নিউইয়র্কে পালিত হলো সুচিত্রা সেনের জন্মবার্ষিকী
বর্ণাঢ্য আয়োজনে আর ভালোবাসায় নিউইয়র্কে পালিত হলো বাংলা সিনেমার মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের ৮৭ তম জন্মবার্ষিকী। যুক্তরাষ্ট্রের সুচিত্রা সেন মেমোরিয়াল গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় জ্যাকসন হাইটসের বাংলাদেশ প্লাজায় দিনব্যাপী এ উৎসবের আয়োজন করে।
সংস্কৃতিসেবী গোপাল স্যানালের তত্ত্বাবধানে ও পরিচালনায় প্রতি বছরই কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেনের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী যুক্তরাষ্ট্রে পালন করা হয়ে থাকে।
প্রবাসী সংস্কৃতিসেবী মিনহাজ শাম্মু ও আবৃত্তিকার মুমু আনসারীর সঞ্চালনায় দিনব্যাপী জন্ম উৎসবের শুরুতে মঙ্গল প্রদীপ জ্বেলে মহানায়িকাকে স্মরণ করা হয়। প্রদীপ প্রজ্বলন করেন টিভি অভিনেত্রী রেখা আহমেদ, লুৎফুন নাহার লতা ও শিরীন বকুল। সুচিত্রা সেনের জন্মবার্ষিকীতে আলোচনা অনুষ্ঠান, সুচিত্রা সেনের স্মৃতিচারণ ও সুচিত্রা সেন অভিনীত চলচ্চিত্র প্রদর্শনেরও আয়োজন করা হয়।
সুচিত্রা সেন মেমোরিয়ালের প্রধান গোপাল স্যানাল পাবনায় সুচিত্রা সেনের বাড়িটি ‘সুচিত্রা সেন জাদুঘর’ ও পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজের একটি ছাত্রী নিবাস সুচিত্রা সেনের নামে নামকরণ করায় বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নিউইয়র্ক প্রবাসী সুচিত্রা ভক্তদের কথা বিবেচনা করেই সুচিত্রা সেন মেমোরিয়াল ইউএসএ গঠন করা হয়েছে। প্রবাসে গড়ে ওঠা বাংলা ভাষাভাষী নতুন প্রজন্মের কাছে প্রয়াত সুচিত্রা সেনের স্মৃতি ও কর্মকাণ্ড তুলে ধরার জন্য সংগঠনটি চেষ্টা চালাবে বলে আশা করছেন তিনি।
নিউইয়র্ক প্রবাসী বিশিষ্ট টিভি অভিনেত্রী লুৎফুন নাহার লতা বলেন, বাঙালির প্রাণকে নাড়া দিয়েছিলেন যে অভিনেত্রী তার নাম সুচিত্রা সেন। তার অভিনয়, কণ্ঠ, বাচন ভঙ্গি আর অসামান্য ব্যক্তিত্ব সবকিছু নিয়েই সুচিত্রা সেন। বাংলা সিনেমার জগতে এমন সুদক্ষ ও ভুবন মোহনী অভিনেত্রী আর আসেনি।
সুচিত্রা সেনের জন্ম ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল, বাংলাদেশের পাবনায়। শৈশব সেখানেই কেটেছে। বাবা করুণাময় দাশ গুপ্ত ছিলেন স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। বাবা-মায়ের পঞ্চম সন্তান ছিলেন সুচিত্রা। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে মারা যান এই অভিনয় শিল্পী।
১৯৪৭ সালে কলকাতার বিশিষ্ট বাঙালি শিল্পপতি আদিনাথ সেনের ছেলে দীবানাথ সেনের সঙ্গে বিয়ে হয় সুচিত্রার। তাঁদের ঘরে একমাত্র সন্তান মুনমুন সেন। ১৯৫২ সালে তিনি চলচ্চিত্র জগতে প্রথম পা রাখেন। প্রথম ছবি শেষ কোথায়। তবে ছবিটি আর মুক্তি পায়নি। এরপর ১৯৫৩ সালে মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে সাড়ে চুয়াত্তর ছবি করে সাড়া ফেলে দেন চলচ্চিত্র অঙ্গনে। সুচিত্রা সেন বাংলা ও হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত প্রথম হিন্দি ছবি দেবদাস (১৯৫৫)। সুচিত্রা সেন ১৯৭৮ সালে প্রণয় পাশা ছবি করার পর লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। এরপর থেকে তিনি আর জনসমক্ষে আসেননি। মাঝে একবার ভোটার পরিচয়পত্রে নাম অন্তর্ভুক্ত করতে ছবি তুলতে ভোটকেন্দ্রে যান। সুচিত্রা সেন ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভক্ত। বলিউড-টালিউডের বহু পরিচালক সুচিত্রা সেনকে নিয়ে ছবি করতে চাইলেও তিনি এতে সম্মত হননি। এমনকি দেশ-বিদেশের কোনো পরিচালক বা অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত দেননি তিনি। সেই থেকে তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যান। যদিও তাঁর বাসভবনে তিনি কেবল কথা বলেছেন তাঁর একমাত্র মেয়ে মুনমুন সেন এবং দুই নাতনি রিয়া ও রাইমার সঙ্গে।
পুরস্কার ও সম্মাননা
সুচিত্রা সেন ১৯৬৩ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সাত পাকে বাঁধা ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান।
১৯৭২ সালে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পদ্মশ্রী পান। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাংলাবিভূষণ সম্মাননা দেওয়া হয় তাঁকে। ২০০৫ সালে সুচিত্রা সেনকে ভারতের চলচ্চিত্র অঙ্গনের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব করা হলে সুচিত্রা সেন দিল্লিতে গিয়ে ওই সম্মান গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
সুচিত্রা সেনের ছবি
সুচিত্রা সেনের প্রথম ছবি শেষ কোথায়। ১৯৫২ সালে ছবিটি নির্মিত হলেও তা আর মুক্তি পায়নি। ১৯৫৩ সালে অভিনয় করেন সাত নম্বর কয়েদি ছবিতে। ১৯৫২ থেকে ১৯৭৮ এই ২৬ বছরে তিনি ৬২টি ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৫৩ সালে মহানায়ক উত্তম কুমারের সঙ্গে তিনি প্রথম ছবি করেন সাড়ে চুয়াত্তর। এ ছবিটি বক্স অফিস হিট করে। সুচিত্রা সেনের অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে : অগ্নি পরীক্ষা (১৯৫৪), গৃহ প্রবেশ (১৯৫৪), ঢুলি (১৯৫৪), মরণের পরে (১৯৫৪), দেবদাস (১৯৫৫-হিন্দি), শাপমোচন (১৯৫৫), সবার উপরে (১৯৫৫), মেঝ বউ (১৯৫৫), ভালবাসা (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), ত্রিযামা (১৯৫৬), শিল্পী (১৯৫৬), একটি রাত (১৯৫৬), হারানো সুর (১৯৫৭), পথে হল দেরী (১৯৫৭),জীবন তৃষ্ণা (১৯৫৭), চন্দ্রনাথ (১৯৫৭), মুশাফির (১৯৫৭-হিন্দি), রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), ইন্দ্রানী (১৯৫৮), দ্বীপ জ্বেলে যাই (১৯৫৮), চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯), হসপিটাল (১৯৬০), বোম্বাই কা বাবু (১৯৬০-হিন্দি), সপ্তপদী (১৯৬১), সাত পাকে বাঁধা (১৯৬৩), উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩), মমতা (১৯৬৬), গৃহদাহ (১৯৬৭), কমললতা (১৯৬৯), মেঘ কালো (১৯৭০), ফরিয়াদ (১৯৭১), আলো আমার আলো (১৯৭২), হার মানা হার (১৯৭২), দেবী চৌধুরাণী (১৯৭৪), শ্রাবণ সন্ধ্যা (১৯৭৪), প্রিয় বান্ধবী (১৯৭৫), আঁধি (১৯৭৫-হিন্দি), দত্তা (১৯৭৬) এবং সর্বশেষ প্রণয়পাশা (১৯৭৮)।