ট্রাম্পের এক ফোনেই খেল খতম!
ট্রাম্প কখন কী যে করেন, তার কোনো ঠিক নেই। বিশ্বের ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর একটা ফোনকল অনেক কিছুই ঘটিয়ে ফেলতে পারে। আনতে পারে অনেক পরিবর্তন। এমনকি থামিয়ে দিতে পারে দীর্ঘদিন ধরে চলা কোনো যুদ্ধও। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সাম্প্রতিক ফোনালাপে এমন এক ঘটনা দেখল বিশ্ব।
সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্প্রতি আকস্মিক এক ঘোষণায় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া থেকে দ্রুতই সব সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনার কথা জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অবশ্য বেশ আগেই এ ধরনের ঘোষণা আসবে বলে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে জানানো হয়, সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের আগে এরদোয়ানকে ফোন করেছিলেন ট্রাম্প। ওই ফোনকলেই বদলে যায় সব পরিস্থিতি। তিনি এরদোয়ানকে বলেছিলেন, সিরিয়া থেকে তিনি সেনা প্রত্যাহার করছেন। সেখান থেকে জঙ্গি আইএস নির্মূলের কাজ তুরস্ককে করতে হবে।
ট্রাম্প ও এরদোয়ানের ফোনালাপের বিষয়ে মার্কিন এক কর্মকর্তা বলেন, ট্রাম্প ফোন করে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত কুর্দি বাহিনীর ওপর তুরস্কের হামলা নিয়ে এরদোয়ানকে সতর্ক করবেন—এমন ধারণা করছিলেন তাঁরা। কিন্তু এর পরিবর্তে কথাবার্তার সময় ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে তাঁর নীতিই পাল্টে দিলেন। তিনি সিরিয়া ছেড়ে বাকি কাজ আঙ্কারার কাছে সঁপে দিলেন।
তুরস্কের এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, ফোনকলে ট্রাম্প এরদোয়ানকে প্রশ্ন করেন, ‘আমরা যদি সেনা সরিয়ে নিই, আপনারা কি আইসিস নির্মূল করতে পারবেন?’ এর জবাবে এরদোয়ান বলেন, ‘তুরস্কের সেনাবাহিনী বাকি দায়িত্ব সামলাতে পারবে।’ ট্রাম্প তখন বলেন, ‘তাহলে তাই করুন।’ এরপর ওই কনফারেন্স কলের সঙ্গে যুক্ত থাকা ট্রাম্পের নিরাপত্তা পরামর্শক জন বোল্টনকে ট্রাম্প সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরুর নির্দেশ দেন।
রয়টার্স জানিয়েছে, ১৪ ডিসেম্বর ওই দুই নেতার মধ্যে ফোনালাপ হয়।
তুরস্কের একটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছেন, ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত অপ্রত্যাশিত ছিল। এ অবস্থাকে আশ্চর্য বললে কম বলা হবে।
ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত অবশ্য ওয়াশিংটনকেও বড় ধাক্কা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রেসিডেন্টের মনোভাব বদলানোর জন্য মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিসসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালান। কিন্তু ট্রাম্প তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। এ ঘটনার জেরে জেমস ম্যাটিস ও মার্কিন কূটনীতিবিদ ব্রেট ম্যাকগ্রুক পদত্যাগ করেন।
সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যেই নতুন চমক দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কোনো ঘোষণা ছাড়াই ইরাক সফর করেন ট্রাম্প-মেলানিয়া দম্পতি। আর এটাই প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পাওয়ার পর কোনো যুদ্ধাঞ্চলে ট্রাম্পের প্রথম সফর। সেখানে তাঁরা ঘণ্টা তিনেক অবস্থান করেন। হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বলা হয়, গভীর রাতে বিমানযোগে বাগদাদ যান প্রেসিডেন্ট। দেশের জন্য ‘সেবা, সাফল্য ও আত্মত্যাগ’ করায় সেনাদের ধন্যবাদ জানান ট্রাম্প। তবে আপাতত ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহারের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানান তিনি।
ট্রাম্প বলেন, সেনাবাহিনীর কমান্ডাররা সিরিয়ায় সেনা রাখার জন্য কয়েক দফা অনুরোধ জানান। কিন্তু যেখানে আইএস, সেখানে পরাজিত হওয়ায় তিনি তাঁদের সেই অনুরোধ রাখেননি।
মার্কিন সেনাদের ট্রাম্প বলেন, ‘এরদোয়ানের সঙ্গে দারুণ আলাপ হয়েছে। সেখানকার বাদবাকি কাজ তুরস্ক সারবে।’
বিবিসি বলেছে, সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট পরাজিত হয়েছে—এমন মন্তব্য করে গত বুধবার মি. ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে সিরিয়া থেকে প্রায় দুই হাজার মার্কিন ট্রুপ প্রত্যাহার করা হবে। তবে এই ধরনের সিদ্ধান্তের বিরোধী ছিলেন মি. ম্যাটিস, যিনি বলেছিলেন, সিরিয়া থেকে আগে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়া ‘কৌশলগত ভুল’ হবে।
সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জিহাদি গ্রুপগুলোর অধিকাংশকেই দমন করতে সহায়তা করেছে মার্কিন সেনাবাহিনী, কিন্তু সিরিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে বিদ্রোহী যোদ্ধারা এখনো রয়েছে।
মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, আইএসের বিরুদ্ধে বিমান অভিযান বন্ধ করা হবে।
সেনা প্রত্যাহারের কোনো নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হবে না হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে, তবে নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৩০ দিনের মধ্যে সেনা প্রত্যাহার কার্যকর করতে চান।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশগুলো। তবে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছে দেশটির আরেক মিত্র তুরস্ক। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের কারণে সিরিয়ার কুর্দি বাহিনীর বিরুদ্ধে তুরস্ক হামলা আরও জোরদার করতে পারবে। তুরস্ক কুর্দি বাহিনীকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মনে করলেও ওই বাহিনীকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কুর্দি বাহিনীর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা সরে আসার সিদ্ধান্তে তুরস্কের জন্য একাধারে সুযোগ ও ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
আঙ্কারা দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে, কুর্দি মিলিশিয়া গ্রুপ ওয়াইপিজিকে মদদ দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াইপিজিকে তুরস্ক সন্ত্রাসী গ্রুপ হিসেবে বিবেচনা করে এবং আফলির অঞ্চল থেকে এই গ্রুপকে হটিয়ে দেওয়াই লক্ষ্যে অভিযান চালাচ্ছে। ওয়াইপিজি নামে পরিচিত এই কুর্দি মিলিশিয়া গ্রুপ তুরস্কের দক্ষিণ সীমান্ত ছাপিয়ে সিরিয়ার আফরিন অঞ্চলজুড়ে সক্রিয় রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করলে তুরস্কের সেনাদের জন্য ওয়াইপিজিকে চাপে ফেলা সম্ভব হবে। মার্কিন সেনাদের মোকাবিলা ছাড়াই ওয়াইপিজিকে পিছু হটতে বাধ্য করবে তুরস্ক। দীর্ঘদিন ধরেই দুই দেশের কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণ ছিল এটাই।
ওয়াইপিজি এখন তুরস্কের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সিরিয়া সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করবে। তুরস্ককে যদি আইএসের বিরুদ্ধে লড়তে যেতে হয়, তবে কুর্দি-অধ্যুষিত ২৫০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে যেতে হবে।
ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের টার্কিশ প্রোগ্রামের পরিচালক সোনের ক্যাগাপটি বলেন, এরদোয়ান যা নিয়ে দর-কষাকষি করেছিলেন, তার চেয়ে বেশিই পেলেন। যুক্তরাষ্ট্রকে ওয়াইপিজিকে মদদ দেওয়া বন্ধ করতে বলেছিলেন, কিন্তু ট্রাম্প সিরিয়া থেকে সেনা সরানোর ঘোষণা দিয়ে দিলেন।
তুরস্ক এখন মস্কো ও ওয়াশিংটনের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার সত্ত্বেও সোমবার সিরিয়া সীমান্তে আরও সেনা পাঠিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। এর বাইরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তুরস্কে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি।
এএফপির খবরে জানানো হয়, স্থানীয় সময় সোমবার সন্ধ্যায় টেলিফোন সংলাপে ট্রাম্পকে আমন্ত্রণ জানান এরদোয়ান। আগামী বছর, অর্থাৎ ২০১৯ সালে ট্রাম্পকে তুরস্ক সফরের আমন্ত্রণ জানান তিনি। ট্রাম্প জানান, এরদোয়ান কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা বলেননি। ভবিষ্যতে এরদোয়ান ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করতে চান। আঙ্কারার প্রত্যাশা, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকর্তার কয়েক দিনের মধ্যে তুরস্কে আসবেন।
এদিকে এরদোয়ানের একজন মুখপাত্র বলেছেন, তুরস্কের গোয়েন্দাপ্রধান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মস্কোয় দৌড়াদৌড়ি করছেন।
তুরস্কের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, ট্রাম্পের এক ফোনেই সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। তাই এটা এখন সামলানো কঠিন। সবকিছু নতুন করে পরিকল্পনা করে এগোতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলছেন, সামরিক পরিকল্পনাবিদেরা খসড়া তৈরি করছেন। কয়েক মাসের মধ্যে সেনা প্রত্যাহার হবে। চার মাসের একটি প্রস্তাব বিবেচনায় রয়েছে। ওয়াইপিজিকে দেওয়া অস্ত্র ফেরত নেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে।
তুরস্ক বলছে, মার্কিন সেনারা সরে গেলে ওয়াইপিজির কাছে দেওয়া অস্ত্র প্রত্যাহার করতে হবে যাতে তুরস্কের সেনাদের ওপর ব্যবহার করতে না পারে। তুরস্ক ওয়াইপিজির ওপর হামলা চালাবে না।
মার্কিন সেনারা চলে গেলে সে শূন্যতা পূরণের বিষয়টি যথাযথ পরিকল্পনা ও যৌথ উদ্যোগে করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সমঝোতা চুক্তিতে পৌঁছানো না গেলে সমস্যা বাড়বে এতে।
তবে সব মিলিয়ে তুরস্কের কি জয় হচ্ছে? সামরিক কর্মকর্তারা বলছেন, এখনই জয়-পরাজয়ের বিষয়টি বলার মতো সময় আসেনি।