বন্দুক সহিংসতা বাড়ায় গরমকে দায়ী করছেন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেরা
যুক্তরাষ্ট্রে হলোটা কী? যে দেশ রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, সহিংসতা নিয়ে সোচ্চার, সে দেশেই একের পর এক সহিংস ঘটনা ঘটছে। গত কয়েক সপ্তাহে স্কুল, হাসপাতাল, গির্জা এমনকি শেষকৃত্যানুষ্ঠানেও হয়েছে বন্দুক হামলা।
টেক্সাস স্কুল ও টালসা হাসপাতালের বন্দুক সহিংসতার খবর গণমাধ্যমে এলেও এমন অনেক ঘটনা হয়তো গণমাধ্যমে আসেইনি। পরপর এত বন্দুক সহিংসতার পেছনের কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ দিয়েছে অদ্ভুত এক ব্যাখ্যা। এএফপির এক প্রতিবেদনে জানা যায়, দেশটির পুলিশ বিভাগ বলছে, গরমের সময় খুনিরা বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
আবহাওয়া ও অপরাধের মধ্যে যোগসূত্র থাকার বিষয়টি একেবারে নতুন নয়। অপরাধবিজ্ঞানীরা এ রকম যোগসূত্রের কথা বারবারই বলেছেন।
হাভার্ড টিএইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের স্বাস্থ্যনীতিবিষয়ক অধ্যাপক ডেভিড হেমেনওয়ে এএফপিকে বলেন, চারপাশে কেউ না থাকলে কাউকে গুলি করাটা কঠিন। তিনি বলেন, এ কারণে খারাপ আবহাওয়ায় বন্দুক সহিংসতার ঘটনা কম হয়। কারণ, আবহাওয়া খারাপ থাকলে মানুষ ঘরের বাইরে কম বের হয়।
গরমে মাথা গরম হয়েছে এমন কথা কমবেশি প্রচলিত। এ নিয়ে দ্বিমত অবশ্যই রয়েছে। তবে প্রচলিত ধারণা হলো, গরম আবহাওয়ায় মানুষ বেশি সহিংস আচরণ করে।
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। তবে একটি কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে আবহাওয়াকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে উষ্ণতা বাড়ছে। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পেছনে আবহাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে।
অধ্যাপক ডেভিড হেমেনওয়ে বলেন, গরম ও অপরাধের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার যোগসূত্র নিয়ে তিনি খুবই আগ্রহী। এ কারণে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল, ইতালির উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চল এবং ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও দক্ষিণ ভূমধ্যসাগরের দেশগুলোতে গরম আবহাওয়া ও অপরাধপ্রবণতা পর্যবেক্ষণ করেছেন।
২০২০ সালে হেমেনওয়ে ও তাঁর স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র পল রিপিং শিকাগো শহরের অপরাধমূলক ঘটনা নিয়ে গবেষণা করেন। ২০১২ থেকে ২০১৬ সালে শিকাগো শহরের অপরাধপ্রবণ ঘটনাগুলো তাঁদের গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
শিকাগো ট্রিবিউনে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে দৈনিক বন্দুক সহিংসতার ঘটনার সঙ্গে আবহাওয়ার তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বাতাসের গতি, তাপমাত্রার যোগসূত্র নিয়ে গবেষণা করা হয়। ওই গবেষণায় দেখা যায়, ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রায় ৩৪ শতাংশ বেশি বন্দুক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ছুটির দিন ও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ৪২ শতাংশ বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। গবেষকেরা আরও বলছেন, গড়ে ১০ ডিগ্রি তাপমাত্রা বেশি থাকলে বন্দুক সহিংসতা ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি ঘটে।
হেমেনওয়ে আরও বলেন, শুধু গ্রীষ্মকালে গরম পড়লেই যে এমনটা ঘটে, তা নয়। শীতকালে যেসব দিন তুলনামূলক বেশি উষ্ণ থাকে, সেসব দিনেও এ রকম অপরাধের ঘটনা বেশি ঘটে।
ফিলাডেলফিয়ার অপরাধমূলক ঘটনা নিয়েও একই রকম গবেষণা করেছেন ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক লিয়া সিচিনাসি। ২০১৭ সালে জার্নাল অব আরবান হেলথে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে সিচিনাসি ও সহলেখক ঘাসান হামরা বলেন, বেশি গরম মাসগুলোয় সহিংস ঘটনা বেশি ঘটেছে। মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস ছিল বেশি গরমের দিন। আর এ সময়টাতেই এসব সহিংস ঘটনা বেশি ঘটেছে। অন্যদিকে অক্টোবর থেকে এপ্রিলে শীতের সময় এ ধরনের সহিংস ঘটনা কম ঘটেছে। এই দুই গবেষক বলেন, ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার তুলনায় ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১৬ শতাংশ অপরাধ বেশি হয়েছে।
হেমেনওয়ে মনে করেন, আবহাওয়া ভালো থাকলে বেশি মানুষ ঘরের বাইরে থাকে। গরম আবহাওয়ার কারণে মানুষ কিছুটা আক্রমণাত্মকও থাকে।
২০১৯ সালে ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চে একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। কেনিয়া ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গরম শ্রেণিকক্ষ ও ঠান্ডা শ্রেণিকক্ষে থাকা শিক্ষার্থীদের আচরণগত দিক নিয়ে একটি গবেষণা করেন। তাতে দেখা যায়, বেশি গরম পরিবেশে থাকা শিক্ষার্থীরা বেশি আক্রমণাত্মক। তবে হেমেনওয়ে বলেন, বন্দুক সহিংসতার ক্ষেত্রে তাপমাত্রার প্রভাব নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে গরমের দিনগুলোয় সহিংসতাপ্রবণ এলাকাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন হেমেনওয়ে। কেবল বন্দুক সহিংসতা নয়, মারামারি ও সহিংস ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রেও গরম আবহাওয়ার প্রভাব নিয়ে গবেষণা দরকার বলে মনে করেন এই গবেষক।
একের পর এক বন্দুক সহিংসতার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিপর্যায়ে বন্দুক সহজলভ্য করার বিরোধিতা করছেন অনেকে। এ ক্ষেত্রে নিয়ম আরও কঠোর হওয়া দরকার বলে মনে করছেন তাঁরা। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বন্দুক নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। এসবের মধ্যে বন্দুক সহিংসতা বাড়ার পেছনে আবহাওয়াকে দায়ী করে বক্তব্য দিলেন গবেষকেরা।