নিউইয়র্কে শেষ
আলী আহমেদ ক্লান্ত চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত প্রায় একটা বাজে। হুট করে কিভাবে তিন ঘণ্টা সময় কেটে গেছে তিনি টেরও পাননি। এখন খিদে জানান দিচ্ছে। তিনি যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন, সেখানে রান্নাঘর থাকলেও তার ব্যবহার হয় না বললেই চলে। কারণ, রান্নাবান্নায় তিনি বা তাঁর রুমমেট দুজনেই একেবারে আনাড়ি! দুজনের কেউ ঠিকমতো ভাতটা পর্যন্ত রাঁধতে পারেন না। অতএব খাবার-দাবার দুজনকেই বাইরে সারতে হয়।
আলী আহমেদ আজ সন্ধ্যা থেকে গোছগাছ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ত্রিশ বছর আমেরিকায় থাকার পর আগামীকাল ভোরবেলা চিরতরে ফিরে যাচ্ছেন দেশে। আজ সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফেরার পর স্যুটকেস গোছাতে শুরু করলেন। প্রথমে মনে হয়েছিল এই কাজ তাঁর পক্ষে শেষ করাটা সম্ভব হবে না। তবে এখন মনে হচ্ছে তিনি অসাধ্যসাধন করেছেন। স্যুটকেসে তালা লাগানোর পর তৃপ্তির হাসি হাসলেন তিনি। অবশ্য তাঁর রুমমেট বাপ্পি তাঁকে অনেক সাহায্য করেছে। সে নিজেই বড় স্যুটকেসটা গুছিয়ে দিয়েছে সুন্দর করে।
আলী আহমেদ ভোরবেলা যে পোশাক পরে এয়ারপোর্ট যাবেন, সেটা বিছানার একপাশে রেখেছেন। পাসপোর্ট, টিকিট, মানিব্যাগ, টাকা সবকিছু বিছানার সাইড টেবিলের ড্রয়ারে রাখলেন ঘুম থেকে উঠেই, যেন কিছু খুঁজতে না হয়; সবকিছু যেন হাতের নাগালে থাকে। ভোরবেলা রুমমেট বাপ্পি তাঁকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দেবে। যদিও তিনি তাঁকে মানা করেছিলেন। তবে ছেলেটা মানল না!
তিনি বাপ্পিকে বলেছিলেন, ‘তুমি সারা রাত কাজ করে আসবে; শরীর থাকবে টায়ার্ড! কী দরকার আমাকে নামানোর? আমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে না হয় চলে যাব!’
বাপ্পি হেসে বলেছিল, ‘আংকেল আপনি তো বাংলাদেশে বেড়াতে যাচ্ছেন না, একবারে চলে যাচ্ছেন। আর কবে আপনার সাথে দেখা হবে, সেটার ঠিক নাই! আমি আপনাকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দেব।’
বাপ্পি এখন কাজে আছে। রাতের শিফটে ক্যাব চালায়। কমবয়সী ছেলে; তাঁকে চাচা ডাকে। তাঁর সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক। অবশ্য তাঁর সঙ্গে সবারই ভালো সম্পর্ক। তিনি স্বল্পভাষী, নম্র স্বভাবের, নির্লিপ্ত গোছের একজন মানুষ। কারও সাতেও নাই, পাঁচেও নাই। নিজের মতো করে খুব সহজ-সরল জীবনযাপন করেন। বাপ্পি ছেলেটাও ঠিক তাই!
আলী আহমেদের রুটিন প্রতিদিনই মোটামুটি একরকম। ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে ওঠা, তারপর বাথরুম সেরে তৈরি হয়ে গ্যারেজের দিকে রওনা হওয়া। তিনি পেশায় ক্যাবচালক। তাঁর ট্যাক্সি গ্যারেজ উডসাইডে; থাকেন জ্যাকসন হাইটসে। সাবওয়েতে জ্যাকসন হাইটস থেকে উডসাইডে যেতে বেশিক্ষণ লাগে না। সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ম্যানহাটনে। ম্যানহাটনে ঢুকেই তাঁর প্রথম কাজ সিক্সটি ফার্স্ট ও সেকেন্ড অ্যাভিনিউয়ের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা ইন্ডিয়ান হকারের কাছে থেকে নিউইয়র্ক পোস্ট কেনা। তারপর সিক্সটি ফার্স্ট ও লেক্সিংটন অ্যাভিনিউয়ের কোনায় পার্ক করা কফি কার্ট থেকে এক কাপ কফি কেনা। কফি বিক্রেতা তাঁকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই কফি বানিয়ে ফেলে। কিছুই বলতে হয় না, দরকারও নেই; একই লোকের কাছ থেকে প্রায় বিশ বছর ধরে কফি কিনছেন। গরম কফিতে চুমুক দিয়ে কাজ শুরু। কাজ শুরু মানে যাত্রী খোঁজা। কাজ শেষ করেন বিকেলবেলা। গ্যারেজে গাড়ি জমা দিয়ে সোজা জ্যাকসন হাইটসে। সেখানে পৌঁছানোর পর কোনো দেশি রেস্টুরেন্ট থেকে এক কাপ চা কিনে বাসায় ঢুকে পড়েন। পুরো সন্ধ্যাটা তাঁর কাটে টিভি দেখে। রাতের খাবার রেস্টুরেন্টে। বলা যায় গত পঁচিশ-তিরিশ বছর ধরে আলী আহমেদের জীবন জ্যাকসন হাইটস ও ম্যানহাটনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ!
রাত পৌনে দুটার দিকে খাওয়ার উদ্দেশ্যে আলী আহমেদ তাঁর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হলেন। বের হওয়ার পরপরই মনে হলো ছাতা নিয়ে বের হওয়া উচিত ছিল। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর থেকে বৃষ্টির শব্দ শোনা যায় না। তিনি ভবনের সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বৃষ্টি দেখলেন। সাধারণত নিউইয়র্কের বৃষ্টি অতি বিরক্তিকর। পিটপিট করে কিছুক্ষণ পড়ে বন্ধ হয়; আবার কিছুক্ষণ পর শুরু হয়। তবে আজকের বৃষ্টিটা অন্যরকম। অনেকটা বাংলাদেশের আষাঢ় মাসের বৃষ্টির মতো, যেটায় রয়েছে তাল, ছন্দ ও নস্টালজিয়া। এ বছর এপ্রিল মাসে অন্য বছরের তুলনায় একটু বেশিই বৃষ্টি হচ্ছে। অবশ্য এই বৃষ্টি ভালো। এখন বসন্ত চলছে। সারা নিউইয়র্কের লোকজন হে ফিভারে ভুগছেন। তিনি নিজেও ভুগছেন। সারাক্ষণ চোখ জ্বালাপোড়া, একনাগাড়ে হাঁচি। একবার হাঁচি উঠলে সহজে বন্ধ হতে চায় না। তাঁর নিজের এক নাগাড়ে সতেরোটি হাঁচি দেওয়ার রেকর্ড আছে। আচ্ছা গিনেস বুকে কি হাঁচি দেওয়ার ওপর কোনো রেকর্ড আছে?
বৃষ্টি কমে এসেছে, আলী আহমেদ শেষবারের মতো আজ হাটবাজার রেস্টুরেন্টের পথে রওনা হয়েছেন। পাঁচ বছর দরে তিনি এই রেস্টুরেন্টের নিয়মিত কাস্টমার। রাতের খাবার এখানেই সারেন। রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকতেই কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়ানো মেয়েটি তাঁর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘ভাইয়া কী খাবেন?’
আলী আহমেদ মেয়েটির দিকে তাকালেন। এই মেয়েটিকে তিনি এর আগে কখনো দেখেননি। হয়তোবা সে এখানে নতুন এসেছে। মেয়েটি তাঁকে ‘ভাইয়া’ বলে সম্বোধন করছে, এটাও অবাক হওয়ার বিষয়। তাঁর বয়স উনষাট। ‘ভাইয়া’ ডাকার স্টেজ অনেক আগেই পার করে এসেছেন। এখন তিনি আছেন আংকেল স্টেজে! মেয়েটির কি তাঁকে আংকেল ডাকাটাই সমীচীন হতো না? এই মেয়েটির বয়স কত? আঠারো কিংবা বিশ? সাদামাটা শান্ত চেহারার বাঙালি মেয়ে। চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে আমেরিকায় নতুন এসেছে। অনেক বছর এই দেশে কাটানোর কারণে তিনি এসব ব্যাপার সহজেই ধরতে পারেন। কে নতুন কিংবা কে পুরাতন? বিয়ে করলে তাঁর নিজেরও নিশ্চয়ই এই বয়সী একটা মেয়ে থাকত?
কাউন্টারের মেয়েটি আবারও আলী আহমেদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা উত্তেজনা মেশানো গলায় বলল, ‘কিছুক্ষণ আগে কিচেন থেকে হালিম এসেছে, খেয়ে দেখতে পারেন!’
আলী আহমেদ মেয়েটির কথার কোনো জবাব দিলেন না। তবে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন। মানুষের হাসির নানান ধরন আছে, ভিন্ন ভিন্ন অর্থ আছে! আলী আহমেদের এই হাসির অর্থ, ‘দাঁড়াও আগে দেখে নিই কী কী আছে; তারপর অর্ডার করব।’
তিনি কাউন্টারে রাখা খাবারের দিকে নজর দিলেন। নানা পদের সব তরকারি সাজানো। কচুর লতি থেকে শুরু করে একেবারে কাচ্চি বিরিয়ানি পর্যন্ত। রাজসিক, তামসিক, সাত্ত্বিক সবই আছে; যার যেটা ইচ্ছা বেছে নাও। কাউন্টারে পয়সা দিয়ে টেবিলে বসে পড়। মামলা ডিসমিস। বর্তমানে নিউইয়র্ক শহরে বসবাসরত ব্যাচেলর বাঙালি ছেলেপিলেরা চরম সৌভাগ্যবান। দূর দেশে বসেও দেশের স্বাদ পাচ্ছে। তাঁর বেলায় কিন্তু এমনটা ছিল না। মাসের পর মাস তিনি ভাত না খেয়ে কাটিয়েছেন। অবশ্য তার সংগত কারণ আছে। তিনি মোটেও রাঁধতে পারেন না। অতি সহজ ভাত-ডালও না! তবে ডিম ভাজতে পারেন। প্রথম আমেরিকা আসার পর পরিচিত কেউ দাওয়াত করলে খুব আগ্রহ নিয়ে দাওয়াতে যেতেন। ওই যুগে এই শহরে বাঙালির সংখ্যা ছিল অনেক কম! এখনকার মতো গন্ডায় গন্ডায় বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট ছিল না। বাঙালি পাড়া বলে খ্যাত এই জ্যাকসন হাইটসে ছিল হাতেগোনা ক’টি ইন্ডিয়ান দোকান। সময় পাল্টেছে, যুগ বদলেছে।
আলী আহমেদ আমেরিকায় আসেন গলাকাটা পাসপোর্টে সেই উনিশ শ উননব্বই সালে। তখন তিনি ছিলেন উনত্রিশ বছর বয়সী এক টগবগে যুবক। এখন দু হাজার উনিশ সাল। ত্রিশটি বছর মনে হচ্ছে হুট করে চলে গেল। তিনি খাবারের অর্ডার দিলেন। হার্ড চিকেন কারি, ডাল ও সবজি। সঙ্গে তিনটি আটার রুটি। তিনি ভেতো বাঙালি! ভাত খেতে ইচ্ছে করছিল। অনেক কষ্টে সেই ইচ্ছা দমন করলেন। ডায়বেটিসের কারণে অল্প কিছুদিন হলো আটার রুটি খেতে শুরু করেছেন। রুটি খেতে সত্যি বলতে কি জঘন্য লাগে। তারপরও খান। সেদিন ডাক্তারের কাছে গেলেন। বছরে চারবার যেতে হয়। রেগুলার চেকআপ। ডাক্তার বাংলাদেশি। অনেক দিনের পরিচয়। পরিচয়টা ট্যাক্সি গ্যারেজে। ডাক্তার সাহেব তখন নতুন আমেরিকায় এসেছেন। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে উইকেন্ডে ক্যাব চালান। একসময় তাঁদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক হয়ে গেল। যদিও ডাক্তার সাহেবের বয়স আলী আহমেদের চেয়ে বছর দশেক কম।
আলী আহমেদকে চেম্বারে ঢুকতে দেখে ডাক্তার ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব ধমকের সুরে বললেন, ‘আলী ভাই ব্যাপার কী বলেন তো? ডায়বেটিসের ওষুধ কি নিয়মিত খান? সুগারের এই অবস্থা কেন?’
ডাক্তারের মুখে একসাথে এতগুলো প্রশ্ন শুনে আলী আহমেদ বিব্রত ভঙ্গিতে মাথা চুলকাতে লাগলেন। মিনমিন করে বললেন, ‘খাই তো!’
-খেলে এই অবস্থা কেন?
-আসলে, সত্যি বলতে কি মাঝেমধ্যে ওষুধ খেতে ভুলে যাই!
-ভুলে যান মানে? ডাক্তার ওয়াহিদুজ্জামান বিস্মিত চোখে তাঁর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, একটা মাত্র ওষুধ আর সেটা খেতেও ভুলে যান?
আলী আহমেদ কিছু বললেন না। সবকিছু রুটিন মাফিক করলেও কোনো এক বিচিত্র কারণে ওষুধ খাওয়ার কথা তাঁর মনে থাকে না!
ডাক্তার বললেন, ‘শোনেন ডায়াবেটিস বেশি বেড়ে গেলে কিন্তু ইনসুলিন নিতে হবে। ইনসুলিন কী সেটা জানেন তো?’
-জানি
-নিজের শরীরে দিনে তিনবার ইনজেকশন পুশ করাটা খুব আরামদায়ক না। আমি চাইলে আপনার মেটফর্রমিন্যের ডোজ বাড়িয়ে দিতাম, দিচ্ছি না, খাবার কন্ট্রোলে আনেন। একমাস পর আবার আসবেন।
-জি আচ্ছা।
এরপর আর ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হয়নি। দু মাস কেটে গেছে। আর দেখা হবে বলেও মনে হচ্ছে না! আলী আহমেদের খাবার শেষ হয়েছে। তিনি এক কাপ চা নিয়ে বসে আছেন। গরম চা। ছোট ছোট চুমুকে তিনি চা খাচ্ছেন। তিনি ভাবলেন আরও কিছুক্ষণ এখানে বসা যাক। তাড়াহুড়ার তো কিছুই নেই। এই রেস্টুরেন্টে আর এভাবে বসে চা খাওয়া হবে না! বিচিত্র শোনালেও সত্য আলী আহমেদ আজ অন্য যেকোনো দিনের মতোই কাজ করেছেন। সাধারণত মানুষজন দেশে যাওয়ার আগের দিন কাজ করে না। কিন্তু তিনি করেছেন।
বিকেলবেলা কাজ শেষ করে যখন গ্যারেজে ট্যাক্সি জমা দিতে গেলেন, তখন বয়স্ক ডিসপ্যাচার তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আলী আর ইউ ওয়ার্কিং ইন দ্য উইকেন্ড?’
তিনি না সূচক মাথা নাড়লেন। একবার ইচ্ছে করল বলেন, ‘বিলি তোমার গ্যারেজে প্রায় পঁচিশ বছর গাড়ি চালিয়েছি। আগামীকাল আমি নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছি। আর কখনো তোমার এখানে আসা হবে না।’
কী মনে করে তিনি কিছুই বললেন না। ডিসপ্যাচারের হাতে গাড়ির চাবি দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। আচ্ছা, কাজটা কি ঠিক হলো? এত বছরের পরিচয়, তা ছাড়া লোকটা ভালো। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলে কী এমন হতো? লোকটা নিশ্চয়ই সোমবার ভোরবেলা তাঁর জন্য অপেক্ষা করবে? তিনি যে গাড়িটা প্রতিদিন চালান সে গাড়ি নিশ্চয়ই সে অন্য কোনো ড্রাইভারের হাতে দেবে না। বেচারার একটা শিফট নষ্ট হবে!
এই শহরে সুদীর্ঘ পঁচিশটি বছর তিনি ক্যাব চালিয়েছেন। শহরের নাড়ি-নক্ষত্র সব তাঁর চেনা। নিজের ঢাকা শহরটাও হয়তো এতটা ভালোভাবে চেনেন না। প্রথম যখন ক্যাব চালাতে শুরু করেন, তখন রাস্তাঘাট ভালোমতো চিনতেন না। ওই যুগে স্মার্টফোন, জিপিএস কিছুই ছিল না। একবার ভোর তিনটার দিকে অ্যালফাবেট সিটি থেকে এক লোক উঠেছে। বয়স্ক লোক। উঠেই বলল, ‘আমাকে নিউজার্সি নিয়ে যেতে পারবে?’
আলী আহমেদের ট্যাক্সি ব্যবসা সে রাতে ভালো যাচ্ছিল না। রাত দশটার মধ্যে তাঁকে তিনবার ব্রুকলিন যেতে হয়েছে। প্রতিবারই খালি গাড়ি নিয়ে ফিরেছেন। লোকটার কথায় তিনি রাজি হয়ে গেলেন। প্রায় দেড় শ ডলারের ভাড়া। এসব ভাড়া সচরাচর মেলে না। লোকটা তাঁকে ঠিকই রাস্তা দেখিয়ে নিউজার্সিতে নিয়ে গেল। ভাড়া মিটিয়ে লোকটা তাঁর বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। ফেরার পথে তিনি রাস্তা হারিয়ে ফেললেন। কোনোভাবেই হাইওয়েতে ওঠার রাস্তা খুঁজে পেলেন না, ওদিকে গাড়ির তেলও প্রায় শেষের দিকে। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তাঁকে রক্ষা করল এক পুলিশ অফিসার। হাইওয়েতে ওঠার রাস্তা দেখিয়ে দিল। আরেকবার পড়লেন ছিনতাইকারীর কবলে। ফিফটি ফার্স্ট স্ট্রিট নর্দার্ন বুলেভার্ডে গাড়িতে তেল ভরছেন। রাত তখন প্রায় তিনটা। হঠাৎ করে ঘাড়ের ঠিক পেছনটায় ধাতব শীতল কিছুর স্পর্শ অনুভব করলেন। মাথা ঘুরিয়ে তাকাতে যাবেন, ঠিক তখনই কেউ শান্ত ও স্পষ্ট গলায় বলল, ‘ডোন্ট মুভ, গিভ মি ইওর মানি।’ তাঁর পকেটে আড়াই শ ডলার ছিল, কোনো বাক্যব্যয় না করে চুপচাপ টাকাটা ছিনতাইকারীর হাতে তুলে দিলেন। সে রাতে তাঁর প্রচণ্ড মন খারাপ হয়েছিল। বারো ঘণ্টা কাজ করার পর পুরো টাকাটাই ছিনতাইকারীর পকেটে গেল! কত বিচিত্র সব ঘটনার সাক্ষী তিনি।
তার গাড়িতে একবার এক মহিলার বাচ্চা হয়ে গেল। বাচ্চা হওয়ার আগে মহিলাটি তাঁকে বলছিল, ‘স্যার গাড়িটা কাছে কোথাও থামাও। আমার খুব সম্ভব ডেলিভারি হয়ে যাচ্ছে।’ মহিলার মুখে এই কথা শুনে আলী আহমেদ হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। গাড়ি রাস্তার একপাশে পার্ক করে তিনি ৯১১-এ কল করলেন। মুহূর্তের মধ্যে সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার ডিপার্টমেন্টের গাড়ি, পুলিশ সবাই হাজির। তাঁর গাড়ির পেছনের সিটেই মহিলার ডেলিভারি হলো। ফুটফুটে এক নবজাতকের জন্ম হলো তাঁর ট্যাক্সিতে। খবরটা নিউইয়র্কের নানা পত্রিকায় এসেছিল এবং সেখানে তাঁর নামের উল্লেখ ছিল। গ্রিনকার্ড পাওয়ার আশায় তিনি যে ডমিনিকান মেয়েটির সাথে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করেছিলেন, সেই মেয়েটার সঙ্গে পরিচয়ও ট্যাক্সিতে। মেয়েটি একসময় তাঁর টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। গত তিরিশ বছরে গ্রিনকার্ড পাওয়ার জন্য তিনি কম চেষ্টা করেননি। কত হাজার ডলার যে উকিলের পেছনে খরচ করেছেন, সে হিসাব দেখলে যে কেউ আঁতকে উঠবে। প্রতিবারই বিফল হয়েছেন। আসলে কিছু না হওয়ার হলে, যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, তা কখনো হবে না। ভাগ্য সবার দুয়ারে আসার জন্যই অপেক্ষা করে। কিন্তু উপযাচক হয়ে আসে না, ডেকে আনতে হয়। আলী আহমেদ ডেকে আনার চেষ্টা করেছেন; ভালোভাবেই করেছেন কিন্তু আসেনি! বাংলাদেশে তাঁর না ফিরে গেলেও চলত। তাঁর গ্রিনকার্ড না থাকলেও ওয়ার্ক পারমিট আছে। ক্যাব চালিয়ে যা কামাই করেন, তা দিয়ে খেয়ে-পরে নিজের বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই চলে যায়। দেশে ফিরে যাওয়ার একমাত্র কারণ তাঁর মা; তিরানব্বই বছর বয়সী আমেনা বেগম। তিনি তাঁর ছোট ছেলের সঙ্গে থাকেন। ইদানীং নানা রকমের রোগে ভুগছেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা মৃত্যুর আগে ছেলেকে দেখতে চান। আলী আহমেদ তাঁর প্রথম সন্তান।
চা শেষ করে আলী আহমেদ রেস্টুরেন্ট থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। বৃষ্টি থেমে গেছে। আবহাওয়া শীতল, তিনি পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালেন। তাঁর ইচ্ছে করল কিছুক্ষণ হাঁটেন। স্মৃতিবিজড়িত এই জ্যাকসন হাইটসের রাস্তায় তাঁর শেষ পদচিহ্ন রেখে যান। তাঁর উনষাট বছর বয়সের অর্ধেকের চেয়ে বেশি সময় তিনি এই এলাকায় কাটিয়েছেন। অত্র এলাকার প্রায় প্রতিটি দোকান, দোকানের মালিক, কর্মচারী সবাই তাঁর পরিচিত। আচ্ছা, প্রতিটা দোকানে একবার করে ঢুঁ মারলে কেমন হয়? পরিচিত লোকজনের কাছে থেকে বিদায় নেওয়া!
আলী আহমেদ সেরকম কিছুই করলেন না। দোকানের মালিকেরা এ সময় দোকানে থাকে না, আর কর্মচারী যারা, তারা কাজে ব্যস্ত। কী দরকার তাদের বিরক্ত করে? বাসায় ফিরে আলী আহমেদ বাংলাদেশে তাঁর ভাইয়ের কাছে ফোন করলেন। ছোট ভাইকে ফ্লাইট নম্বর ইত্যাদি তথ্য জানালেন। রাতে বিছানায় শোবার পর তাঁর মনে হলো কেন তিনি কাউকে না জানিয়ে চলে যাচ্ছেন। এমন তো না যে, তিনি লোকজনের কাছ থেকে ধারকর্জ করে পালিয়ে যাচ্ছেন! আচ্ছা, যে লোকটার কাছে থেকে প্রতিদিন পত্রিকা কিনতেন, যে কফিওলার কাছ থেকে কফি কিনতেন, সে লোকগুলো নিশ্চয়ই তাঁর কথা ভাববে। হয়তো মনে মনে বলবে ‘লোকটা হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে গেল!’
গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল পার্কওয়ে ধরে একটা ট্যাক্সি ছুটে চলছে। বাপ্পি ট্যাক্সি চালাচ্ছে; আলী হোসেন ডানদিকের প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছেন। গাড়ির রেডিওতে ‘টেন টেন উইন্স’ চলছে। বাপ্পি আলী আহমেদকে জিজ্ঞেস করল, ‘আংকেল পাসপোর্ট, টিকিট সব সাথে নিয়েছেন তো?’ আলী আহমেদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন।
বাপ্পি বলল, ‘ঢাকায় নামার পর আপনাকে রিসিভ করতে কে আসবে?’
আলী আহমেদ বললেন, ‘ছোট ভাই, আপাতত ওর বাসাতেই উঠব। আমার মাও ওর সাথে থাকেন। পরে নিজের ফ্ল্যাটে উঠে পড়ব।’
বাপ্পি কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ঢাকায় আপনার ফ্ল্যাট আছে? আগে কখনো বলেন নাই!’
আলী আহমেদ মৃদু হেসে বললেন, ‘এটা বলার মতো কিছু হলো? জিগাতলায় আমার বাবার দুইতলা একটা বাড়ি ছিল। ডেভেলপাররা ওই বাড়ি ভেঙে দশতলা বিল্ডিং কমপ্লেক্স করেছে। আমরা দুই ভাই চারটা করে ফ্ল্যাট পেয়েছি। আমার ফ্ল্যাটটা খালি বাকি তিনটা ভাড়া।’
-আংকেল, আপনার খারাপ লাগছে না? এত বছর আমেরিকায় থাকলেন!
আলী আহমেদ কিছু বললেন না। তিনি বাইরে তাকিয়ে আছেন। আমেরিকায় যাপিত জীবনের কথা মনে পড়ছে। এই গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল পার্কওয়েতে একবার তাঁর ট্যাক্সিতে আগুন লেগেছিল। তিনি আর তাঁর প্যাসেঞ্জার বিস্মিত চোখে জ্বলন্ত ট্যাক্সির দিকে তাকিয়েছিলেন।
ইত্তিহাদ এয়ারওয়েজের বিশাল এয়ারবাস বিমানটি তীব্র গতিতে আবুধাবি অভিমুখে ছুটে চলছে। প্লেনের উচ্চতা ক্রমেই বাড়ছে। অতি পরিচিত নিউইয়র্ক শহরটি ক্রমেই মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। প্লেনের জানালা দিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে আছেন আলী আহমেদ নামের একজন!