‘রাশিয়ার হস্তক্ষেপের গল্প আমেরিকার রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ধাপ্পাবাজি। হিলারি আর ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গেই রাশিয়ার আঁতাত হয়েছিল।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গতকাল রোববারের টুইট এটি। এর থেকেই কিছুটা আঁচ করা যায়, বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট ম্যুলারের তদন্তের ভূতবিদায়ী ২০১৮ সালজুড়ে কতটা তাড়িয়ে বেড়িয়েছে ট্রাম্পকে।
নানা কর্মকাণ্ড, বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও মন্তব্যের কারণে পুরো বছরই ট্রাম্প আলোচনায় থেকেছেন, সমালোচনার ঝড় তুলেছেন, হয়েছেন সংবাদ শিরোনাম। বিশ্লেষকদের মতে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৮ সালজুড়ে হোয়াইট হাউস ও যুক্তরাষ্ট্রকে অস্থিতিশীলতা, ভাঙনের উৎসে পরিণত করেছেন।
গত ১২ মাসে বেশ কয়েকটি ধাক্কা সামলাতে হয়েছে ট্রাম্পকে। তাঁর সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন মিথ্যাচারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। সাবেক ব্যক্তিগত আইনজীবী মাইকেল কোহেনের তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলস ও ‘প্লেবয়’ সাময়িকীর সাবেক মডেল ক্যারেন ম্যাগডোগালের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে তাঁদের মুখ বন্ধ রাখতে নির্বাচনের আগে কোহেনের মাধ্যমে অর্থ দিয়েছিলেন ট্রাম্প। আদালতে কোহেন স্বীকার করেছেন, ‘বসের’ অপকর্ম ধামাচাপা দেওয়াই ছিল তাঁর কাজ। ট্রাম্প অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এতেই শেষ নয়। মতবিরোধসহ নানা কারণে চলতি বছর বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সহযোগীকে হারাতে হয়েছে ট্রাম্পকে। কেউ স্বেচ্ছায় বিদায় নিয়েছেন, কেউ পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, আবার কেউ হয়েছেন বরখাস্ত। আজ সোমবার হোয়াইট হাউসের চিফ অব স্টাফ জন কেলি, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিস এবং ভূমি ও খনিজসম্পদমন্ত্রী রায়ান জিঙ্কের শেষ কর্মদিবস। তাঁদের পদত্যাগের খবর আগেই এসেছে। এ ছাড়া এ বছর পদত্যাগ করা কিংবা বরখাস্ত হওয়া ট্রাম্পের সহযোগীদের মধ্যে সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হার্বার্ট র্যামন্ড ম্যাকমাস্টার, হোয়াইট হাউসের কৌশলগত যোগাযোগবিষয়ক উপদেষ্টা হপ হিকস, অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশনস, পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন, অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টোফার ক্যাম্পবেল প্রমুখ অন্যতম। এ ছাড়া গত আগস্টে ট্রাম্পের প্রচারণা শিবিরের সাবেক প্রধান পল ম্যানাফোর্টের বিরুদ্ধে আনা কর ফাঁকিসহ কয়েকটি অভিযোগ আনা হয়।
প্রতিবেশী মেক্সিকোর সঙ্গে সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণেও ট্রাম্প এ বছর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন। তাঁর মতে, ওই সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসী, অপরাধী ও সন্ত্রাসীরা ঢুকে পড়ছে এবং মাদক চোরাচালান হয়। কিন্তু মার্কিন কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাটদের পাশাপাশি ট্রাম্পের নিজের দল রিপাবলিকান পার্টির কিছু সদস্য দেয়াল নির্মাণের পরিকল্পনার সঙ্গে একমত নন। এ বিষয়সহ আরও কিছু বিষয়ে মতানৈক্যের জেরে ট্রাম্প প্রশাসনে চলতি বছর তৃতীয়বারের মতো অচলাবস্থা চলছে। ট্রাম্পের চাহিদামতো সরকারের ব্যয় নির্বাহের তহবিল কংগ্রেস অনুমোদন না দেওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মেক্সিকো ও কানাডার সঙ্গে তাঁর দেশের স্বাক্ষরিত নাফটা চুক্তি বাতিলেরও ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প।
ডাকা (মা-বাবার সঙ্গে শিশু বয়সে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা ব্যক্তিদের পুনর্বাসন) কর্মসূচি বাতিল করা নিয়েও বেশ সমালোচনার সৃষ্টি করেছেন ট্রাম্প। নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্রেটিক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন ট্রাম্পকে আরও কিছুটা বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। ট্রাম্প এ বছর একটা বিজয়ই পেয়েছেন। যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও গত সেপ্টেম্বরে ব্রেট কাভানাকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করতে পেরেছেন তিনি।
এ তো গেল জাতীয় পর্যায়ের কয়েকটি ইস্যু। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নানা কর্মকাণ্ডে, মন্তব্যে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছেন ট্রাম্প। বছরটা তিনি শুরু করেছিলেন উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ নেতা কিম জং–উনকে পারমাণবিক বোমা হামলার হুমকি দিয়ে। বলেছিলেন, কিমের চেয়ে পারমাণবিক বোমার বড় বোতাম তাঁর কাছে রয়েছে। সেই কিমের সঙ্গে গত ১২ জুন সিঙ্গাপুরে সাক্ষাৎ করে কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা নিরসনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। বছরের শেষ দিকে এসে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা কমানোর এবং সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন ট্রাম্প।
তবে ইসরায়েলে মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর এবং তার আগে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী স্বীকৃতি দিয়ে এবং মে মাসে ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে সমালোচনার ঝড় তুলেছিলেন ট্রাম্প। সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ড দিয়ে একেক সময় একেক মন্তব্য করে এবং শেষ পর্যন্ত সৌদি রাজপরিবারের পক্ষেই নিজের অবস্থান ধরে রেখেও সমালোচিত হয়েছেন ট্রাম্প।
সূত্র: সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্ট