দাদার শেষকৃত্যে বাচ্চুর গান
রোশন, কেন ইউ কাম টু মাই রুম?
ইয়েস! বাট হোয়াই!
প্লিজ, কাম। আই নিড ইউর হাগ।
মনে মনে বলি, সারছে। এই সময়ে এই বেটা বলে কি!
হাগ? আর ইউ শিউর?
ইয়েস বলেই কেমন করে যেন নিশ্বাস ফেলতে লাগলেন।
আই অ্যাম কামিং, বাট উই শুড মেনটেইন সোশ্যাল ডিসটেনস।
আমি ফোন রাখলাম। তবে সঙ্গেই সঙ্গেই গেলাম না। মাথার মধ্যে উল্টাপাল্টা চিন্তা ঘুরতে থাকল।
এখন সকাল সাড়ে ছয়টা। কোডি আর আমার শিফট ছয়টা থেকে। আমি আর কোডি এসেই কাজ শুরু করেছি। কারও সঙ্গে কারও দেখা হয়নি। দুজন দুই রুমে। আরও দুজন আসবে। করোনার কারণে সোশ্যাল ডিসটেনসিং মানতে আমাদের কাজের সময় ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
ফোনটা রেখেই ভাবছিলাম। করোনা সময়ে আমার বরকেও কখন জড়িয়ে ধরেছি মনে নেই! মেয়েদের থেকেও দুরে আছি। তাহলে! এই সময়েও কেন এমন জড়িয়ে ধরতে ফোন করল। তাও এত সকালে! যেখানে আমি আর সে ছাড়া এই মুহূর্ত অফিসে আর কেউ নেই। মাথায় কেমন যেন সন্দেহ হল। আমি যাব যাব করেও যেতে সময় নিলাম।
কোডি কামাচো। জন্ম সূত্রে আমেরিকান। ইতালীয় দাদা। এক সময়ে ভালো গিটার বাজাতেন। কোডির বাবা–মা ডিভোর্স হওয়ায় আলাদা থাকেন। সে থাকে দাদার সঙ্গে। আমরা এক সঙ্গে ছয় বছর ধরে এখানে কাজ করি। এক সঙ্গে একই অফিসে কাজ করি। কাজের অনেক ভুল–ভ্রান্তি এক সঙ্গে সমাধান করি। পাশাপাশি বসে খাই। সে ইতালির গল্প করে। আমি বাংলাদেশের গল্প শোনাই।
অফিসের বার্ষিক পিকনিকে সবাই পরিবার নিয়ে যায়। প্রতি বছর কোডি তার ৭৩ বছর বয়সী দাদাকে নিয়ে পিকনিকে আসে। দেখতে হলিউডের বয়স্ক কোন নায়কের মতো। সবাইকে খুব মাতিয়ে রাখেন রোনাল্ড কামাচো। ভালো গিটার বাজান। আমরা অনেকেই দাদার ভক্ত হয়ে যাই। গিটার প্রসঙ্গে কথা উঠতেই একবার আমি রোনাল্ডকে আইয়ুব বাচ্চুর ‘সেই তুমি’ গানটি ইউটিউব থেকে শুনিয়েছি। সেই গান তাঁকে ইংরেজি করে দিয়েছি। আইয়ুব বাচ্চুর বেশ কিছু স্টেজ পারফরমেন্স দেখিয়েছি। আইয়ুব বাচ্চুর গিটার বাজানো দেখে রোনাল্ড মুগ্ধ হন।
শুনে বলেছেন, ও মাই গড! হি ইজ অ্যা জিনিয়াস।
তখন আমি মন খারাপ করে বলেছি, উই লস্ট আওয়ার জিনিয়াস। হি পাস্ড অ্যাওয়ে। তারপর আইয়ুব বাচ্চুর কিছু গান তিনি শুনবেন বলে আমার কাছ থেকে গানের লিংক নিলেন।
এরপর থেকে রোনাল্ড আমাকে বেশ কয়েকবার তার বন্ধুদের সঙ্গে গিটার শুনতে ডেকেছেন। আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
হঠাৎ করেই পাশের রুম থেকে কোডির চিৎকার কানে এল। হাউ মাউ করে কান্না করছে। সঙ্গে হাত–পা ছুড়ছে। চেয়ারে লাথি, টেবিলে থাপড়াচ্ছে। আমি দৌড়ে ছুটে যেতেই সেও দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। দেখলাম, তার ল্যাপটপের ভিডিওতে ডাক্তার নার্সসহ সবাই ছুটোছুটি করছে। মাঝখানে কোডির দাদাকে ভেন্টিলেটরসহ দেখা যাচ্ছে। এক নার্স মোবাইলে ভিডিও কলের মাধ্যমে কোডিকে দাদার শেষ অবস্থা দেখানোর চেষ্টা করছে।
সেই নার্স বলছে, ডার্লিং ইটস অ্যা ডাইং প্রসেস...
আমরা তোমার দাদার কোন হৃৎস্পন্দন পাচ্ছি না। আমরা একটু পরই ভেনটিলেশন খুলে নিচ্ছি। তাই তোমাকে দেখাতে কল দিয়েছি।
আফসোস হল, কেন আরেকটু আগে আসলাম না। আমি জীবনে এমন ভিডিও কলে কারও মৃত্যু দেখিনি। তবে এ দেশে আসার পর আত্মীয়–স্বজনদের অনেকেরই মৃতদেহ ভিডিও কলে দেখেছি। এমন সরাসরি ভিডিওর মাধ্যমে কাউকে মারা যেতে দেখিনি। তাই কী করব বুঝতে পারছিলাম না। হাত–পা কাঁপতে লাগল। কোডিকে চেয়ারে বসিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম।
একটু পরেই ডাক্তারকে বলতে শুনলাম, ইউর গ্র্যান্ডপা ইজ নো মোর। উই আর স্যরি।
রোশান, পাপা নো মোর। নো পাপা পাপা! নো!
কান্নায় আমিও আর সহ্য করতে পারছিলাম না।
কোডি দাদাকে পাপা ডাকত। পাপা পাপা বলে আরও শক্ত করে তার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। এরই মধ্যে আমার বাকি কলিগরাও আমার টেক্সট পেয়ে ছুটে এসেছে। দেখলাম তারাও চোখ মুছছে। সবাই কোডিকে জড়িয়ে কান্না করতে শুরু করেছে।
একটা সময় ভিডিও অফ হয়ে গেল।
একটা সময় কোডিও নীরব হয়ে এল। তারপর বলল, জানুয়ারি মাসে গ্র্যান্ডপা ইতালি গিয়েছিলেন তার স্কুল বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে। সেখান থেকেই ফিরেছেন অসুস্থ হয়ে। তারপর থেকেই তিনি হাসপাতালে করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন।
আমরা চারজন কোডিকে বাসায় পৌঁছে দিলাম। দরজার বাইরে থেকেই তাকে বিদায় দিয়ে আবারও অফিসে ফিরে আমাদের যান্ত্রিক কাজে মনযোগ দিলাম। কোডি কয়েকটা জায়গায় কল দিয়ে জানাল, ফিউনারেল হোম পাওয়া গেছে। তবে ১২ দিন লাগবে। এর মধ্যে কোডি তার দাদুর পছন্দের সবকিছুর আয়োজন করতে চায়। তার মধ্যে সে আইয়ুব বাচ্চুর সেই তুমির মিউজিক ডাউনলোড করে নিয়েছে। আমাকে কল দিয়েছে, তুমি আসতে চাও? আমি অনেক কষ্টে বুক বেঁধে স্বার্থপরের মতো করোনার ভয়ে যাইনি।
বলেছি, সরি কোডি।
ফিউনারেলে কোডি তার দাদার জন্য সেই তুমির মিউজিক বাজিয়ে শুনিয়েছে। আমি ঘরে বসে প্রার্থনা করেছি।
গ্র্যান্ডপা, এবার তুমি আইয়ুব বাচ্চুর গান সরাসরি শুনতে পারবে। হয়তো দুজনে মিলে ওপারে নতুন কনসার্টের আয়োজন করবে।