কাঁদতে কাঁদতে চোখে ঘা হয়ে গেছে। নিজের চোখের পানিই এখন নিজের শত্রু। এ কান্না আবরার ফাহাদের জন্য। সে আমার কে? কেউ না। আমার একটি ২০ বছরের ছেলে আছে। সে জন্যই কি তবে এমন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা কষ্ট হয়! কেন এমন লাগে? অনেক দিন তো হলো; তবু কেন চোখ বেয়ে এমন কান্না নেমে আসে।!
ভেবেছিলাম এই বিষয়ে কিছু লিখব না। হয়তো সেভাবে কিছু লিখতেই পারব না। হয়তো কলম সরবে না। কিন্তু কাল রাতে হঠাৎ করেই ইউটিউবে একটি ভিডিও দেখে চমকে উঠলাম; পুরোটা দেখতেও পারিনি। কিছু কুকুরকে আবরারের খুনিদের নামে নামকরণ করা হয়েছে এবং সেই নামে একে একে ডাকা হচ্ছে ও খাবার দেওয়া হচ্ছে। আমি ‘অনিক’ নামের কুকুরটিকে খাবারের জন্য ডাকা হচ্ছে সেই পর্যন্ত দেখে কাঁপতে কাঁপতে টিভি বন্ধ করে দিলাম। এর নির্মাতাদের কি একবারও মনে হলো না যে, এই খুনিদেরও বাবা-মা বেঁচে আছেন। তাঁরাও বুকে পাথর চেপে নিশ্বাস নিচ্ছেন। তাঁরা তাঁদের সন্তানদের আবরারকে খুন করার জন্য নয়, বরং উচ্চশিক্ষার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। একবারও কি মনে হলো না যে, এই ভিডিওটি দেখার পর ওই ছেলেগুলোর মা-বাবার কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে? খুনিরা আবরারকে উন্মত্ত হয়ে খুন করেছে পৈশাচিক উপায়ে। তাই বলে কি অন্যদেরও পাল্লা দিয়ে পিশাচ হতে হবে? উন্মত্ত উন্মাদনায় বানাতে হবে এমন কদর্য ভিডিও?
খুনিদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে। অভিভাবকের কাতারে ভ্যান ও ট্রাকচালক বাবাও রয়েছেন। তা ছাড়া প্রতিটি ছেলেকেই এলাকাবাসী, আত্মীয়পরিজন শান্ত, ভদ্র, মেধাবী ও পডুয়া বলেই জানত। মা-বাবার শিক্ষা, মূল্যবোধ ও আদর্শ থেকে এই বাচ্চাগুলোও শিক্ষা নিয়েছিল। ভালো ছেলে হিসেবেই সমাজে দশজনের কাছে পরিচিত ছিল তারা। তবে কেন তাদের পরিবারগুলোকে এমন শাস্তি দেওয়া? তাঁদের সন্তানেরা কুকুর ছিল না। তাঁরা সোনার টুকরা ছেলের গর্বিত মা-বাবা ছিলেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মেধাবী শিক্ষার্থীদের মা-বাবা তাঁরাও। তাঁদের কি ‘কুকুরতুল্য’ সন্তান জন্মদানের জন্য এমন কুৎসিত শাস্তি দেওয়া যায়, যেখানে তাঁদের সবাই খুনিদের বিচার ও দোষী ছেলের উপযুক্ত শাস্তি কামনা করেছেন?
আবরারের মা-বাবা জানতেন না যে, আবরার চলে যাচ্ছে। কিন্তু এই ভাগ্যহারা মা-বাবারা জানেন, তাঁদের বুকের ধনেরা আর কোনো দিনই ফিরবে না; তারা চলে যাচ্ছে ‘না ফেরার দেশে’। পাপের খেসারত তাদের দিতেই হবে। আবরারের মা-বাবার মতো তাদেরও বুকে শূন্যতার হাহাকার। তাঁরা বেঁচে আছেন সীমাহীন লজ্জা ও গ্লানির পাথর বুকে চেপে। তাঁরা তো সন্তানদের পিটিয়ে খুন করার শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেননি। তারা জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন মেধাবী, শালীন, মার্জিত কিছু সন্তান, যাদের অপরাধের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা বা সংশ্লিষ্টতা ছিল না। এই নিষ্পাপ ছেলেগুলোকে কারা এমন ভয়ংকর অপরাধীতে পরিণত করল, তাদের নিয়ে ছবি করুন, শাস্তি দিন। বের করুন তাদের পরিচয়।
যারা সজ্ঞানে এসব ভিডিও নির্মাণ করছেন, তাঁদের কাছে প্রশ্ন দেশ বা জাতি কি এর থেকে কিছু শিখছে বা জানতে পারছে? ২০-২২ বছরের এই ছেলেগুলোকে যারা কুকুর বানিয়ে ছেড়েছে, যারা ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে দিনের পর দিন এদের ব্যবহার করে বিবেকহীন করে ছেড়েছে, তাদের কুকুর বলুন। খুঁজে বের করুন কাদের কারণে শিক্ষাঙ্গনে ‘টর্চার সেলের’ সূচনা হয়। উপাচার্য, হল প্রভোস্ট, হাউস টিউটর কি চোখে দেখেন না, কানে শোনেন না? তাঁদের নিয়ে ভিডিও করুন। তাঁরা তো শিক্ষাদীক্ষায় উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত। তাঁরা তো শিক্ষার্থীদের রক্ষাকর্তা। তবে কেন অভিভাবক হিসেবে এই মেরুদণ্ডহীনতা, উদাসীনতা, ভালোবাসাহীনতা? সংবাদপাঠককে সংবাদ পাঠ করতে গিয়ে চোখের পানি ফেলতে দেখা গেলেও বিচলিত হতে দেখলাম না উপাচার্যসহ ছাত্রকল্যাণ সংসদের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষককে। বরং তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন গুছিয়ে গুছিয়ে বক্তব্যদানে। রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে বলী হলো অরাজনৈতিক একটি পবিত্র জীবন। তাতে রাজনীতিতে অভ্যস্ত কর্তাব্যক্তিদের কতটুকুই বা এল-গেল!
সারা দিন গদি বাঁচিয়ে, দিন শেষে গদি ঠিক রেখে বাড়ি গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমানো নিয়ে কথা। এর বাইরে কে মরল, কে মারল—তা নিয়ে মাথা ঘামানোর অবকাশ কোথায় এদের? টর্চার সেলে তো আর তাঁদের নির্যাতন করা হয় না। এ রকম এক-দুজন আবরার মরলে তাদের কি? তাঁরা তো তেল দিতে ও নিতেই ব্যস্ত। লিখুন, বলুন, ভিডিও নির্মাণ করুন—এসব হর্তাকর্তা, বিধাতাদের নিয়ে। এদের ভরসাতেই তো মা-বাবা তাঁদের বুকের মানিকদের পাঠিয়েছিলেন। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে তাঁরা পুরোপুরি ব্যর্থ। যার প্রমাণ ‘টর্চার সেল’, যার প্রমাণ আবরার। কেন এই টর্চার সেল, কী হয় সেখানে, কারা এগুলো চালায়—এসব বের করা কি খুব অসাধ্য কিছু? যদি গোড়াতেই এর মূল উৎপাটন করা যেত, তাহলে আজ আর আবরারকে এভাবে মরতে হতো না; নষ্ট হতো না খুনি বনে যাওয়া এতগুলো ছেলের জীবন।
আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, হলে থেকেছি। কোনো নির্যাতন কক্ষের দেখা পাইনি, শুনিওনি। প্রতি সপ্তাহেই হাউস টিউটররা সন্ধ্যায় বা রাতে রাউন্ডে বের হতেন। মাসে এক আধবার প্রভোস্টও আসতেন তাঁদের সঙ্গে। অবৈধ হিটার ইত্যাদি বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যেতেন। আমরা ভয়ে ফ্যানটাও লুকিয়ে রাখতাম। অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলের কারণে এসবের ব্যবহার অনুমোদিত ছিল না। এমন রাউন্ড শিক্ষকেরা এখনো দেন কিনা, আমি জানি না।
তবে সেই আমলেও সাদামাটা ও প্রভাবশালী শিক্ষার্থীর মধ্যে ক্ষমতা ব্যবধান ছিল। হঠাৎই একটি বিষয় মনে এল। হলে বিদ্যুৎ চলে গেলে কোনো কোনো রুমে জমজমাট গল্প-গানের আড্ডা বসত। নিজের রুম থেকে কখনো এসব উপভোগ করতাম, কখনো বা বিরক্ত হতাম। পড়ার চাপ থাকলে মেজাজ বিগড়ে যেত এসবে। এমনই একবার অনেক অনুরোধ করেও ফল না পেয়ে কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হয়েছিলাম আমরা। আর কর্তৃপক্ষের রায় ছিল, এমন গান-বাজনা দোষের কিছু নয়। আমার রুমমেট তবু জোর দিয়েই বলেছিল, ‘পরীক্ষার সময় প্রতি রাতে দু-তিন ঘণ্টা ওদের জন্য পড়তে পারি না।’ উত্তরে কর্তৃপক্ষ বলেছিল, ‘পড়াশোনার মধ্যে একটু-আধটু ব্রেক নেওয়া যেতেই পারে।’ সেও ছিল এক ধরনের নির্যাতন। ঘটনার শেষ সেখানে হয়নি। ওই দলের নেত্রী আমাদের দলের একজন নিরীহ পড়ুয়া মেয়েকে একাকী বাথরুমে পেয়ে হাসতে হাসতে তার গালে একটি চড়ও বসিয়ে দিয়েছিল। আমরা যারা ঘটনাটি জানতাম, কষ্টে নীল হয়ে গিয়েছিলাম। ঘৃণায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তবু আর অভিযোগ করতে যাইনি। এই অত্যাচার মেনেই নিতে হয়েছিল। ঘটনাটির সমাধান প্রশাসন অন্যভাবেও করতে পারত। তাহলে হয়তো নিরপরাধ মেয়েটিকে শারীরিক, মানসিক হেনস্তার শিকার হতে হতো না। প্রশাসন সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করে না বলেই অপরাধী চক্রের হাতে নিরপরাধের মরণ হয় বারবার। আবরারও এর ব্যতিক্রম নয়।
আবরারের মৃত্যু নিয়ে যত ভাবি ততই একটি ছেলের ওপর বেশ রাগ হয়। সে হলো আবরারের বন্ধু, যাকে আবরার শেষ মুহূর্তে সাহায্যের জন্য ডেকেছিল। কিন্তু বন্ধুর অন্তিম ডাকেও সাড়া দেননি তিনি। কী হতো তিনি যদি এগিয়ে যেতেন। ধিক্কার জানাই তাঁদেরও, যারা তোশকসহ মুমূর্ষু আবরারকে সিঁড়িতে পড়ে থাকতে দেখেও এগোয়নি। একজন তো জানিয়েছেন যে, তিনি খেতে যাওয়া ও আসার সময় আবরারকে সিঁড়িতে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন। তবু তিনি এগিয়ে যাননি। যারা পিটিয়ে পিটিয়ে আবরারকে মেরেছে, তারা নরপশু মানলে, এরা কারা? এদের বিবেকেরও এমন মরণ কেন হলো? কেন একজনেরও মনে হলো না, ছেলেটির কাছে যাই, কী বলছে শুনি? আহা রে কী কষ্টের মরণ! এত মেধাবী শিক্ষার্থীদের কারও কী মনে হলো না যে, তাদের নির্যাতনের কারণে আবরার যদি মারা যান, তবে তাঁরাও নিস্তার পাবেন না। নাকি কেউ তাঁদের অভয় দিয়েছিল?
আবরারের আলাভোলা দাদু তার নাতির এই সাপ-মৃত্যুর কষ্টের স্মৃতি থেকে কি নিষ্কৃতি পাবেন? পাবেন না। আমিই ভুলতে পারছি না; স্বজনেরা ভুলবেন কী করে! কিংবা যদি আসে আবরারের এভাবে মৃত্যুর কারণের বিষয়টি তাহলে কী বলব? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমি বাহবা দিই। পদ্মা সেতুর মতো বিশাল কাজটি করার সাহসিকতার জন্য তাঁর মঙ্গলের জন্য দু হাত তুলে মোনাজাত করি। বন্দীদের শত বছরের খাদ্য মেন্যু বদলে দেওয়ার জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ আমি। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের দেশ আরও এগিয়ে যাক। কিন্তু যে চুক্তির বিরুদ্ধে লিখে আবরার প্রাণ হারাল, সেই চুক্তির বিরোধিতা আমিও করতে চাই। ভারত আমাদের প্রতিবেশী, বড় শক্তি। তার পানির অভাব সে নিজের মতো করে মেটাক। আমাদের দেশের অনেক নদীই তো তাদের কারণে নাব্যতা হারাল, কই তারা তো তাকিয়ে দেখেনি। তাই এমন চুক্তির বিরুদ্ধে শুধু আবরার নয়, অনেকেই রয়েছে। একটু সমীক্ষা করলেই সত্যটি জানতে পারত সরকার।
একটা ঘটনার কথা বলে লেখাটি শেষ করি। বোধকরি ২০১৬ সালের এপ্রিলের কথা। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি স্কুলের টেন ও ইলাভেন গ্রেডের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি ফেরি রওনা হয়েছিল শিক্ষাসফরে কাছেই একটি দ্বীপে। কিন্তু অতিরিক্ত ওজন বহনসহ ফেরিটি ক্যাপ্টেন শার্প টার্ন নিলে তা ভারসাম্য হারিয়ে সমুদ্রে ডুবে যায়। অনেকেরই লাশ পাওয়া যায়নি। সব স্কুলের ওই ক্লাসগুলোর কোনো রুমেই কোনো শিক্ষার্থী ছিল না। চার শতাধিক শিক্ষার্থী এক লহমায় নাই হয়ে গেল। যারা বেঁচে ফিরেছিল তারা আর স্কুলে ফেরার মানসিকতায় ছিল না। অনেক মা তার বাচ্চা ঠান্ডা পানিতে শীতে কষ্ট পাচ্ছে ভেবে কম্বল গায়ে দেননি। এক মা ছেলের জন্মদিনের জন্য কিনে রাখা জুতা কোলে বসেছিলেন দিনের পর দিন সমুদ্রের তীরে, যদি ছেলে বা তার লাশ ফিরে আসে! সেই সময়ে এই কষ্ট সইতে না পেরে অনেকেই আত্মহত্যা করেন। যে শিক্ষক বাচ্চাদের জন্য ওই দ্বীপটি পছন্দ করেছিলেন, তিনি স্কুলের পাশের একটি গাছে ঝুলে আত্মহত্যা করেন। দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। ফেরির মালিককেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিদের চিত্র ভিন্ন। এদের কোনো কিছুতেই কোনো কিছু যায় আসে না। কোনো সময়ই দোষ বা দায় স্বীকার করেন না কেউ। গদি ছাড়া কোনো চিন্তাই তাঁদের নেই। নির্লজ্জ এই ক্ষমতালিপ্সু মনমানসিকতার অবসান কি হতে পারে না?