যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির জাতীয় কমিটি ঘোষণা করেছে যে এ বছরের সম্মেলনে দল কোনো নতুন ঘোষণাপত্র গ্রহণ করবে না। প্রতি চার বছরে অনুষ্ঠিত দলের সম্মেলনে নতুন ঘোষণাপত্র বা পার্টি প্ল্যাটফর্ম গ্রহণ করাই রেওয়াজ। যুক্তরাষ্ট্র সময় সোমবার রাতে (বাংলাদেশ সময় আজ মঙ্গলবার সকালে) রিপাবলিকান পার্টির চার দিনব্যাপী সম্মেলন শুরু হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত রাজনৈতিক আচার অনুযায়ী, এই পার্টি প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে দলের আদর্শ ও ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের দলিল এবং আসন্ন নির্বাচনে দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ ধরনের দলিলকে নির্বাচনী ইশতেহার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে দলের এই প্ল্যাটফর্মকে নির্বাচনী ইশতেহারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করার কারণ দুটি। প্রথমত, এই প্ল্যাটফর্মের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে দলের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মতের প্রতিনিধিত্বকারীদের মধ্যে কারা বেশি প্রভাবশালী ও দলের আদর্শিক অবস্থান কোন দিকে ঝুঁকছে। দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্ট ছাড়া প্রতিনিধি সভা এবং সিনেটে যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তাঁদের এসব বিষয়ে অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হয় এবং পরে এর আলোকেই বিভিন্ন বিষয়ে কংগ্রেসে অবস্থান গ্রহণ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো প্রধান দল সম্মেলনে নতুন ঘোষণাপত্র গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিল। রোববার দলের সম্মেলনের ঠিক আগের দিন দলের জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হলো। বলা হয়েছে, শনিবার দলের জাতীয় কমিটি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দলের ঘোষণাপত্র গ্রহণের বদলে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে দল ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমেরিকা-ফার্স্ট অ্যাজেন্ডার প্রতি তাদের সোৎসাহ সমর্থন অব্যাহত রাখবে’। মার্কিন রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের প্রতি তাঁর দলের সমর্থন জানানো কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। কিন্তু দলের ঘোষণাপত্র না গ্রহণ করা এবং একজন ব্যক্তির রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন করার কোনো উদাহরণও নেই।
রিপাবলিকান পার্টি যদিও বলেছে যে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দলের সম্মেলন ছোট আকারে করাই এর কারণ। কিন্তু সেটা কারণ বলে মনে করার অবকাশ কম। দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সম্মেলনে সব ডেলিগেট উপস্থিত থাকবে না এবং স্বল্পসংখ্যক ডেলিগেটের মতামতের ভিত্তিতে তাঁরা নতুন ঘোষণাপত্র তৈরি করতে চান না, কেননা তাতে বহু ধরনের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে না। কিন্তু সাধারণত এই প্ল্যাটফর্মে কী থাকবে, সে বিষয়ে আলাদা কমিটি থাকে এবং কমিটির বৈঠক ও আলোচনার বিষয়ে আগেই জানা যায়। এই বছরে রিপাবলিকান পার্টির এই কমিটির কোনো বৈঠকের কথা শোনা যায়নি। যে কারণে ইতিপূর্বেই এ বিষয়ে গণমাধ্যমে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল।
গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেটিক পার্টির সম্মেলনে ৯১ পৃষ্ঠার দলীয় প্ল্যাটফর্ম গৃহীত হয়েছে। এই প্ল্যাটফর্ম নিয়ে দলের ভেতরে কয়েক মাস ধরেই আলোচনা হয়েছে। দলের ১৫ সদস্যের প্ল্যাটফর্ম ড্রাফটিং কমিটি আলাপ–আলোচনা করে এ ঘোষণাপত্র তৈরি করে। দলের তুলনামূলক উদার বামপন্থীদের অনেকে এই প্ল্যাটফর্মের কিছু কিছু অংশের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে এর বিরুদ্ধেও ভোট দিয়েছেন। আবার অন্য দিকে এ কমিটির একজন সদস্য বার্নি স্যান্ডার্সের উপদেষ্টা জস ওরটন এই প্ল্যাটফর্মকে এযাবৎকালের সবচেয়ে প্রগতিশীল ভিশন বা দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন দলিল বলে বর্ণনা করেছেন। গর্ভপাত বিষয়ে দলের উদারপন্থী অবস্থান নিয়ে আপত্তি তুলে দলের কমপক্ষে ১০০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ওই কমিটির কাছে আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে কয়েকজন গভর্নর এবং কয়েকটি রাজ্যের আইনসভার সদস্যও ছিলেন। কমিটি তাঁদের সেই আবেদনে সাড়া দেয়নি।
২০১৬ সালের সম্মেলনে রিপাবলিকান পার্টি ৫৪ পৃষ্ঠার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করেছিল। সেই দলিলে যেসব রক্ষণশীল নীতিমালার কথা বলা হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত তিন বছরে অনেক বিষয়ে এর চেয়েও বেশি রক্ষণশীল ও দক্ষিণপন্থী অবস্থান নিয়েছেন। তবে রিপাবলিকান দলের পক্ষ থেকে এই নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করেননি।
প্রতিটি দলের ঘোষণাপত্রকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা একটি এস্পিরেশনাল ডকুমেন্ট বা আশা-আকাঙ্ক্ষার দলিল বলে বর্ণনা করেন। এতে দলের অবস্থানই কেবলই তুলে ধরা হয় না, দেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তারও একটি দিকনির্দেশনা থাকে। এর অনুপস্থিতি দেশের জন্য রিপাবলিকান দলের দিকনির্দেশনার অভাব বলেই মনে করা যায়।
রিপাবলিকান পার্টির জাতীয় কমিটির এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশকে বিস্মিত করেছে। অন্যরা একে দেশের রাজনীতিতে পারসোনালিটি কাল্ট বা ব্যক্তিপূজার এক বিপজ্জনক অধ্যায়ের সূচনা বলে মনে করছেন। গত কয়েক বছরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ব্যক্তিকেন্দ্রিক যে রাজনীতির দিকে দেশকে নিয়ে গেছেন, দলের এই সিদ্ধান্ত তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিল। গণতন্ত্রের অব্যাহত উল্টো যাত্রা–বিষয়ক গবেষণায় দেখা গেছে, জনতুষ্টিবাদী নেতাদের এ ধরনের আচরণের সঙ্গে যখন তাঁর দল যুক্ত হয় তখন তা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। রিপাবলিকান দলের চার দিনের সম্মেলনের অন্তত অর্ধেক বক্তা যে ট্রাম্প পরিবারের সদস্য এবং আগের সব ধরনের প্রথা ভঙ্গ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে চার দিনই বক্তব্য দেবেন, তা ব্যক্তিকেন্দ্রিক কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিরই লক্ষণ।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো।