ছিল, অভিভাবকদের এই প্রবণতা বাংলাদেশ তথা এই ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা জানান দিল, অভিভাবকেরা এটা দেশে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে যেতে পারেননি, সঙ্গে করে মার্কিন মুলুকে নিয়ে গেছেন। আর এর কুফল ভুগতে হচ্ছে তাঁদের সন্তান অর্থাৎ নতুন প্রজন্মকে।
সন্তানকে নামী স্কুলে পড়াতে হবে, ভালো বিষয়ে (যে ধারণা জন্মভূমি সূত্রে প্রাপ্ত) পড়াতে হবে। কারণ, তাহলেই সন্তানকে নিয়ে তিনি অন্যের কাছে গর্ব করতে পারবেন। নামী বলে দূরের স্কুলে সন্তানকে পাঠানো ভালো না, বাড়ির পাশের স্কুলে পাঠানো শ্রেয়—এই বিতর্কের একটা সমাধান কিন্তু ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরাই দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের দেওয়ান আহমেদের বক্তব্যটাই দেখুন। তিনি বলেছেন, তিনি বিশেষায়িত স্কুলে সুযোগ পেলেও সেখানে না গিয়ে বাড়ির কাছের স্কুলে যান। আর তাই কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে বিনা খরচে পড়াশোনা শেষ করেন। এটাই হয়তো বাস্তবতা।
সমস্যার আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত আরতি প্যাটেল। তাঁর কথায়, ‘আমাদের অভিভাবকদের একটা বড় সমস্যা, সন্তানকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করা। অন্যের সন্তানের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে নিজের সন্তানের ভালো-মন্দের বিচার করেন না। সন্তানের জন্য কোনটা ভালো বুঝতে হবে, অন্যের কাছে গর্ব করা বড় নয়।’ ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস থেকে পড়া আরতি যেটা খুব সহজে জীবন দিয়ে বুঝলেন, তাঁর অভিভাবকেরা তা হৃদয়াঙ্গম করতে অক্ষম।
সন্তানের ভবিষ্যৎ মঙ্গল কামনায় আকুল মা-বাবা বাজারের চাহিদার কথাও মাথায় রাখছেন না। বুঝতে চেষ্টা করছেন না আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে। ফেলে আসা দেশের চশমা দিয়েই সবকিছু দেখছেন। যে কারণে খোদ আমেরিকায়ও কোচিং সেন্টারের রমরমা বাড়ছে। এসবের জন্য অভিভাবকদের পুরোপুরি দায়ী করা ঠিক হবে না। তাঁরাও বহুযুগের লালিত বিশ্বাস-পদ্ধতির অনুকরণ করছেন মাত্র।
কিন্তু নতুন দেশে তাঁদেরও বদলাতে হবে। ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ এটা মেনে নিতে হবে। শুনতে হবে সন্তানের কথা।