প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতির কারণে শুধু অভিবাসীরা নয়, বিপাকে পড়েছেন আমেরিকার অভিবাসী অ্যাটর্নিরাও। নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে পরিস্থিতি এমন জটিল করে তোলা হয়েছে যে, আইনজীবীরা পরামর্শ দিতে ভয় পাচ্ছেন। সরকারি সুবিধা নিলে গ্রিনকার্ড দেওয়া হবে না, নাগরিকত্ব পেতে অসুবিধা হবে—এসব বিধি আরোপের ফলে চরম সংকটে পড়েছেন অনেকেই।
শুধু নিউইয়র্কে প্রায় পাঁচ লাখ অভিবাসী খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা নেন। এ সুবিধা অব্যাহত রাখলে তাদের আমেরিকায় থাকা অনিশ্চিত হয়ে উঠবে। নিউইয়র্ক সিটি কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে ডেইলি নিউজ পত্রিকা ১১ অক্টোবর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, মার্কিন নাগরিক নয়, নিউইয়র্কে এমন দুই লাখ ২০ হাজার অভিবাসী খাদ্য, নগদ সহযোগিতাসহ অন্যান্য সরকারি পারিষেবা নিয়ে থাকেন। ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন চালু করা নীতিমালার কারণে বিপাকে পড়বেন এসব ঝুঁকিপূর্ণ মানুষ। এর মধ্যে ৭৫ হাজার অভিবাসীকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা সরকারি সাহায্য গ্রহণ করবেন, নাকি আমেরিকার ঝুঁকিপূর্ণ জীবন পরিহার করে নিজেই এ দেশ ছাড়বেন।
নিউইয়র্কের মেয়র ট্রাম্প প্রশাসনের এমন উদ্যোগকে অমানবিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। বৈধভাবে সরকারি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল স্বল্প আয়ের অভিবাসী পরিবারের জন্য রীতিমতো দুঃসংবাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে বিষয়টিকে।
বহিষ্কারের আতঙ্কে উইক (ডব্লিউআইসি) নামে আমেরিকার নারী ও শিশুদের জন্য চালু থাকা সরকারি খাদ্য ও পুষ্টি কর্মসূচি থেকে অনেকেই নিজেদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। উইমেন, ইনফ্যান্ট এবং চিলড্রেন বা ডব্লিউআইসি কর্মসূচির আওতায় শিশু, সন্তান ও মায়েদের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। অভিবাসীরা আমেরিকায় থাকবে নাকি ক্ষুধার্ত থাকবে—এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি এখন তারা। স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা না নিয়ে জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করবে, নাকি আমেরিকার অভিবাসন গ্রহণ করবে—এমন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি এখন অভিবাসীদের দেশ আমেরিকার কোটি কোটি অভিবাসী।
ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসন কঠোর করতে গিয়ে বাজেট সংকটে পড়ছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিলের অন্যান্য খাত থেকে তহবিল নিয়ে অভিবাসীদের বাগড়া দেওয়া হচ্ছে। দৈব দুর্বিপাকের জন্য বরাদ্দ দেওয়া তহবিল থেকে টেক্সাস সীমান্তের আটক অভিবাসীদের জন্য তাঁবু খাটানো হয়েছে। ইউএস টুডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেমা নামের পরিচিত ফেডারেল তহবিল থেকে অভিবাসন বিভাগকে এক কোটি ডলার দেওয়া হয়েছে। আটক অভিবাসীদের স্থান সংকুলানের জন্য গত সপ্তাহেই ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই অর্থ অভিবাসন সংক্রান্ত নতুন বিধি ফেডারেল রেজিস্ট্রিতে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। কার্যকর করার প্রাথমিক ধাপ এটি। এই তালিকাভুক্তির পর জনমত ও বিশেষজ্ঞ মতামত আসবে এবং ৬০ দিন পর তা কার্যকর করা হবে। নতুন বিধিতে গ্রিনকার্ড পাওয়ার জন্য বা কাউকে পারিবারিক অভিবাসনের জন্য স্পনসর করতে স্পনসরকারীর আয়ের সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে। তালিকাভুক্ত বিধিতে অনেক কিছুই আড়াল করা প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে বিধির ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
সব জায়গায় উৎকণ্ঠা। ট্রাম্প প্রশাসন শুধু অবৈধ নয়, বৈধ অভিবাসীদের জন্য আমেরিকাকে কঠিন করে তোলার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। ফ্লোরিডার ইমিগ্রেশন অ্যাটর্নি লিজা গালিদোর অফিসে অনবরত ফোন আসছে। উৎকণ্ঠিত অভিবাসীরা পরামর্শ চাচ্ছেন। আমেরিকার ইমিগ্রেশন নিয়ে অভিজ্ঞ এই আইনজীবী বললেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। এটি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত দেখতে হবে’। তিনি বলেন, ‘আমি অভিবাসনপ্রত্যাশী মক্কেলদের বলছি, আমরা এখনো জানি না।’
ট্রাম প্রশাসনের প্রস্তাব অনুযায়ী, ৪৪৭ পৃষ্ঠার নতুন বিধিকে ভয় ও বিভ্রান্তির সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে বলে মনে করেন অভিবাসন বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা।
নতুন নিয়মে ব্যাপকভাবে সরকারি সুবিধাগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে। এসব সুবিধা অভিবাসীরা ব্যবহাত করলে স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অযোগ্য ঘোষণা করা হবে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ বলছে, সরকারি সুবিধা ভোগ এমন ইঙ্গিত দেয় যে, অভিবাসী ভবিষ্যতে আমেরিকার সরকারি পরিষেবার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। প্রস্তাবটি এমনকি আরও গভীরে চলে গেছে। স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, নানা কারণে সরকারি সুবিধা পাওয়ার যোগ্য হলেও অভিবাসীদের জরুরি সেবা থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া হবে।
জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড সুপার বলেন, অনিশ্চয়তা বৃদ্ধির জন্য সরকারের প্রচেষ্টায় অভিবাসীদের মধ্যে একটি ‘শীতল প্রভাব’ সৃষ্টি হয়েছে। যারা এখন আইনিভাবে প্রাপ্য সরকারি পরিষেবাগুলোর গ্রহণে ভীত হয়ে পড়েছে। অভিবাসীরা খাদ্য বা সরকারি আবাসন সহায়তার পাশাপাশি ডব্লিউআইসি নামে পরিচিত নারী এবং শিশুদের জন্য বিশেষ পুষ্টি প্রোগ্রাম ব্যবহার করতে পারে। গর্ভবতী নারীদের মধ্যে যারা বুকের দুধ দিয়ে সন্তান লালন করেন এবং পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা সরকারি খাদ্য সহায়তা পেয়ে থাকে। পুষ্টির ঝুঁকি থেকে রক্ষা করার জন্য ডব্লিউআইসি কর্মসূচি আমেরিকায় বেশ জনপ্রিয় কর্মসূচি।
অধ্যাপক ডেভিড সুপার বলেন, তিনি অনেক ক্লিনিকের কাছ থেকে শুনেছেন, অভিবাসীরা এখন সেই সহায়তাকে ত্যাগ করছে। এতে করে আমেরিকায় থেকেও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলো আরও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ স্বীকার করেছে, নতুন বিধিবিধান গ্রিনকার্ড পেতে পারে—এমন ব্যক্তিদের সংখ্যা সীমাবদ্ধ করবে। এক বছরে ৩ লাখ ৮০ হাজারের বেশি গ্রিনকার্ড আবেদন কঠোর যাচাই বাছাইয়ে মধ্যে পড়বে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বছরে করদাতাদের ২২৭ কোটি ডলার বাঁচানোর জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
ডেমোক্র্যাট দলের সিনেটর ট্যামি ডকওয়ার্থ অভিবাসন প্রস্তাবটিকে ‘হতাশার এবং বিপজ্জনক’ বলে উল্লেখ করেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘যখন আমি হাইস্কুলে ছিলাম, তখন আমার পরিবার বেঁচে থাকার জন্য ফুড স্ট্যাম্পের ওপর নির্ভর করেছিল।’ তিনি বলেন, ‘আমার মা একজন অভিবাসী ছিলেন। যদি এই অভিবাসন প্রস্তাবটি সেই বছরগুলোতে হতো, তবে আমার পরিবার আমেরিকার নাগরিকত্ব পেত না অথবা ক্ষুধার্ত থাকতে হতো ।’
অভিবাসী এই আইন প্রণেতা বলেন, এখন অনেক অভিবাসী পরিবারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা ক্ষুধার্ত থাকবে, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকবে নাকি আমেরিকায় থাকবে। প্রস্তাবটি নিষ্ঠুর, অগ্রহণযোগ্য ও অ-আমেরিকান।’
অভিবাসন অ্যাটর্নি জেরাল্ড বার্নস জানান, তিনি এমন কিছু অভিবাসী বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন, যারা অভিবাসনের স্বার্থে সন্তানদের সরকারি সহায়তার বাইরে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। বাবা-মায়ের জন্য এটি কঠিন সিদ্ধান্ত।
বার্নস বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো অভিবাসীদের গ্রিনকার্ড ও অন্যান্য অভিবাসন সুবিধাগুলোর জন্য আবেদন থেকে নিরুৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে আরোপ করা হয়েছে। এমন অভিবাসন বিধি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর প্রশাসনের মনোভাবের সঙ্গে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ।