মহাশান্তি!
মিনা ও তার স্বামী অরুণ বসেছে চালকের পেছনে তৃতীয় সারিতে। জানালার কাছে মিনা। অরুণ ভাবছে ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে এ পথটুকু আসতে প্রায় আধা ঘণ্টা চলে গেছে! ফার্মগেট পৌঁছাতে আজ রাত ক’টা বাজবে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন!
আজ এত ভিড় কেন?
অরুণের চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি।
তোমার ভিড় কবে কম থাকে বলো? বাইরের দিকে তাকিয়ে মিনা পালটা প্রশ্ন করে।
উফ! গরমে দম বেরিয়ে যাচ্ছে! অরুণ হাঁস ফাঁস করছে। অবস্থা চরম!
তোমার যা দম! এই আসে! আর এই যায়!
দেখছ না কেমন করে বান্দরের মতো মানুষ উঠছে। পারলে জানালা দিয়েও ঢোকে।
আস্তে! কী কও! বান্দর আবার কী! মানুষে শুনলে...
শুনুক। আমার তোমার মতো সবারই খারাপ লাগছে। সবারই শরীর-মনের একই অবস্থা। বাসের ভেতর এক ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা নেই! তারপরও শালা হেলপার বেহুঁশ হয়ে ‘ডাইরেক্ট ফার্মগেট মিরপুর’ চিল্লাচ্ছে! শা...লা!
তোমার মতো আমার এত খারাপ লাগছে না। বাসের অন্যরাও তোমার মতো এমন বিরক্ত হচ্ছে না। শোন। যে দেশে তুমি বাস করছ; যেখানেই যাও এমনই হবে। এটাই বাস্তবতা। সবই মানিয়ে নিতে হবে তোমাকে।
দেখেছ রাস্তার অবস্থা! পুরো রাস্তা জুড়েই দুনিয়ার মানুষ। দোকানপাট। ফেরিওয়ালা। উপচে পড়া ডাস্টবিনের ময়লা আর রিকশা! তোমার বাসটা যাবে কোথা দিয়ে? জায়গা আছে? অসহ্য!
রায় সাহেব বাজারের মোড় ঘুরে একটু সামনে এগোতেই মিনা আর্তনাদ করে ওঠে, ‘ও মাগো! এই! এই আমার সোনার চেইন! সোনার চেইনটা নিয়ে গেছে!’
কী! কী নিয়ে গেছে বললে? সোনার চেইন? এই ড্রাইভার বাস থামাও! ছিনতাইকারী আমাদের সোনার চেইন ছিনাইয়া নিয়া গেছে!
বলে কি! ছিনতাইকারী! সোনার চেইন...!
চকিতেই অরুণের দু’চোখে রাশি রাশি সরষে ফুলের ঝলকানি!
বাসের ভেতর অসহ্য গুমোট কোলাহল। হাঁচি। কাশি। হাসাহাসি। আবার মোবাইলে চিৎকার চেঁচামেচি। সে এক ধুন্ধুমার অবস্থা! কার কথা কে শোনে! মিনা যে এ রকম কাণ্ড ঘটাবে, এটাই স্বাভাবিক!
আমার সোনার চেইন! গত সপ্তায় এখানেই এক হিন্দু মহিলার চশমা টেনে নিয়েছে! ও মা!
নিবে না? সোনার চেইন পরে তা সবাইকে না দেখালে কি হয়? নেও। তোমার এ সোনার দেশে এ রকমই তো হবে। সোনার চেইন নিবে। মানিব্যাগ নিবে। চশমা ছিনাইয়া নিবে। আবার ইজ্জতও নিবে। এটাই স্বাভাবিক! বাস্তবতা!
হ্যাঁ। এটাই স্বাভাবিক। তুমি কথা বেশি বল! কোথায় একটু সমবেদনা দেখাবে! তা-না। যত্তসব!
অরুণের টিটকারি সহ্য হচ্ছে না মিনার। ডান হাতের আঙুল দিয়ে বারবার গলা হাতায়। ‘হায় ঈশ্বর! সত্যি আমার চেইনটা নিয়ে গেছে!’ বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে তার। ‘কী সাংঘাতিক!’ দু’চোখ থেকে দর দর করে পানি গড়িয়ে পড়ে।
ঘটনার আকস্মিকতায় পাশে দাঁড়ানো এক যুবা বয়সী যাত্রী চিৎকার করে ওঠে, ‘এই ড্রাইভার। বাস থামাও। থামাও বলছি।’
বাস থামে।
ভেতরে সেই রকম ঠেলাঠেলি আর ধাক্কাধাক্কি। অরুণের পেট গুলিয়ে আসে। বমি হয় হয় অবস্থা!
ওস্তাদ! শালারে ধরছি! শালায় সোনার চেইন ছিনতাইকারী!
রাস্তায়, পেছন দিক থেকে ত্রস্ত ব্যস্ত হেলপার লোকটা দৌড়ে এসে চালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ওই কাদিরা! অরে আমার চাক্কার সামনে হুতাইয়া দে। বাস দিয়া মন ইচ্ছা মতো একটা ডলা মারি আমি! এই, কার চেইন নিছে?
হ্যাঁ। হ্যাঁ। এই যে, আমাদের চেইন!
অরুণ গলা উঁচু করে সাড়া দেয়।
সোনার চেইনের মালিক, আপনেরা নামেন। নাইমা ইচ্ছা মতো শায়েস্তা করেন।
এই মিনা। নামো। শালায় ধরা খাইছে! অরে আইজ মন ইচ্ছা মতো সাইজ করুম!
কী খালি ‘শালা শালা’ করতেছো?
মিনা চোখের পানি, নাকের পানি শাড়ির আঁচলে মোছে।
ওই শালারে শালা কমুনা তো কি সুমুন্ধি কমু?
কথা বাড়ায় না মিনা। তেছরা চোখে স্বামীর দিকে তাকায়। চাহনিতে তার গায়ের সব রাগ ঝরে পড়ছে, অরুণ বুঝতে পারে।
যাত্রীদের ঠেলে ঠুলে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে বাসের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয় দু’জনে। নিজের গা থেকে ঘামের বিচ্ছিরি গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারে অরুণের।
ওই দেখ! ঠিকই ধরা খাইছে শা...! অরে আইজ... ...।
দু’জনেই তাকিয়ে দেখে জমাট মানুষের মধ্যিখানে ইট সুড়কিময় এবড়োখেবড়ো রাস্তার ওপর লম্বা হয়ে পড়ে আছে জীর্ণশীর্ণ হাড্ডিসার মাঝ বয়সী এক মানব কঙ্কাল। পরনে শুধু ময়লা ছিন্ন কালো ট্রাউজার। গায়ে কোনো জামা নেই। উসকো খুসকো চুল দাঁড়িতে মুখাবয়ব পুরোটাই প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে তার।
এই আপনারা একটু জায়গা দেন তো। শা...রে নিজের পায়ে মন ইচ্ছা মতো একটা মুড়া মারি। সোনার চেইনের সাধ জন্মের মতো মিটাইয়া দেই! শা…!
এই এই! করছ কী তুমি? তুমি ওকে মারতে যাও কেন?
না মারুম না। অরে জামাই আদর করুম!
সরেন। সরেন তো ভাই।
দু’জন মাস্তান ধরনের পুরুষ এক রকম গায়ের জোরেই ভিড় ঠেলে জটলার ভেতর ঢুকে পড়ে।
টকটকে লাল শার্ট পরিধায়ী আস্তিন গুটিয়ে ধরাশায়ী মানব কঙ্কালটি টেনে দাঁড় করায়। গাঢ় সবুজ গেঞ্জি দু’হাতে কঙ্কালের চুল দাঁড়ি বুলিয়ে বলে, ‘শালা ডাইলখোর! তুমি মানুষ চিনোনা! আহো। তোমারে হেদায়েত করি। এই ভাই, জায়গা দেন তো!’
ততক্ষণে নীল খাকি দুই পুলিশ অকুস্থলে এসে হাজির। ওদিকে ‘পঙ্খীরাজ’ ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।
এই যে পুলিশ ভাই। দেখেন, সোনার চেইন ছিনতাইকারী! আস্তা ডাইলখোর!
লম্বা চুলের কালো গেঞ্জিপরা লোকটা ধাক্কা দিয়ে পুলিশদের মুখোমুখি দাঁড় করায় অভিযুক্তকে।
আর এই যে, ইনাদের সোনার চেইন!
আপনাদের সোনার চেইন?
পুলিশদের একজন এগিয়ে আসেন।
হ্যাঁ। আমাদের।
অরুণ বলে।
ঠিক আছে। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এই চান্দু! সোনার চেইন কোথায় বলো?
আমি নেই নাই।
চোপ! দে! দে চেইন!
বিশ্বাস করেন ছার। আমি না। নিয়েছে আরেক জনে। আর ধরা খাইছি আমি!
আবার মিছা কথা?
চেক করেন। পাইলে জেল ফাঁস, যা ইচ্ছা দেন।
এই নাম বল।
কার? আমার?
না তোর বাপের।
আমার বাপের নাম বেলায়েত বকশী। মারা গেছে। তিন বছর আগে।
এক থাপ্পড়ে বত্তিরিশ দাঁত...। এই, তোর বাপে কি সোনার চেইন নিছে?
আমার নাম হেমায়েত ছার। হেমায়েত বকশী। হেমায়েত… …
ঠিকানা?
টিটি পাড়া। থাকি বস্তিতে। কমলাপুর। আগে থাকতাম যাত্রাবাড়ী...।
ছার। অরে নিয়া আমরা থানায় যাইতাছি। আপনাগো কাম আপনারা করেন।
হ্যাঁ। অরে নিয়া ডাইরেক্ট কোর্টে যান। আমরা ব্যবস্থা নিব।
এই রিকশা। কোর্ট কাছারিতে চলো।
আগন্তুক দু’জন অভিযুক্তকে এক রকম টেনে হিঁচড়ে রিকশায় তুলে উল্টো দিকে মোড় নেয়।
খাতা কলম হাতে পুলিশটি এগিয়ে আসে।
আপনাদের নাম? এদিকে আসেন। নিরিবিলি কথা বলি।
অরুণ মিনাকে রড সিমেন্ট দোকানের পাশে ডেকে নেয় পুলিশ।
আমার নাম অরুণ। আর এ মিনা। আমার স্ত্রী।
ঠিকানা?
মণিপুরী পাড়া। বিশ বাই বেয়াল্লিশ। মসজিদ রোড। ব্লক...
চলবে। আর শোনেন। এইটা একটা কেস হয়ে যাবে। এর জন্য খরচা লাগবে। সোনার চেইন আপনারা ঠিকই ফেরত পাবেন। তবে...
তবে?
তার আগে আপনাদের কোর্টে যেতে হবে।
কোর্টে কেন আবার?
অরুণের চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি।
এটা আইনের বিষয়। বেশি না। একদিন গেলেই হবে। আমাদের লোক আছে। বাকিটা ওরাই করে দিবে। টাকাটা দেন।
টাকা কেন?
বলেছি না। খরচা আছে।
তা কত লাগবে?
মিনা ঘাড় গলা হাতাতে হাতাতে প্রশ্ন করে।
বেশি না। পাঁচ শ।
পাঁচ শ!
এখন যা পারেন দেন। বাকিটা পরে।
কিন্তু আমাদের হাতে তো এখন এত টাকা নেই।
কত আছে?
আমরা শুধু বাস ভাড়া নিয়ে বের হয়েছি।
ডান হাতে নিজের প্যান্টের পকেট হাতায় অরুণ।
এটা ঠিক না। বাইরে গেলে টাকা নিয়ে যেতে হয়। মানুষের বিপদ আপদ আছে না? আর এইটা ঢাকা শহর! বাংলাদেশ!
কিন্তু আমাদের টাকা লাগবে কেন?
দেন। দেখেন দুই জনের কাছে কত আছে? মিলাইয়া এখন যা পারেন দেন। ঠিকানা তো আছেই। পরে যাইয়া কালেকশন হবে।
শোনেন পুলিশ ভাই। সোনার চেইন আমাদের লাগবে না।
এটা তো রাগের কথা! তো এত রাগ করেন কেন? সোনার চেইন ফেরত পাওয়ার অধিকার আপনাদের আছে না? আলবৎ আছে। আর এটা তো আপনাদের এক রকম রাষ্ট্রীয় অধিকার।
কিন্তু ভাই, আমরা কোর্ট কাছারি করতে চাই না। পুলিশের ঝামেলায়...।
ঝামেলা মনে করলেই ঝামেলা!
শোনেন ভাই। চার পাঁচ বছর আগে আমাদের বিল্ডিংয়ে একটা চুরি হয়েছিল। আমাদের আন্ডার কনস্ট্রাকশন বাড়ির ছাদের ওপর লেবার খবির মিয়া তার বউ এক বাচ্চা নিয়া থাকত। তো, এক রাতে ওদের টিনের দরজা খুলে চোর ভেতরে ঢোকে। সুটকেস নিয়ে পালানোর সময় খবিরের বউয়ের ঘুম ভেঙে যায়।
পকেট থেকে সিগারেট লাইটার বের করে অরুণ।
আমারে একটা দেন।
অরুণের দিকে ডান হাত মেলে ধরে পুলিশ।
পুলিশকে একটি সিগারেট দিয়ে নিজেরটাতে আগুন ধরায়।
আর খবিরের বউ ‘চোর চোর’ ব’লে চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন জেগে ওঠে। তারাও চোরকে ধাওয়া করে। আমরাও ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। ততক্ষণে চোর তো পগার পার। বাসার কাছেই থানা। প্রতিবেশীরা বলল ওখানে যেয়ে রিপোর্ট করতে। খবির আমাদের সাহায্য চাইল। ওদের নিয়ে গেলাম থানায়। গিয়ে তো পড়লাম বিশাল বিপদে। একটি হল রুমের বেঞ্চিতে আমরা বসলাম। এক ঘণ্টা যায়। দুই ঘণ্টা যায়। তিন ঘণ্টা! কেউ আর কিছু জিজ্ঞেস করে না! আমাদের খোঁজ ও নেয় না! মহা অতিষ্ঠ হয়ে শেষে, আমি উঠে গিয়ে এক পুলিশের কাছে দেরির কারণ জানতে চাইলাম। উনি বললেন, সকাল সাতটার আগে কিছুই হবে না। বসেন।
দেখলাম টয়লেটের সামনে পুলিশরা সবাই এক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে একমাত্র প্রাতঃক্রিয়া ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা তাদের মাথায় খেলছে না। এদিকে আমার অফিস। বের হতেও পারছি না। সঙ্গে আমার স্ত্রী মিনাও। ওদিকে ঘরে আমার বৃদ্ধা মা ও আমাদের দুটি বাচ্চা। সে এক চরম বিব্রতকর পরিস্থিতি!
তারপর?
তারপর? তারপর আর কী। থানায় এজাহার দিয়ে নয়টার পর বাসায় যাই। পরে তো খবিরের চামড়ার খালি স্যুটকেস পাইলাম খোলা অবস্থায়, আমাদের জানালার সানসেটের ওপর। দেখা গেল, খবিরের বউ’র নাকফুল, তিনটা শাড়ি, দুইটা ছায়া... এ গুলোর সবই উধাও! এর দুই সপ্তাহ পর মণিপুরী পাড়ার ঠিকানায় সমন আসে, অমুক দিন আমাদের সবাইকে এই কোর্টে আসতে হবে। আমাদের চোর নাকি ধরা খেয়েছে কাকরাইলে। রমনা থানা এলাকায়। দুই থানার ‘রশি’ টানাটানি। এই অবস্থায় কেস তো ‘গিট্টু’ মেরে জটিল আকার ধারণ করেছে। আবার শোনলাম, চোর শনাক্ত করতেও বিরাট ভজকট। দেখেন। কোথাকার চোর কোথায় যাইয়া ধরা খায়!
তারপর?
তারপর শোনেন না। আসলাম পুরান ঢাকার এই কোর্টে। ভেতরে যাইয়া বসলাম বেঞ্চিতে। বাইরে থেকে একজন এসে আমার হাতে একটা কাগজ ধরায়ে দিয়ে বলল, আমি উকিলের লোক। এখানে যেমন লেখা আছে ঠিক তেমন বলবেন। কমও না। আবার বেশিও না।
ভাবলাম। আগে তো দেখি, কী লেখা আছে। কাগজখানা চোখের সামনে মেলে দেখি; ও বাবা! জিনিস তো খবিরের বউ’র না! আমার চামড়ার স্যুটকেস! আমার স্ত্রীর কানফুল না নাকফুল! শাড়ি। ছায়া না পেটিকোট! কী সব উদ্ভট বিষয়! নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম, ঘটনার রাতে এই এজাহারেই কি সই করেছিলাম আমি? বুঝলাম না!
সামনে থেকে একজন খবিরের বউকে ধমকায়ে বলে উঠলেন, এই মহিলা বেঞ্চ থাইকা পা দুইখান নামায়া বসো।
উকিলের লোকটা আবার আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, ‘তারিখ কিন্তু আবার পড়তে পারে ভাই। যদি পড়ে...।’
আমিও ফিসফিসিয়ে বললাম, ভাই এবারই শেষ করেন। অনেক হয়েছে!
উনি বললেন, ঠিক আছে। তবে কিছু ... ...।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আবার ‘কিছু’ কেন?
উনি আশ্বস্ত করে বললেন, আচ্ছা সেটা পরে হবে।
কোর্ট বসল। আমার নাম ডাকা হলো। মনের সব দুঃখ বুকে চেপে; উঠে দাঁড়ালাম। সামনের একজন আমাকে ইশারা করে বললেন, এখানে আসেন। ওপরে যাইয়া দাঁড়ান।
ওরে বাবা! ওটা যে কাঠগড়া! বাংলা সিনেমা মুভিতে যেমনটি দেখেছি। শেষ পর্যন্ত ওখানে? ভাবলাম, মানুষের কপাল মন্দ হলে যা হয়! আমিও এক হতভাগা! বুঝতে পারলাম, শির শির করে মাথার রক্ত আমার ঠান্ডা হয়ে পায়ে নেমে যাচ্ছে! এর পর যে কী হবে! ঈশ্বর ভরসা!
তো আমার সামনে একটা লেখা হাজির করা হলো। বলা হলো, জোরে পড়েন। পড়লাম, ‘যাহা বলিব, সত্য বলিব।’ কিন্তু বিষয়টি আমার পছন্দসই হলো না। ধরিয়ে দেওয়া ফর্দ অনুসারেই যদি আমাকে বলতে হয়, তবে দেখছি, সত্যের চেয়ে নির্জলা মিথ্যার পাল্লাই ভারি!
তারপর?
তারপর তো বুঝতেই পারছেন। আমাকে যা গেলান হয়েছিল, তাই বমি করতে বলা হলো। করলাম ও ঠিক তাই। কম ও না! বেশি ও না!
আমার বিপরীত কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে কখনো দেখেছি কিনা, আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো। আমি বললাম, এই তো সেই চোর! ওকেই অন্ধকারে আমাদের ছাদ থেকে লাফিয়ে পালাতে দেখেছি! হ্যাঁ। এ-ই আমাদের সেই রাতের সেই চোর!
আমাকে আবার জিজ্ঞেস করা হলো, ওর হাতে কিছু ছিল কিনা।
আমি বললাম, ছিল তো অবশ্যই। আমার চামড়ার স্যুটকেস একখানা। ওর ভেতরে এই এই মালামালও ছিল।
বুঝেছেন, ঘটনা থেকে খবির আর তার বউ পুরোটাই উধাও!
তো, চোর বেশি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে আগে কোথাও কোনো দিন দেখেছি বলে মনে হলো না। সে রাতে তো নয়ই!
সামনে টেবিলের ওপর রাখা কিছু জিনিসপত্র দেখিয়ে আমাকে প্রশ্ন করা হলো, ওগুলো আমাদের কিনা।
আমি বললাম, হ্যাঁ! এই তো চুরি যাওয়া আমাদের শাড়ি, নাকফুল, ছায়া... ...! এগুলোই চামড়ার স্যুটকেসে ছিল।
মনের ভুলে খবির বা তার স্ত্রীর প্রসঙ্গ টানলে সমূহ বিপদ ভেবে খুব সাবধানে কিন্তু দ্রুত বললাম।
যা হোক। শেষ পর্যন্ত মালামাল ফেরত পেলাম। তখন ভাবলাম, কে বলে এই দেশে বিচার নেই? বিচার আছে। ন্যায্য বিচার যে হয়, আমরাই তার জাজ্বল্যমান সাক্ষী! পরে অবশ্য দু শ টাকা মাত্র লোকটার হাতে হাসিমুখে গুঁজে দিয়ে সে যাত্রায় পার পেয়েছিলাম। তবে ‘ন্যায় বিচার’ প্রাপ্তিতে খবির আর তার বউয়ের চেয়ে আমরাই বেশি খুশি হয়েছিলাম সেদিন। তো এখন দেখি, আবারও আমরা সেই একই নৌকায় পা দিয়েছি!
ঘটনা ঠিক!
পুলিশ মানুষটা হাসলেন।
তাড়াতাড়ি করেন পুলিশ ভাই। রাত তো অনেক হয়েছে। ঘরে আমাদের দুটো শিশু রেখে এসেছি। মিনা বলল, না জানি ওরা কী করছে।
অরুণ অধৈর্য হয়ে পড়ে।
দেন তো যা দিবার। আপনারা তাড়াতাড়ি করলেই তো ঝামেলা চুকে যায়!
অরুণ বুঝে নিয়েছে, নাছোড়বান্দা এই পুলিশ!
অরুণের ওয়ালেট থেকে চল্লিশ টাকা আর মিনার ভ্যানিটি ঘেঁটে পনেরো টাকা বের করে পুলিশের হাতে গুঁজে দেওয়া হলো।
এই নিন।
পুলিশ নিজের পকেট হাতিয়ে ময়লা কাগজে মোড়ানো মিনার চেইন বের করে দিয়ে বললেন, এই নিন চেইন। ঠিক আছে কিনা চেক করেন। পথে ঘাটে আর এভাবে বেরোবেন না। অবস্থা খুবই খারাপ!
অরুণ মিনা তো হতবাক! পুলিশের পকেটে তাদের সোনার চেইন! অরুণ মনে মনে বলে, ঠিকই বলেছেন। অবস্থা খুবই খারাপ।
জানেন। আপনাদের দেখে আমার নিজের স্ত্রীর কথাই মনে পড়ল। সে ও একবার এ রকম ঘটনার শিকার হয়েছিল। দেখেন, ছিনতাইকারীরা পুলিশের বউকেও ছাড় দেয় না! কোথায় আছি আমরা! ভবিষ্যতে আরও কোথায় যাব!
অরুণ হাতে নিয়ে সোনার চেইন পরখ করে।
ঠিক আছে। আপনারা আছেন বলে আমরাও আছি পুলিশ ভাই।
অরুণ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, বলতে গেলে দেশে আমরা ভালোই আছি। তো এবার যাই পুলিশ ভাই! আমাদের দেশের পুলিশ কী না পারে!
দোয়া করবেন।
অবশ্যই। দোয়া তো আপনারা প্রাপ্য!
আর লম্বা কথা নয়। নাক বরাবর কেটে পড়েন এবার!
কথা না বাড়িয়ে সোজা সামনের দিকে হাঁটা দিল অরুণ-মিনা।
মিনা বলল, আমার শরীরে এতটুকুও শক্তি নেই। পা আর চলছে না।
‘আর লম্বা কথা নয়!’ ‘নাক বরাবর’ জোরে পা চালাও। অরুণ তার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। মিনা পিছিয়ে পড়ে।
কী ব্যাপার! আমাকে পিছে রেখে চলে যাচ্ছ যে!
বললাম না, জোরে পা চালাও!
অরুণ তার গতি কমায় না।
সামনেই খালি একটা বেবি ট্যাক্সি দেখে ‘এই বেবি’ বলে হাত ওঠায় অরুণ।
বেবি ট্যাক্সি ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। তাতে চড়ে বসে দু’জনে। কোথায় যাবেন?
চলেন। সোজা ফার্মগেট মণিপুরী পাড়া।
চালকের প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর অরুণের।
নিচু গলায় মিনা বলল, গিয়েই প্রার্থনায় বসব। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ে বলব, আর যেন তিনি কখনো এমন অবস্থায় না ফেলেন। ঈশ্বর কী বাঁচাটা বাঁচিয়েছেন! চিন্তা করেছ? উফ্! কী শান্তি!!!
তা, জিনিসটা কোথায়?
মিনার চেয়েও নিচু গলায় অরুণের প্রশ্ন।
জায়গা মতো রেখে দিয়েছি।
অরুণকে আশ্বস্ত করে মিনা।
শুধু কি শান্তি?
এক বুক শ্বাস নিয়ে উঁচু গলায় অরুণ বলে উঠল, মহাশান্তি!