দৈনন্দিন জীবনে রুটিনের গুরুত্ব

পড়ার সময় পড়া, খেলার সময় খেলা, ঘুমের সময় ঘুম, খাবারের সময় খাবার, নাচের সময় নাচ, গানের সময় গান ইত্যাদি নানা বাঁধা-ধরা রুটিন ছোটদের জন্য প্রযোজ্য হলেও বড়দের তেমন দৈনন্দিন রুটিন মেনে চলতে দেখা যায় না। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থেই মানুষের দৈনন্দিন জীবনের রুটিনসহ পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার সম্পূর্ণ সমাধান থাকলেও কতজন তা মেনে চলেন? আর তা না মানার কারণেই মানুষ আজ ফেসবুকসহ বিভিন্ন জিনিসের আসক্তিতে ভুগছেন। বাড়ছে স্ট্রেস, উদ্বিগ্নতা আর হতাশাপূর্ণ বিভীষিকাময় অনেক নতুন জীবন।

অন্যদিকে, অনেকেই মনে করেন রুটিনমাফিক চললে দৈনন্দিন জীবনে নিজের কোনো স্বাধীনতা থাকে না। যখন যা ইচ্ছা খুশি, তা করা যায় না। তাই, চলুন দেখি প্রতিদিন নিজের রুটিন মতো চললে কতটুকু স্বাধীনতা পাওয়া যায়, আর তা কীভাবে আমাদের জীবনকে সফলতার উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে সাহায্য করে।

১. আপনার দৈনন্দিন রুটিন আপনি বানাবেন, অন্য কেউ নয়। কাজেই আপনার স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্বও আপনার। আপনি যতটুকু সময় ফেসবুক/ভিডিও গেম/আপনার পছন্দের কোন জিনিসে দিলে আপনার ভালো লাগবে বা মানসিক শান্তি পাবেন, তা আপনার দৈনন্দিন জীবনের রুটিনে লিখে রাখুন। কারও চাকরি/ব্যবসা যদি ফেসবুক/ভিডিও গেম বা এসব কিছুর ওপর নির্ভরশীল হয়, তবু আপনার রুটিনে আপনি কত ঘণ্টা সময় দেবেন, সে বিষয়ে লিখে রাখুন। শুধু মনে রাখতে হবে এই সময়ের বাইরে যাতে আপনি এই কাজগুলো না করেন। এরপরও যদি করেন? গবেষণায় দেখা যায় তাতে খারাপ ফলই বেশি হয়। বাড়ে মানসিক তিক্ততা, কাজের চাপ, উচ্চ-রক্তচাপসহ অন্যান্য কাজকর্মে অসুবিধা এবং হতাশা।

২. কানাডীয় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট অধ্যাপক জরডান বি. পিটারসন বলেন, দৈনন্দিন রুটিন মেনে না চলায় অনেকেই যে মানসিক অশান্তিতে ভোগেন তা কিন্তু নয়। তারা ক্লিনিক্যালি অসুস্থও হয়ে পড়েন। তিনি তার গবেষণাকেন্দ্রসহ হাসপাতালে অনেক রোগীকে কোনো ওষুধ ছাড়াই শুধুমাত্র দৈনন্দিন রুটিন মেনে চলে খাবার সময় খাবার খেতে ও ভিডিও গেম খেলার সময় ভিডিও গেম খেলতে পরামর্শ দিয়ে অনেক রোগীকে সুস্থ করে তোলেন!

৩. দৈনন্দিন রুটিন মেনে চললে আপনাকে সবকিছুতে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে না, কারণ আপনি জানেন, আপনি কখন কী করবেন। তারপরও কোনো কিছু খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আসলে রুটিন একটু এদিক-সেদিক করার সুযোগ তো আছেই। এতে আপনি তুলনামূলক কম সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবেন যা আপনাকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেবে। কারণ, এসব খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। প্রতি সপ্তাহে সাধারণত ২-৩টির বেশি থাকবে না।

৪. নিজের রুটিন মেনে চললে অনেক কিছু করার পরও আপনার হাতে অনেক সময় থাকবে, যা আপনি অন্য কোনো কাজে বা আপনার ভালোলাগার কোনো কিছুতে ব্যয় করতে পারবেন। সময়ই যদি সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হয় (Time is money), তাহলে আপনি সময় বাঁচানোর মাধ্যমে অনেক কিছু অর্জন করতে পারবেন। আমি ব্যক্তিগত জীবনে এটি প্রয়োগ করে দেখেছি। যেখানে অফিসের কাজের বাইরে আমি আর কিছুই করতে পারতাম না, শুধু দৈনন্দিন রুটিন মেনে চলে এখন আমি বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মসহ লেখালেখিরও অনেক সময় পাই।

৫. রুটিনমাফিক কাজ করলে যে শুধু কাজের প্রতি আগ্রহ ও ভালোবাসা বাড়ে তা কিন্তু নয়, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করায় অনেক আত্মতৃপ্তিও পাওয়া যায়, যা আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করবে।

৬. সাধারণত সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোই দৈনন্দিন রুটিনে স্থান পায়। কাজেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ ভুলে যাওয়া বা কোনো কাজকে ছোট/নগণ্য করে দেখার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। এত দৈনন্দিন জীবনে কাজের অর্জন বাড়বে এবং আপনি সাফল্যের মুখ দেখতে পাবেন খুবই সহজে।

৭. মানুষ মাত্রই কম-বেশি গড়িমসির একটা অভ্যাস থাকে। তাই, অনেকেই রুটিনমাফিক চলতে পারেন না। সেক্ষেত্রে আপনার গড়িমসিকে আপনার দৈনন্দিন জীবনের রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করুন। উদাহরণস্বরূপ, আমি যখন এই লেখা লিখছি, তার আগে ৪০ মিনিট ছিল আমার গড়িমসির সময়! তবে এ সময় মেনে চলে রুটিন মোতাবেক আপনি আবার আপনার কাজে লেগে যান। ফলে সব কাজে আপনার গড়িমসি আসবে না, কারণ আপনি জানেন আপনার গড়িমসি করারও একটা সময় আছে!

৮. ২০১৬ সালের ২৭ জুলাই প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘নিয়ম মেনে দিন পার’ নামক প্রতিবেদনে করপোরেট কোচের প্রধান পরামর্শক যিশু তরফদার জানান, ‘যাঁরা গুছিয়ে কাজ করেন, তাঁদের সাফল্য অগোছালো মানুষের চেয়ে ৬০ শতাংশের বেশি। অথচ এই সাফল্যের কথা ভেবেই তো অনেকে রুটিনের বাইরে আরও বেশি কাজ করে। অতিরিক্ত কাজ নয়, বরং প্রতিদিনের গোছানো কাজ আপনাকে আরও বেশি এগিয়ে রাখতে পারে।’

৯. দৈনন্দিন জীবনে রুটিন মেনে চললে যে শুধু কাজের চাপ কমে তা নয়, এটা মানুষের দুশ্চিন্তা কমায়, জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে এবং সাফল্যের পথ দেখায়। কারণ রুটিন মেনে চললে মানুষ সময়মতো খেতে পারে, ব্যায়াম করতে পারে ও সময়মতো ঘুমাতে পারে। ফলে তারা সময়মতো ঘুম থেকে উঠতে পারে। এতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যসহ শারীরিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। কাজেই এসব মানুষ সময়মতো অফিসে যেতে পারে এবং সর্বোপরি সময়ের কাজ সময়ে করতে পারে। আর এটি না পারার কারণে প্রতিদিন এ পৃথিবীতে হাজার হাজার মানুষকে চাকরি থেকে বহিষ্কৃত হতে হয়!

১০. আপনার জীবনে যা করতে সবচেয়ে ভালো লাগে (কেউ বলতে পারেন কিছু না করে ফেসবুকিং করা বা আড্ডা দেওয়া!) সেটাকে আপনি পুরস্কার হিসেবে মনে করে আপনার দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম রুটিন মোতাবেক শেষ করে আপনার ভালোলাগার কাজ শুরু করুন। নিজেই নিজেকে ভালোলাগার কাজে পুরস্কৃত করুন। রুটিন মেনে চলেও নিজ পছন্দের স্বাধীন জীবন উপভোগ করুন। আর এটির জন্য রুটিন মেনে না চললে একদিন আপনার সবচেয়ে ভালোলাগার কাজটিও বিরক্তিপূর্ণ ও হতাশায় পরিণত হবে। রুটিন মেনে নিজেকে সেটা থেকে মুক্তি দিন।