হুমায়ূন আহমেদ রচিত উপন্যাস ‘দেবী’ আমার পড়া হয়নি। ‘দেবী’র কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ব্যাপক সাড়া পড়েছে দেশে। হলবিমুখ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী আগ্রহী হয়েছেন সিনেমা দেখতে। আমিও অপেক্ষায় ছিলাম ‘দেবী’ দেখার। ‘দেবী’ এসে গেল নিউইয়র্কে। ৯ নভেম্বর শুক্রবার জ্যামাইকার একটি থিয়েটারে সন্ধ্যার শোতে ‘দেবী’ দর্শনে গেলাম। অনলাইনে আগেই টিকিট কেটেছিলাম। এত আলোচনা ‘দেবী’ নিয়ে যে, প্রযোজক জয়া আহসান চমকিত।
‘দেবী’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন অনম বিশ্বাস। হুমায়ূন আহমেদ বলেই এমন ভৌতিক গল্প রচনা করতে পেরেছেন। কাহিনি সাদামাটা গৎবাঁধা নয়। অতি ভৌতিক। নানা অলীক শব্দ, হাসি, রোম খাড়া হয়ে যাওয়ার মতো দৃশ্য বদল—রীতিমতো আত্মা শুকিয়ে দেয়। রানু নামের একটি পিতৃমাতৃহীন মেয়ে (জয়া আহসান) মফস্বলে চাচার পরিবারে বেড়ে উঠছে। বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। মন্দিরে যায়। একা। কী শোনে, কী দেখে, একা একা কথা বলে, হাসে। ভূতে-ধরা মেয়ে। চাচাতো বোনের বিয়ের হলুদের দিন অনেক আনন্দে মাতে কিশোরী রানু। শরীরে কাদা মেখে হইচই করে। দল বেঁধে মেয়েরা নদীতে গোসল করতে যায়। রানু হঠাৎ টের পায় পানির নিচে কে যেন তার পা ধরে টানছে। এক সময় বুঝতে পারে তার পায়জামার ফিতা খোলা হচ্ছে। অতি লোমহর্ষক ঘটনা। রানু অজ্ঞান হয়ে যায়। একটি মৃত যুবা লাশ তাকে জড়িয়ে রেখেছে। সেই থেকে রানুর আচরণ কিছুটা অস্বাভাবিক। রানু ঢাকায় থাকে স্বামীর সঙ্গে। দিন দিন তার শরীর খারাপ হয়। ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। বাড়িওয়ালার মেয়ে নীলুকে সে একদিন বলে, আপনি গাড়িতে করে ভার্সিটিতে যাবেন না।
নীলু বিস্ময় প্রকাশ করে, কেন? আমি কি তাহলে রিকশায় যেতে পারি?
-হ্যাঁ যেতে পারেন।
সত্যিই নীলুদের গাড়িটির সেদিন অ্যাকসিডেন্ট হয়। সেই সূত্রে নীলুর সঙ্গে রানুর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। রানু আগেভাগে অনেক কিছু টের পায় এবং ভালোমন্দ বলে দিতে পারে। রানুর স্বামী আনিস রানুর বিষয়ে বিচলিত হয়। একজন দায়িত্বশীল স্বামী যা করে, আনিসও তাই করল। পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মিসির আলী শখের বশে মনোচিকিৎসা করেন। বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি। অলীক ভৌতিক কোনো কিছু তাঁর ভিতকে নড়াতে পারে না। আনিস রানুকে মিসির আলীর কাছে নিয়ে আসে। মিসির আলী রানুর সমস্যার কথা শুনে ঝাঁপিয়ে পড়েন রানুর আরোগ্যের জন্য।
মিসির আলীকে ‘দেবী’র প্রধান চরিত্র বলা যায়। মিসির আলী চরিত্রে রূপদান করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। অনবদ্য অভিনয় করেছেন চঞ্চল। অন্যরকম একটি বাড়িতে থাকেন মিসির আলী। বাড়িটি বইয়ে ঠাসা, আর টবে আছে হরেক রকম গাছ। চোখে পড়ার মতো ছিল জবা ফুল গাছ। তেরো মাস হয়েছে আনিস আর রানুর বিবাহিত জীবনের। ছাব্বিশ বছরের রানু নিজে আতঙ্কে থাকে। আনিস মায়াময় দৃষ্টিতে রানুর দিকে তাকায় ভালোবেসে। রানু টের পায় কে যেন তাকে ডাকে—আয় আয়!
রানু একই চেহারা ও বয়সের দুটি কিশোরী মেয়েকে দেখে। একটি কি সে নিজে, অন্যটি নীলু? বাড়িওয়ালার মেয়ে কি? দর্শকদের
মনের মধ্যে কৌতূহল জাগে রানু আর নীলু কি একই সত্তা?
শুরু হয় মিসির আলীর সত্য অনুসন্ধান। তিনি ছুটে চলেন রানুর শৈশবে বেড়ে-ওঠা গ্রামে তথ্য সংগ্রহের জন্য। বারবার মিসির আলী বলেন, মৃত মানুষ কী করে পায়জামার ফিতা খুলবে? এই একটি ডায়ালগ কুসংস্কারাচ্ছন্ন অশিক্ষিত সমাজ জীবনকে তুলে ধরে। রানুর স্বামী আনিসকে মিসির আলী প্রশ্ন করেন, ‘আপনিও ভূত বিশ্বাস করেন?’
প্রশ্নটি যেন দর্শকদেরও তিনি করে বসেন। প্রচণ্ড একটি ঘোরের মধ্যে প্রযোজক জয়া আহসান সকল কলাকুশলী ও দর্শকদের নিয়ে ছুটতে থাকেন। দৃশ্যপট সুন্দর। অনেক দিনের ছেড়ে আসা আমাদের ঢাকা শহর হঠাৎ যেন প্রবাসীদের মন ভরিয়ে দিল।
ঢাকার সকালের রূপ কী মায়াময়! রানুর ছাদের রেলিঙে একাকী রোদ মেখে বসে থাকা; কে যেন ডাকে—আয়, আয়। ক্যামেরার কাজ চমৎকার। নীলুর প্রেমিক ভয়ংকর এক অমানুষ। ইরেশ যাকের পৃথিবীর মানুষ হয়েও যেন পৃথিবীর নয়। ভূত-প্রেতের আত্মা তার ভেতরে, যার বিকট ভৌতিক হাসি রানুও শুনেছে বারবার।
নীলুকে হত্যা করার জন্য সে কি ভয়ংকর বীভৎস কুৎসিত রূপ ধারণ করেছিল। তখন দর্শকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত রানুর বেঁচে থাকা সম্ভব হয় না। একটি কবর রানুর। মিসির আলী দাঁড়িয়ে আছেন। জয়ার বান্ধবী নীলু এসে সামনে দাঁড়ায়, ‘স্যার আমাকে চেনেন? আমি নীলু।’ মিসির আলী নিচুস্বরে নরম মায়াময় কণ্ঠে বলেন, ‘কিছু সত্য প্রকৃতি পরম মমতায় নিজের কাছে লুকিয়ে রাখে।’
আমি দর্শক হিসেবে এ রহস্যের কুল কিনারা পাব কি? জানি না। জয়া আহসানকে অভিনন্দন মনকাড়া হৃদয়গ্রাহী চমৎকার অভিনয় করার জন্য। অভিনন্দন সকল কলাকুশলী থেকে যথাযথ অভিনয় আদায় করে নেওয়ার জন্য চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক অনম বিশ্বাসকে। ‘দেবী’ ভৌতিক কাহিনির পটে নির্মিত এক রহস্যময় চলচ্চিত্র। ‘দেবী’ সব দর্শকের মন ছুঁয়ে দেবে তা বলা যায় না। তবে একটা ভিন্ন স্বাদ দেবে, তা নিশ্চিত করে
বলা যায়।