পথে যেতে যেতে
দেশ থেকে পরবাসে
আমি এখন প্রবাসী। বাংলাদেশ ছেড়ে, আটলান্টিক সাগর পার হয়ে আমেরিকার নিউইয়র্কে নতুন আবাস গড়েছি। এখানে আমার আরেকটা জীবন। স্বপ্নের শহর নিউইয়র্কে এসে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছি কঠিন বাস্তবতাকে। প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এ দেশে থাকতে হলে প্রথম শর্তই হচ্ছে কাজ। কাজ না করে এখানে বাস করাটা অসম্ভব। সে দিক থেকে আমি ভাগ্যবান। একটি স্কুলে কাজ পেলাম। স্কুলটি কলেজ পয়েন্টে, আমি থাকি জ্যামাইকায়। সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত কাজের সময়। কাজে যেতে হয় বাসে করে। প্রতিদিন তিন থেকে চার ঘণ্টা কাটে পথে। বাড়ির কাছেই বাস স্টপেজ। ব্রায়ারউড টু কলেজ পয়েন্ট, Q20A নম্বর বাসটি আমার নিত্যদিনের সঙ্গী।
নানা বর্ণ, নানা ভাষা
সকালে বাসে বেশ ভিড় থাকে। দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বাসে বয়স্ক, অসুস্থ মানুষের জন্য সামনের সিট বরাদ্দ থাকে। তাই চেষ্টা করি পেছনের কোনো আসনে বসতে। বাসের ভেতর নানা বর্ণের নানা যাত্রী, নানা ভাষা আর নানা প্রকৃতির। জানালার পাশে তাকিয়ে নতুন শহর দেখি, মানুষ দেখি; দেখি প্রকৃতি। এই দু বছরে বাসের যাত্রীরা যেন আমার পরিচিত। কোথা থেকে কে উঠবে আর কোথায় নামবে তা জেনে গেছি। সবাই যেন আমার চেনা; আবার অচেনাও। পাশাপাশি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকলেও কেউ কোনো কথা বলে না। এত মানুষ একসঙ্গে আছি তবুও কেউ কারও নয়, এত নীরবতা! সবাই সেলফোনের ওপর ঝুঁকে আছে। একজনকে পেলাম চায়নিজ। কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে বসার জায়গা দেখিয়ে দেন। আমি তো ভীষণ অবাক! একি, আমি তো এলাম নিউইয়র্কে, এখন দেখছি হাজারো চায়নিজ ছুটে বেড়াচ্ছে ফ্লাশিংয়ে। তাঁদের দাবি, আমেরিকার প্রথম অধিবাসী নাকি তাঁরাই। আমার স্কুলও চায়নিজদের। চেষ্টা করেও তাঁদের ভাষা কিছু শিখতে পারিনি। তবে সময় খুব ভালোই কেটে যায় বাচ্চাদের সঙ্গে মিলেমিশে। দেশে যখন ছিলাম পরিচিত মুখ বলে যেখানেই যেতাম সম্মান ভালোবাসা পেতাম। এসবেই অভ্যস্ত ছিলাম। কিন্তু এখানে এখানে আমি কেউ নই। একজন কর্মজীবী মানুষ মাত্র। একজন বাসযাত্রী মাত্র, আর কিছু নয়! এ দীর্ঘ পথে আমি একা।
ভয়ে, শঙ্কা আর অস্বস্তি
এখানে বর্ষা নেই। আমি যে দেশের মানুষ যেখানে ছয়টি ঋতু বর্ণ গন্ধ নিয়ে হাজির হতো নিয়ম করে। আর এখানে আবহাওয়া দেখে ঘর থেকে বের হতে হয়। কখনো বৃষ্টি, কখনো বেশি গরম। পোশাক কোট মাফলার টুপি ছাতা কত কী যে বয়ে বেড়াতে হয়! আমাদের বাড়ির জানালার বাইরে ক্রিসমাস গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বের হওয়ার আগে রোজ সকালে ওই গাছের দিকে তাকাই। বাতাস বেশি হচ্ছে নাকি বৃষ্টি পড়ছে তা বুঝতে পারি ওই গাছ দেখে। ওই ক্রিসমাস ট্রি আমার আবহাওয়ার মানদণ্ড।
শীতে বেশ কাবু হয়ে যাই। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় কাশি। বাসে কিছুতেই কাশি দেওয়া যাবে না। কেউ কাশে না। কাশি দিলে পাশের যাত্রী এমন ভাবে তাকায় যেন আমি যক্ষ্মার রোগী। যাত্রাপথের এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিল আমার ছেলে প্রিয়। ও একটা হেডফোন কিনে দিল। গান শুনে সময় কাটে। আমার অচেনা পরিবেশ থেকে ডুব দিই রবীন্দ্র সরোবরে। মন চলে যায় বাংলাদেশে। পরিচিত মানুষ, পরিচিত জায়গা বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, শিল্পকলা একাডেমি, উত্তরা শুটিং হাউস আর আমাদের বসুন্ধরার বাড়ির ছাদে। একে একে সব ধরা দেয়। চোখ ভিজে আসে।
ঘড়ির অ্যালার্মে জীবনচক্র
নিউইয়র্কের মানুষের জীবন আবর্তিত হয় ঘড়ির কাঁটা ধরে। যখন কাজের সময় তখন ছুটছে মানুষ। কেউ দিনে, রাতে বা মাঝরাতে। আমার সময় ভোরবেলা। বাড়ি থেকে বের হতে সাড়ে ছয়টায়। কখনো এমন হয়েছে সকালে কাজে যাওয়ার চিন্তায় নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছি রাত। বাইরে হয়তো স্নো পড়ছে। বাসস্টপে পৌঁছে দেখি আরে একি! বাস থেকে নামছে কে? চেনা চেনা লাগছে যেন! আরে এ তো আমারই ছেলে প্রিয়! সুদীপ্ত প্রিয়দর্শন!
কখনো কখনো মা আর ছেলে মেট্রো কার্ড আদান প্রদান করি। হয়তো ওর কাজ শেষ হয়ে গেছে। বেড়াতে যাওয়ার সময় আমার কার্ডটা নিয়ে গেছে। আমি আবার সকালে যাওয়ার পথে ওর কাছ থেকে কার্ড ফেরত নিই। নিউইয়র্কে এসেছে পড়াশোনা করতে। কাজও করে। ডানকিন ডোনাটে রাতের শিফটেই কাজ পড়ে ওর। সারা রাত কাজ করে ছেলে ঘরে ফিরছে আর মা কাজে যাচ্ছে ভোরে। দুজনের একই পথ। মাতা-পুত্রের ক্রসিং। একই বাসের যাত্রী আমরা—‘কিউটুয়েন্টিওয়ান-এ’।
রঙিন পাতা-ঝরা পাতা
যেতে যেতে পথের ধারের সব গাছের সঙ্গে এখন আমার জানাশোনা। দেখি বসন্তের সবুজ পাতারা কেমন করে বর্ণিল হয়ে ওঠে ঝরে যাওয়া আগে; আর বসন্তের আঘাতে ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়। পাতা নেই। শুধুই ফুল, ফুল ঝরে। তারপর আসে সবুজ পাতা। একদিন তো এমন বসন্তে বাস থেকে নেমে গেলাম ফুলের সঙ্গে ছবি তুলব বলে। আরেকবার তুষারঝড়ে পড়েছিলাম এখানে। প্রচণ্ড ঝড়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম বাসের জন্য। চারপাশে কিছুই দেখতে পারছি না। হাতে ছাতা কোথায় উড়ে গেল কে জানে! এ রকম অভিজ্ঞতা এই প্রথম! শেষ পর্যন্ত তুষারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বাড়ি পৌঁছেছিলাম।
মেইন স্ট্রিট থেকে কখনো বা ফ্লাশিং থেকে এক জোড়া চায়নিজ ছেলে-মেয়ে সহযাত্রী হয় প্রতিদিন। হাইস্কুলের ছাত্র ছেলেটি মেয়েটির জন্য খাবার কিনে আনে। দুজনে পাশাপাশি বসে। ছেলেটি মেয়েটির চুল সরিয়ে দেয় পরম ভালোবাসায়! কী গভীর ভালোবাসা ফুটে ওঠে পরস্পরের মধ্যে। চারপাশের সবকিছু ভুলে ওরা দুজন দুজনের হাত ধরে বসে থাকে। আমি আড়চোখে দেখি। ওদের ভালোবাসার গভীরতা আপ্লুত করে। ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে ভালোবাসার বড় কাঙাল যে মন আমার!
চলতে চলতে, দুলতে দুলতে
বাসে বসে সকালের নাশতা সেরে নেয় অনেকেই। আমিও এখন তাদের দলে। প্রতিদিন এই পথে অনেকগুলো স্কুল কলেজ পড়ে। তাই ছাত্রদের সঙ্গে মিলেমিশে একসঙ্গে পথ চলতে হয়। ছাত্ররা যে যার জায়গায় নেমে যায় বলে একটু স্বস্তি। একজন স্প্যানিশ মাকে দেখি প্রতিদিন তিন সন্তানকে নিয়ে সকালে বাসে ওঠেন। ছেলে দুটি চার বছরের হবে, যমজ। বাসে তিন ভাইবোন পাশাপাশি বসতে চায়। সেটা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে আমি উঠে ওই তিনজনকে এক করার চেষ্টা করি। কোঁকড়া চুলের মিষ্টি মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। স্কুলের শিশুদের সঙ্গে আমার বেশ ভালোই জমে। ফিওনা, অলিভিয়া, সামার এমারসান, মিয়া, মেডি কত-না সব ভালোবাসার নাম। আমার এই জীবনে ওরা যেন এখন স্বপ্ন, বেঁচে থাকার প্রেরণা।
আমার স্কুলের বাচ্চাদের কাছে আমার নাকের ফুল খুবই প্রিয়। জানতে চায় এটা কী? বলি, নোজ পিন। তবু ওদের বিস্ময় কাটে না। চশমার আড়ালে ঢাকা পড়া ওই নাকের ফুলটি আমাকে ওদের থেকে স্বতন্ত্র করে।
বসন্ত ভাবে ও বৈপরীত্যে
নিউইয়র্কে এখন বসন্ত। পথে যেতে যেতে রাস্তার দুই পাশে রঙিন টিউলিপের সমাহার দেখি। এখানে প্রকৃতি বড় রহস্যময়। এই বৃষ্টি এই রোদ, এই ঠান্ডা এই বাতাস। এই বসন্তে থেকে থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশ মেঘলা। রোদের দেখা নেই। একা একা পথ চলি। অনেক কথা মনে আসে, এ শহরের সঙ্গে নিজের দেশের তুলনা করি। এখানে নিয়ম মেনে চলাটা অভ্যাস। রাজনীতির কোনো প্রভাবই মানুষের জীবনে পড়ে না। মানুষ এখানে নির্ভার, স্বাধীন। একা একা পথ চলতে কেউ ভয় পায় না। সাত সকালে বৃদ্ধ থেকে যুবক, মধ্যবয়সী কিংবা শিশু-কিশোর-ছুটছে সবাই। আবার এক এক করে সবাই নেমে যাচ্ছে। ব্রায়ারউড হয়ে কিউগার্ডেন ও মেইন স্ট্রিট ধরে ফ্লাশিং। তারপর কলেজ পয়েন্ট! একসময় সবাই নেমে যায়। বাসে আমি একা হয়ে যাই। কিছুক্ষণের মধ্যে আমিও নেমে যাব।
বসে বসে ভাবি বাস এবং একা একটি মেয়ে আমাদের দেশে এখন এক ভয়ংকর ব্যাপার। বাসে যাতায়াত করা শাহিনা আক্তার তানিয়া। তিনি তো পূর্ণবয়স্ক তরুণী। ঢাকা শহরের ইবনে সিনা হাসপাতালে নার্স ছিলেন। কতগুলো অমানুষ ধর্ষণ শেষে তাঁকে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে দিল! এ কোন বাংলাদেশ? এই দেশ এই সমাজ এই মানুষের স্বপ্ন কি মুক্তিযুদ্ধে মানুষ দেখেছিল? কবে হবে সেই বাংলাদেশ যেখানে একটি মেয়ে নিরাপদে একাকী পথ চলতে পারবে? দেশ ছেড়ে এই পরবাসের বাসে বসে বসে একা সেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি।