ষাটের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের যাত্রালগ্ন থেকে নাটকের এক জোয়ার শুরু হয়। কারিগরি বা অর্থনৈতিক সুবিধা ছাড়াই শুধুমাত্র নাট্যব্যক্তিত্বদের সৃজনশীলতা ও উদ্দীপনাকে পুঁজি করে এগিয়ে চলে নাটকের অগ্রযাত্রা। স্বাধীনতার পর এ যাত্রা আরও বেগবান হয় এবং পৃথিবীর ইতিহাসে টিভি নাটকের উৎকর্ষ ও জনপ্রিয়তায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নবিত্ত—সব শ্রেণির মানুষের শিক্ষা ও বিনোদনের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে টিভি নাটক।
টিভি নাটকের এ উৎকর্ষের পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে মঞ্চ নাটক। স্বাধীনতার পর মঞ্চে পেশাদার নাট্যচর্চার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। যদিও উপার্জন নেই, পর্যাপ্ত মঞ্চ ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নেই, তথাপি নাট্যকর্মীদের প্রবল উৎসাহ, সৃজনশীলতা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের ফলে নাট্য আন্দোলনের সূচনা হয় এবং বিশ্বমানের নাটক নির্মিত ও উপস্থাপিত হতে থাকে। মূলত মঞ্চের সেসব নাট্যব্যক্তিত্বরাই হাল ধরেন টিভি নাটকের। মঞ্চে যেমন উন্মাদনা, টিভিতেও তেমনি উদ্দীপনা। এর সঙ্গে যোগ দেন কবি-সাহিত্যিকবৃন্দ। তাঁরা লিখতে থাকেন অসাধারণ সব নাটক। টেলিভিশনের সীমিত পরিসরে মহড়া, নাটকের সেট তৈরি ও সব শেষে নাটক ধারণের কাজ চলে দারুণ উদ্দীপনা নিয়ে। আর সে নাটক দেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে দর্শক। কোনো কোনো নাটকের প্রদর্শনীর দিন সন্ধ্যা থেকে শহরে নামে ভৌতিক নীরবতা। কারণ, সবাই টেলিভিশনের সামনে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কোনো কোনো নাটকের জন্য দেশে আন্দোলন পর্যন্ত হয়েছে। সে আন্দোলন সামাল দিতে এমনকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিতে হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থাও। কোনো কোনো নাটকের সংলাপ পরিণত হয়েছে বিপ্লবী স্লোগানে। টিভি নাটকের কী গভীর প্রভাব ছিল সে সময়ের সমাজে ও দেশে!
তবে শুরু থেকেই টিভি নাটকের প্রধান সংকট ছিল অর্থনৈতিক দৈন্য। উন্নত মানের পাণ্ডুলিপি ও কলাকুশলী থাকলেও সরকারি টেলিভিশনের বাজেটের স্বল্পতার কারণে নাটকের পরিসর সীমিত রাখতে হতো। সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হতেন শিল্পী ও কলাকুশলীরা। যে সম্মানী তাঁরা পেতেন, তা দিয়ে যাতায়াত খরচের বেশি সংকুলান হতো না। ফলে টিভি নাটককে পেশা হিসেবে গ্রহণের পরিবেশ তৈরি হয়নি। এ থেকে জন্ম নেয় শিল্পীদের মধ্যে অসন্তোষ ও হতাশা। এমনকি অনেক প্রতিভাবান শিল্পী নাট্যজগৎ থেকে বিদায় নেন। এর পাশাপাশি ছিল সরকার দলীয় নিয়ন্ত্রণ, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি।
নব্বইয়ের দশকে টিভি নাটকে কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তন শুরু হলো। প্রথম ধাপে ছিল প্যাকেজ নাটক। বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত নাটক সরকারি টেলিভিশনে প্রচার শুরু হলো, যেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যুক্ত হলো উদ্যোক্তা কিংবা বিজ্ঞাপনদাতা হিসেবে। দ্বিতীয় ধাপে জাগরণ ঘটল বেসরকারি টেলিভিশনের। একে একে বাড়তে থাকল টিভি চ্যানেলের সংখ্যা, বাড়ল নাটকের সংখ্যা। সে সঙ্গে বাড়ছে শিল্পী ও কলাকুশলীদের উপার্জন। শিগগিরই একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেল নাটক। আর সচ্ছল পেশা হিসেবে নাট্যচর্চা জনপ্রিয় হয়ে উঠল নাট্যজনদের মধ্যে। অনেক শিল্পী বিভিন্ন চাকরি থেকে ইস্তফা বা অবসর নিয়ে পুরোদমে নাট্যচর্চায় নিবেদিত হলেন। এক বিশাল ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তরিত হলো টিভি নাটক। এখন তাহলে সংকটের কথা বলছি কেন? সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমাদের চলচ্চিত্রের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক।
পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয়। উর্দু ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সেখানেও যুক্ত হন কিছু অসম্ভব মেধাবী মানুষ। নিষ্ঠার সঙ্গে পরিশ্রম করে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করান বাংলা চলচ্চিত্রকে। স্বাধীন বাংলাদেশে অন্য সব সৃজনশীল চর্চায় যখন অর্থনৈতিক মন্দাভাব চলছিল, তখন একমাত্র এফডিসি ছিল লোভনীয় পেশার ক্ষেত্র। রুপালি পর্দার তারকা শিল্পী ও কলাকুশলীরা ব্যক্তিগত জীবনেও বিত্তবৈভবের মধ্যে বসবাস করতেন। কিন্তু ক্রমেই এ লোভনীয় পেশায় ব্যবসায়িক ভাবনা প্রাধান্য পেতে থাকল। মুনাফার লোভে অযোগ্য ও অসাধু মানুষের আনাগোনা বাড়তে থাকল। এদের হাতে পড়ে চলচ্চিত্র শুদ্ধ শিল্পের পথ ছেড়ে নোংরা পথে পা বাড়াল, যেখানে নকল গল্প, সস্তা অভিনয়, ভাঁড়ামি ও সর্বোপরি অশ্লীলতা গ্রাস করতে থাকল এ রুপালি জগৎকে। মেধাবী ও পরিশ্রমী শিল্পীরা ধীরে ধীরে বিদায় নিতে থাকলেন। দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকল। বন্ধ হতে থাকল সিনেমা হল। ধ্বংসের মুখে উপনীত হলো এফডিসি।
তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যাবে, টিভি নাটকও অনুসরণ করছে চলচ্চিত্রশিল্পের পথ। অনেক শ্রদ্ধেয়জনের নিষ্ঠা ও সাধনার দ্বারা যখন টিভি নাটক পেশাদারি অর্জনের পথে, তখন এখানেও এসে ভিড় করছে অসাধু ব্যবসায়ী ও অযোগ্য শিল্পী। ফলে এ শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কিত হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট সবাই।
প্রথমত, যে হারে চ্যানেলের সংখ্যা ও নাটকের পরিমাণ বেড়েছে, সে হারে পৃষ্ঠপোষক ও বিজ্ঞাপনদাতার সংখ্যা বাড়েনি। ফলে স্বভাবতই নাটক প্রতি অর্থলগ্নির পরিমাণ গেছে কমে। নাটকের বাজেট আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় কমাতে হচ্ছে শিল্পীসংখ্যা। নিতে হচ্ছে কম পারিশ্রমিকে নিম্নমানের শিল্পী। নাটকের পরিসর সীমিত থাকছে একটি লোকেশনে। আর ধারণকাজ সম্পন্ন করতে হচ্ছে স্বল্পতম সময়ে।
দ্বিতীয়ত, অর্থলগ্নির সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো অনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে নাটক নির্মাণকে। পাণ্ডুলিপি থেকে শুরু করে শিল্পী নির্বাচন পর্যন্ত সবকিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। নাটকের গুণগত মান নিয়ে যাদের বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই, ভ্রুক্ষেপও নেই, তারাও নাক গলাচ্ছে।
তৃতীয়ত, কিছু অযোগ্য নির্মাতা ও শিল্পীর দখলে চলে যাচ্ছে নাটক। তাঁরা আবার ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে এক সিন্ডিকেট তৈরি করছে, যার বাইরের কেউ এ নাট্যজগতে সুযোগ পাবে না। ফলে মেধাবী নাট্যব্যক্তিত্বরা ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিচ্ছেন নিজেদের। বিশেষ করে বয়োজ্যেষ্ঠ শিল্পীরা একেবারেই উপেক্ষিত হচ্ছেন সাম্প্রতিক নাটকে। মঞ্চ থেকে যেভাবে প্রশিক্ষিত শিল্পীরা আসতেন টিভি নাটকে, এখন তা বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
চতুর্থত, টিভি চ্যানেলগুলোর উন্নসিকতা নাটকের বিপর্যয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করছে। তাদের দৃষ্টি শুধু মুনাফার দিকে। তাদেরই চ্যানেলে যে নাটক প্রচারিত হচ্ছে, সে নাটকের বিষয়বস্তু, গুণগত মান ইত্যাদি নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। একটি নাটক যে-ই নির্মাণ করুক না কেন, নাটকটি যখন প্রচারিত হচ্ছে তখন তার দায়ভার টিভি চ্যানেলের ওপরই বর্তায়।
পঞ্চমত, চলচ্চিত্রের মতো নাটকের দর্শকও ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বিজ্ঞাপনের অত্যাচারে এমনিতেই কোনো নাটক দেখার উপায় নেই। তার ওপর নিম্নমানের গল্প, সংলাপ, অভিনয় ইত্যাদি সহ্য করা সত্যিই কষ্টকর। একদিকে ব্যস্ত জীবন অন্যদিকে অগণিত চ্যানেল। ফলে দর্শকের রিমোট অনবরত এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সর্বোপরি কোনো টিভি চ্যানেল দেখতে মূলত দর্শকের কোনো মূল্য দিতে হয় না। শুধু ক্যাবলের ভাড়া দিলেই সব চ্যানেল বিনে পয়সায় দেখা যায়। ফলে একদিকে টিভি চ্যানেল তার স্বত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে দর্শকেরও কোনো দায় থাকছে না কোনো বিশেষ চ্যানেলের প্রতি। দর্শক বা সমাজের প্রতি একটি টিভি চ্যানেলের কোনো দায়বদ্ধতা তৈরি হয়নি। এক লাগামহীন ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসেছে নাটক। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কোন গন্তব্য নেই, কোন দায়িত্বজ্ঞান নেই। অভিনয়শিল্পী, নির্দেশক ও কলাকুশলীদের নানাবিধ সংগঠন তৈরি হয়েছে, যারা চেষ্টা করছে নাটকের লাগাম ধরতে। কিন্তু আশঙ্কামুক্ত হচ্ছে না নাটক।
বাংলাদেশের দুটি প্রধান শিল্প চলচ্চিত্র ও নাটক ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে কী কোনো রাজনৈতিক কারণ রয়েছে? জাতীয় স্বার্থে নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিশ্লেষণ সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের সময় কি আজও হয়নি?