বোল্টনের বিদায়ের যত কারণ
ইরান থেকে ভেনেজুয়েলা, উত্তর কোরিয়া থেকে আফগানিস্তান—প্রায় প্রতিটি প্রধান আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন পরস্পরবিরোধী মত পোষণ করতেন। ট্রাম্প বড় কোনো সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার বিপক্ষে। অন্যদিকে, ট্রাম্পের বর্ণনায় বোল্টন পারলে সারা বিশ্বের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বাধিয়ে বসেন। শুধু নীতির প্রশ্নেই নয়, বোল্টনের গোঁফ নিয়েও ট্রাম্পের আপত্তি ছিল। শোনা যায়, বোল্টনের কাঁটার মতো গোঁফের কারণে তাঁকে ট্রাম্প তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য করতে আপত্তি করেছিলেন।
দেড় বছরেরও কম সময় ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে শেষ পর্যন্ত পদচ্যুত হলেন বোল্টন। গতকাল মঙ্গলবার এক-দুই লাইনের টুইটে ট্রাম্প জানান, তিনি বোল্টনকে জানিয়েছেন, হোয়াইট হাউসে তাঁর চাকরির আর প্রয়োজন নেই।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই টুইট আসার আগেই সেদিন সকালে বোল্টন ট্রাম্পের কাছে এক লাইনের এক পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছিলেন। যেখানে লেখা ছিল, ‘আমি এই মুহূর্ত থেকে পদত্যাগ করলাম।’
বোল্টনের এই পত্রের কোথাও ট্রাম্পের মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়ার জন্য তাঁকে কোনো ধন্যবাদ জানানো হয়নি। নেই কোনো কৃতজ্ঞতা।
বোল্টন যে পদচ্যুত হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেছেন, তা প্রমাণের জন্য গতকাল দুপুরে ট্রাম্পের টুইট প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফক্স নিউজকে টেক্সট করেন। বোল্টন জানান, ‘আমিই পদত্যাগ করেছি।’
ট্রাম্প অনেকবারই বলেছেন, বোল্টনের সঙ্গে তাঁর নানা বিষয়ে মতের মিল ছিল না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও-ও জানিয়েছেন, বোল্টনের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ ছিল। কিন্তু ঠিক কী কারণে এই সময় এমন নাটকীয়ভাবে বোল্টনকে চলে যেতে হলো, তার কিছু ব্যাখ্যা বেনামি সূত্রে সিএনএনসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
ইরান ও ভেনেজুয়েলা প্রশ্নে ট্রাম্প ও বোল্টন কথা-কাটাকাটি করেছেন—এ কথা গোপন নয়। ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে না গিয়ে ট্রাম্প সে দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনা বসতে চান। এই ব্যাপারে বোল্টন অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি ইরানের ওপর বোমা ফেলতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
ভেনেজুয়েলার ক্ষেত্রে বোল্টন ট্রাম্পকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, মাদুরোর পতন অত্যাসন্ন। দেশটির বিরোধী নেতা গুয়াইদোকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিলেই কেল্লা ফতে। বোল্টনের কথায় বিশ্বাস করে চলতি বছরের জানুয়ারিতে গুয়াইদোকে ভেনেজুয়েলার অস্থায়ী নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ছয় মাস পরেও দেখা গেল, মাদুরো বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
উত্তর কোরিয়া প্রশ্নেও ট্রাম্প-বোল্টনের প্রবল মতবিরোধ ছিল। বোল্টন কখনোই মনে করতেন না, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি সম্ভব। ট্রাম্প হঠাৎ যেভাবে কিমের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক ডেকে বসেন, তাতে বোল্টন ঘোরতর আপত্তি করেন। তাঁর এই কঠোর অবস্থানের কারণে ট্রাম্প সন্দেহ করতেন, বোল্টন চান না উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে শান্তিচুক্তি হোক। কারণ, সে চুক্তি হলে বোল্টন কোনো বাহবা পাবেন না।
ওয়াশিংটন পোস্ট ও অন্যান্য সূত্রমতে, আশু যে কারণে বোল্টনকে চলে যেতে হলো, তা হলো আফগানিস্তান প্রশ্নে এই দুজনের তীব্র মতবিরোধ।
বোল্টন আফগানিস্তানের তালেবানের সঙ্গে শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করেন। তালেবান নেতাদের ক্যাম্প ডেভিডে ট্রাম্প যে আমন্ত্রণ জানান, বোল্টন তারও প্রতিবাদ করেন। ট্রাম্প চেয়েছিলেন, বোল্টন টিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর বৈদেশিক নীতির পক্ষে সাফাই গাইবেন। কিন্তু বোল্টন রাজি হননি। এই বিষয়ও ট্রাম্পের নাখোশ হওয়ার আরেক কারণ।
ট্রাম্পের কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেছেন, বোল্টনের বিদায় শুধু সময়ের ব্যাপার ছিল। পত্রপত্রিকায় তাঁদের দুজনের মতবিরোধ নিয়ে যেসব কেচ্ছাকাহিনি প্রকাশিত হচ্ছিল, ট্রাম্প তা মোটেই পছন্দ করছিলেন না।
বোল্টন চলে যাওয়াতে অবশ্য হোয়াইট হাউসের ভেতরে বা বাইরে কেউই চোখের জল ফেলছে না। এ ব্যাপারে সেরা মন্তব্যটি এসেছে সিবিএস টিভির নৈশকালীন ‘লেট নাইট’ অনুষ্ঠানের হোস্ট স্টিফেন কোলবেয়ারের কাছ থেকে। বোল্টনের প্রধান পরিচয় ছিল, তিনি যুদ্ধবাজ। সে কথা উল্লেখ করে কোলবেয়ার মন্তব্য করেছেন, ‘ট্রাম্পের নীচতা ও নির্বুদ্ধিতার জন্য আগে আমি কখনোই এতটা খুশি হইনি, যতটা খুশি হয়েছি, যে নীচতায় তিনি এই যুদ্ধবাজ মানুষটার হাত থেকে আমাদের রক্ষা করেছেন।’