১৭৮৭–এ নবগঠিত যুক্তরাষ্ট্রের আদি স্থপতিরা ফিলাডেলফিয়ায় নতুন রাষ্ট্রটির একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য মিলিত হয়েছিলেন। এই নতুন রাষ্ট্র ও তার সরকারের চেহারা কী হবে, সে প্রশ্ন তখনো অমীমাংসিত। এমন অনেকেই ছিলেন, যাঁরা যুক্তরাজ্যের ধারায় এক পরিবর্তিত রাজতন্ত্রের কথা ভেবেছিলেন। অন্যদের দাবি ছিল, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি প্রজাতন্ত্র। সম্মেলনের শেষ দিন রুদ্ধকক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতেই সবাই ছেঁকে ধরলেন বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিনকে। তিনি প্রস্তাবিত সংবিধানের অন্যতম রূপকার ও লেখক। সবার জিজ্ঞাসা, শেষ পর্যন্ত কী ঠিক হলো, প্রজাতন্ত্র না রাজতন্ত্র? ফ্রাঙ্কলিন বললেন, প্রজাতন্ত্র, যদি তোমরা তা ধরে রাখতে পারো।
গণতন্ত্র মানে অব্যাহত লড়াই
প্রজাতন্ত্র বলতে ফ্রাঙ্কলিন জনপ্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথাই বুঝিয়ে ছিলেন, তবে প্রজাতন্ত্র ধরে রাখা বলতে তিনি কী বুঝিয়েছিলেন, সে কথার অর্থ ২৩৪ বছর পরেও আমরা বোঝার চেষ্টা করছি। একটা বিষয় এখন স্পষ্ট, নিজেদের গণতন্ত্র বললাম আর অমনি আমরা গণতান্ত্রিক হয়ে গেলাম, মোটেই তা নয়। এর জন্য দরকার অব্যাহত লড়াই। লড়াইটা প্রধানত অভ্যন্তরীণ। লড়াই বলছি বটে, কিন্তু কথাটার আসল অর্থ সহযোগিতা—ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরের শক্তিগুলোর মধ্যে অব্যাহত সংলাপ ও মতৈক্য। গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউস কর্তৃক আহূত ‘গণতন্ত্র শীর্ষ সম্মেলনে’ প্রেসিডেন্ট বাইডেন এ কথাটাই নিজের দেশের উদাহরণ দিয়ে একাধিকবার বললেন।
যার নিজের বাড়ি আগুনে জ্বলছে, সে কী করে অন্যের ঘরের আগুন নেভাবে? যে নিজে রোগী, সে কী করে ডাক্তারের ভূমিকা নেবে?
‘মার্কিন গণতন্ত্র অনবরত এক লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যে লড়াইয়ের লক্ষ্য আমাদের নিজেদের ভেতরের মতানৈক্য দূর করা এবং জাতির আদি স্থপতিরা স্বাধীনতার ঘোষণায় যে আদর্শের কথা বলেছিলেন, তা রক্ষায় পুনঃ অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া।’ অন্য কথায়, প্রজাতন্ত্র ধরে রাখতে হলে গণতন্ত্রকামী প্রতিটি দেশের মানুষকে এই লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। গণতন্ত্র গ্যালারিতে বসে দেখার মতো কোনো খেলা নয়, এর জন্য চাই অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি।
বাইডেন প্রশাসনের প্রত্যাশা ছিল, এই শীর্ষ সম্মেলনের ভেতর দিয়ে আমন্ত্রিত দেশগুলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি তাদের অঙ্গীকার নবায়ন করবে এবং গণতন্ত্র রক্ষার একটি আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন জানাবে। মুখে মুখে সবাই তেমন অঙ্গীকার করেছে বটে, কিন্তু এই ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে বায়বীয় সে ঘোষণা আদৌ কোনো গুরুত্ব বহন করে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ যায়নি।
প্রথম সন্দেহ সম্মেলনের আয়োজক যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে। আমেরিকায় গণতন্ত্র এই মুহূর্তে বিপুল হুমকির সম্মুখীন। এক বছর আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে এখনো সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর হয়নি। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও রিপাবলিকান পার্টির ৬৮ শতাংশ সমর্থক মনে করে, এই মুহূর্তে যে লোকটি হোয়াইট হাউস দখল করে আছনে, তিনি একজন প্রতারক। নির্বাচনে আসলে যিনি জিতেছেন, তাঁর কাছ থেকে বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্বাচনে সেই ট্রাম্প আবারও ফিরবেন, এমন কথা খোলামেলাভাবেই বলা হচ্ছে। যার নিজের বাড়ি আগুনে জ্বলছে, সে কী করে অন্যের ঘরের আগুন নেভাবে? যে নিজে রোগী, সে কী করে ডাক্তারের ভূমিকা নেবে?
প্রেসিডেন্ট বাইডেন এই বৈপরীত্যের কথা নিজেই স্বীকার করলেন। তিনি বললেন, গণতন্ত্রের সুরক্ষার জন্য আমাদের আরও অনেক পরিশ্রম করতে হবে। শুধু মুখে নয়, আমরা কাজেও করে দেখাব গণতন্ত্র রক্ষায় আমরা কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা এই লড়াইয়ে অন্যের জন্য উদাহরণ হব, নিজেদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় আরও বেশি করে বিনিয়োগ করব, এই কাজে বিশ্বের সর্বত্র আমাদের সহযোগীদের হাতকে শক্ত করব।
মার্কিন সরকার বরাবরই গণতন্ত্র প্রসারে নিজের অঙ্গীকার জোরেশোরে প্রচার করতে ভালোবাসে। লক্ষাধিক সৈন্য পাঠিয়ে যুদ্ধ বাধানো বা আকাশ থেকে বোমা ফেলে ঝাঁঝরা করে দেওয়া, সেটার লক্ষ্যও গণতন্ত্রের প্রসার। এই লক্ষ্য অর্জনে তারা আরও একটা কাজ করতে খুব ভালোবাসে, আর তা হলো নিজের পছন্দমতো বাছাই করা প্রকল্পে টাকা ছড়ানো।
সম্মেলনের উদ্দেশ্য, নিজ দল ভারী করা
সমস্যা হলো, সম্মেলনের আমন্ত্রিতদের তালিকা দেখে মনে হয়েছে, বিশ্বের সর্বত্র গণতন্ত্রের সুরক্ষা নয়, আমেরিকা এই সম্মেলন আয়োজন করেছে নিজের দল ভারী করতে। এ কথা বলার কারণ, যুক্তরাষ্ট্র যাদের মিত্র বলে মনে করে, শুধু তাদেরই দাওয়াত পাঠিয়েছে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার বৈরিতা তীব্র হচ্ছে, এই বৈরিতায় আমেরিকা আমন্ত্রিত দেশগুলোকে নিজের পাশে চায়।
আমেরিকার জন্য ‘হাতের ময়লা’ এই অর্থ দিয়ে গণতন্ত্রের কোন হাত বা পা সুরক্ষিত হবে, তা আমরা জানি না। তবে ইউএসএইডের এই অর্থ কীভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেবেন, সে কথা ভেবে ইতিমধ্যেই অনেকের জিবে ঝোল পড়া শুরু হয়েছে তা অনুমান করা কঠিন নয়।
কুইন্সি ইনস্টিটিউটের ফেলো আনাতোল লিয়েভেনের কথায়, সম্মেলনের উদ্যোগটাই ভ্রান্ত। কেন তা বুঝতে শুধু নরেন্দ্র মোদি এই নামটা উচ্চারণ করাই যথেষ্ট। এই সম্মেলনের একটা উদ্দেশ্য চীনা কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে জোট বাঁধা, কিন্তু মোদিকে বাদ দিয়ে সে জোট বাঁধা যাবে না। অতএব মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। কিন্তু মোদিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁর সরকারের কর্তৃত্ববাদী চরিত্র অস্বীকার করলে পুরো সম্মেলনই পরিহাসে পরিণত হয়। আর হয়েছেও তাই।
লিয়েভেনের মতো টাইম ম্যাগাজিনও মনে করে, আসলে এই সম্মেলন ‘ফারস’ ছাড়া আর কিছু নয়। এই সম্মেলনে এমন একাধিক সরকারপ্রধান আমন্ত্রণ পেয়েছেন, যাঁরা খোলামেলাভাবে কর্তৃত্ববাদী। এসব রাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাইডেন প্রশাসন ‘কপটতার’ প্রমাণ রেখেছে।
বাইডেন তাঁর ভাষণে স্বীকার করেন, সব দেশে গণতন্ত্র এক রকম নয়, সবার লড়াইয়ের ধরনটাও এক রকম নয়। কোনো এক দেশের কাছে সব প্রশ্নের উত্তর রয়েছে, তা–ও নয়। আর সে জন্যই দরকার একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি নিজের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা। বাইডেনের মুখে এ কথা শুনতে ভালো লাগলেও তাঁর কাজ দেখে এখন পর্যন্ত আমাদের মনে হয়নি তিনি নিঃস্বার্থভাবে এমন উদ্যোগ নিয়েছেন।
কথাটা খোলাসা করে বলেছেন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির জ্যেষ্ঠ ফেলো জেমস স্ট্রব। ওয়েব পত্রিকা ‘পলিটিকো’তে এক নিবন্ধে তিনি মন্তব্য করেছেন, যে ‘মস্ত তাঁবুর’ কথা হোয়াইট হাউস থেকে বলা হয়, তার পেছনে একধরনের ভূরাজনৈতিক অঙ্ক কাজ করেছে। তাদের গণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়ে সন্দেহ থাকলেও ভারতকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কারণ, চীনের বিরুদ্ধে সে আমেরিকার কৌশলগত মিত্র। একইভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিজের ছাতির তলায় ধরে রাখতে পোল্যান্ডকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যদিও দেশটি দ্রুত সংখ্যাধিক্যের একনায়কতন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। গণতন্ত্র হয়তো মার্কিন বৈদেশিক নীতির কেন্দ্রে রয়েছে, কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের ঊর্ধ্বে তার অবস্থান নয়।
বাইডেন ও আমেরিকার জন্য অনেক অর্থপূর্ণ কাজ হতো তারা যদি আফ্রিকায় ও তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ভ্যাকসিন উৎপাদনে সাহায্য করত। এ জন্য দরকার ওষুধ কোম্পানিগুলোকে তাদের পেটেন্ট ভাগাভাগি করতে বাধ্য করা। শুকনো কথার ফুলঝুরির বদলে গণতন্ত্র রক্ষায় সেটি একটি কাজের কাজ হতো।
আগে নিজের স্বার্থ, তারপর গণতন্ত্র
সম্মেলনের আগে হোয়াইট হাউসের তরফ থেকে কতিপয় মৌলিক লক্ষ্যমাত্রার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেগুলো হলো:
১. গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতার সুরক্ষা ও কর্তৃত্ববাদের বিরোধিতা,
২. দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং
৩. মানবাধিকারের সমুন্নয়ন
যেসব দেশের নেতা-নেত্রী সম্মেলনে অংশ নেন এবং লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান, তাঁরা প্রত্যেকেই খুব সাগ্রহেই এই তিন আদর্শের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানিকতা বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই বলতে কী বোঝায়, তাঁরা প্রত্যেকেই বিষয়টি যাঁর যাঁর মতো করে ভাবেন। একটি চমৎকার উদাহরণ দিয়েছেন ভারতের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মিত্র। তাঁর কথায়, ভারতের নেতারা এই সম্মেলনে এসে নিজেদের গণতান্ত্রিক ‘ক্রেডেনশিয়াল’ ধোপদুরস্ত করে নেবেন, কিন্তু বাস্তবে নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সমস্যার সৃষ্টি হয়, এমন কিছুই করবেন না। যেমন নিজদের স্বার্থের পরিপন্থী মনে হলে যখন-তখন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া বা তথ্যব্যবস্থার ওপর কামড় বসানো—বাইডেন প্রশাসন যত কথাই বলুক, তারা বন্ধ করবে না।
গণতান্ত্রিক নবায়ন
মার্কিন সরকার বরাবরই গণতন্ত্র প্রসারে নিজের অঙ্গীকার জোরেশোরে প্রচার করতে ভালোবাসে। লক্ষাধিক সেনা পাঠিয়ে যুদ্ধ বাধানো বা আকাশ থেকে বোমা ফেলে ঝাঁঝরা করে দেওয়া, সেটার লক্ষ্যও গণতন্ত্রের প্রসার। এই লক্ষ্য অর্জনে তারা আরও একটা কাজ করতে খুব ভালোবাসে, আর তা হলো নিজের পছন্দমতো বাছাই করা প্রকল্পে টাকা ছড়ানো। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, গণতন্ত্রের প্রসার নয়, কীভাবে মার্কিন স্বার্থবিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন গলা টিপে মেরে ফেলা যায়—এই টাকা ছড়ানোর সেটাই মুখ্য উদ্দেশ্য। যেমন বাংলাদেশের বেলায় আমরা দেখেছি সেই পঞ্চাশের দশকে যখন পূর্ব পাকিস্তানে বামপন্থী বা কমিউনিস্ট ধ্যানধারণা বিস্তার লাভ করছে, সে সময় সিআইএর মাধ্যমে মার্কিন প্রশাসন তা ঠেকাতে নানা রকম কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। এই কর্মসূচির একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান ছিল কমিউনিজম ঠেকাতে মসজিদভিত্তিক সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন।
আমাদের জানানো হয়েছে, এ বছর যে সম্মেলন হয়ে গেল, সেটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে প্রথম পদক্ষেপ। এক বছর পর এই প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপে নেতা-নেত্রীদের সরাসরি উপস্থিতিতে যে শীর্ষ সম্মেলন হবে, তাতে হিসাব কষে দেখা হবে কোন দেশ তাদের অঙ্গীকার পালনে কতটা অগ্রসর হলো। অনেকটা সম্প্রতি ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনের মতো, যেখানে বিভিন্ন দেশ বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে কে কী করবে, তার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছে। গণতন্ত্র সম্মেলনে কোনো লিখিত-পড়িত অঙ্গীকার নেই।
তবে বাইডেন প্রশাসন যে কর্মসূচি নির্ধারণ করেছে, সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো তা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবে, হোয়াইট হাউস সে কথায় বিশ্বাস করে।
বাইডেন প্রশাসন ঘোষিত এই কর্মসূচিতে রয়েছে পাঁচটি আদর্শিক লক্ষ্য:
• দুর্নীতি প্রতিরোধ,
• গণতান্ত্রিক সংস্কার,
• গণতন্ত্রের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার,
• মুক্ত ও স্বাধীন নির্বাচনের সুরক্ষা ও
• কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে অবস্থান।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য মার্কিন সরকার মোট ৪২৫ মিলিয়ন ডলারের এক বিশেষ তহবিল গঠনের কথা ঘোষণা করেছে। ইউএস এইডের ব্যবস্থাপনায় এই অর্থ নানা প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হবে। যেমন নাগরিক স্বার্থে তথ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সমর্থনে থাকছে ৩০ মিলিয়ন ডলার, মিথ্যা ডিজিটাল মামলায় ফেঁসে যাওয়া সাংবাদিকদের সাহায্যের লক্ষ্যে থাকছে ৯ মিলিয়ন ডলার, দুর্নীতি দমনে সুশীল সমাজকে সাহায্য করার জন্য থাকছে ৫ মিলিয়ন ডলার ইত্যাদি। আমেরিকার জন্য ‘হাতের ময়লা’ এই অর্থ দিয়ে গণতন্ত্রের কোন হাত বা পা সুরক্ষিত হবে, তা আমরা জানি না। তবে ইউএসএইডের এই অর্থ কীভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেবেন, সে কথা ভেবে ইতিমধ্যেই অনেকের জিবে ঝোল পড়া শুরু হয়েছে তা অনুমান করা কঠিন নয়।
কোভিড ও গণতন্ত্র
বাইডেন প্রশাসন থেকে বারবার আমাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, ট্রাম্পের চার বছরে আমেরিকা বিশ্বে গণতন্ত্রের প্রসার থেকে সরে এসেছে। গণতন্ত্র প্রসারের বদলে এই সময়ে কর্তৃত্ববাদের হাত শক্ত হয়েছে। বাইডেন এই প্রবণতা বদলাতে চান, গণতন্ত্র প্রসারে যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যিক ভূমিকা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চান। খুবই সাধু উদ্দেশ্য। কিন্তু সে উদ্দেশ্য অর্জনে শীর্ষ সম্মেলন করে খুব একটা কাজ হবে এ কথা কেউ মনে করে না।
এই মুহূর্তে পৃথিবীর দরিদ্র গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ কোভিড অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াই। এই লড়াইতে পরাস্ত হলে শুধু গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা বিঘ্নিত হবে তা–ই নয়, বিশ্বের সব দেশের জাতীয় নিরাপত্তাও বিপদগ্রস্ত হবে। বাইডেন যদি সত্যি সত্যি আমেরিকার বৈশ্বিক নেতৃত্ব ফিরে পেতে চান, তাহলে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে এসব দেশের সঙ্গে কোভিড ভ্যাকসিন ভাগাভাগি করে নেওয়া। সম্প্রতি হোয়াইট হাউস থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, আফ্রিকা—যেখানে মাত্র ৬ শতাংশ মানুষ টিকা পেয়েছেন, সেখানে তারা সাহায্য হিসাবে ৯ মিলিয়ন ভ্যাকসিন পাঠাবে। আফ্রিকার মোট জনসংখ্যা ১২০০ মিলিয়ন, এই অতি সামান্য ফকিরি দান পেয়ে তারা কী করবে?
বাইডেন ও আমেরিকার জন্য অনেক অর্থপূর্ণ কাজ হতো তারা যদি আফ্রিকায় ও তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ভ্যাকসিন উৎপাদনে সাহায্য করত। এ জন্য দরকার ওষুধ কোম্পানিগুলোকে তাদের পেটেন্ট ভাগাভাগি করতে বাধ্য করা। শুকনো কথার ফুলঝুরির বদলে গণতন্ত্র রক্ষায় সেটি একটি কাজের কাজ হতো।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি