চারদিনে তিন সুহৃদের মৃত্যু
প্রায়ই দেশ থেকে কোন পরম শ্রদ্ধেয়জন, বন্ধু অথবা কোন সুহৃদের মৃত্যু সংবাদ আমাকে শোকাহত করে। গত সপ্তাহে চারদিনের মাথায় পর পর পরম শ্রদ্ধেয়, একান্ত বন্ধু ও অনুজপ্রতিম তিন আপনজনের মৃত্যু সংবাদে ভীষণভাবে মুষড়ে পড়েছি। পর পর কাছাকাছি সময়ে তিনজনের মৃত্যু সংবাদ আগে কখনো পাইনি। ফলে মর্মাহত হওয়াই স্বাভাবিক।
প্রথমে বন্ধু তবারক হোসেন একটি দুঃসংবাদ দেন। পরম শ্রদ্ধেয় মনির উদ্দিন অর্থাৎ পি পি মনির উদ্দিন আহমেদ আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তিনি আমাদের অত্যন্ত কাছের ও পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতির অনুসারী। ’৬৬ সালে যখন রাজনীতিকে জীবনের পেশা ও নেশা হিসেবে গ্রহণ করি, তখন থেকে তাঁর সঙ্গে পরিচয়, সম্পর্ক। সহকর্মী বন্ধু রফিকুর রহমান লজু এবং আমি সময় পেলেই চলে যেতাম তাঁর বাসায়। পেশায় ছিলেন আইন ব্যবসায়ী। ওকালতির পাশাপাশি রাজনীতি ছিল অন্যতম নেশা। ওকালতি পেশা হলেও অর্থের পাহাড় গড়ার নেশা হিসেবে কখনো নেননি। ছিলেন একজন সততার প্রতীক। স্বাধীনতার পর সরকারের পি পি।
মুক্তিযুদ্ধের অপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে বহু উকিলের তখন পোয়াবারো। অথচ মনির উদ্দিন সাহেবের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ছিলেন সিলেট ল’ কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম এবং পরবর্তীতে অধ্যক্ষও। সততা ও সজ্জন ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য ছিল জীবনের মাপকাঠি। একে একে সহপাঠী বন্ধু আসদ্দর আলী, আবদুল হামিদ, পীর হবিবুর রহমানসহ অনেকেই চলে গেছেন। তাদের চলে যাওয়ার একাকিত্বে মুষড়ে পড়েছেন। বেশ কিছুদিন ধরে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। গত সপ্তাহে বর্ণাঢ্য জীবনের ইতি টেনে চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে। গভীর শ্রদ্ধা জানাই তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি।
দ্বিতীয় সংবাদটি সহকর্মী বন্ধু ফরিদ হায়দার চৌধুরীর। তিনিও দীর্ঘদিন থেকে অসুস্থ ছিলেন। অনুজপ্রতিম সহকর্মী বন্ধু মনিরুজ্জামান চৌধুরী কয়েকদিন থেকে সংকটাপন্ন অবস্থার কথা জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছিলেন। অনেকটা দুঃসংবাদের আশঙ্কায় ছিলাম বলা চলে। এক সময় রাজনীতি ও ব্যবসা গুটিয়ে লন্ডন চলে যান। অসুস্থ অবস্থায় ছেলের সঙ্গেই থাকতেন। ৭/৮ মাস আগে লন্ডনে ফোনে শেষ কথা হয়। ভগ্নিপতি মতিন সাহেব ছিলেন ঠিকাদার। তার পথ ধরেই ঠিকাদারি ও রাজনীতি করতেন। ছিলেন সাম্যবাদের অনুসারী। স্বাভাবিকভাবে সহকর্মী ছিলেন। বয়সে সম্ভবত বছর দুই/তিন বড় হবেন। মূল বাড়ি মৌলভীবাজারের শমশেরনগরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। পারিবারিকভাবে প্রয়াত কূটনীতিক ও সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এমএনএ মুন্তাকিম চৌধুরীর ভাতিজা হন। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই আমার সঙ্গে পরিচয়–সম্পর্ক। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে তিনি মেঘালয়ে ছিলেন। আমি ছিলাম কাছাড়ের করিমগঞ্জে।
জুনের প্রথম দিকে মেঘালয়ের নাছাইন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রশিক্ষণ শিবির প্রতিষ্ঠিত হয়। করিমগঞ্জ থেকে আমি ও গুলজার আহমেদ (গুলজার ভাই) দায়িত্ব নিয়ে চলে যাই সেখানে। সেই ক্যাম্পে আরও ছিলেন ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে ফরিদ হায়দার চৌধুরী, একসময়ে যশোর ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি সিলেট জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক জামিরুল ইসলাম (মৃত), ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আফতাব (মৃত), বরইকান্দির মঈন উদ্দিন, গোয়াইনঘাট থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন (বর্তমানে আমেরিকার মিশিগানে বাস করেন)। গুলজার আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ক্যাম্প প্রশাসক। আমি ছিলাম রিক্রুটিং ইনচার্জ। ১৬ ডিসেম্বর ফরিদ হায়দার চৌধুরী, বরুণ রায়, আবদুল লতিফ সরদার, আফতাব, মঈন উদ্দিন ও জেমস ফিনলে টি কোম্পানির জাফলং বাগানের ব্যবস্থাপক কয়েস চৌধুরী একসঙ্গে সিলেট শহরে প্রবেশ করি। ফরিদ ভাইয়ের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অনেক ঘটনা ও স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
স্বাধীনতার পর আমরা সবাই দেশ পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করি। ফরিদ ভাই ঠিকাদারির পাশাপাশি রাজনীতি করেছেন পুরোদমে। আমার ও আমার পরিবারের সঙ্গে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে সরে যেতে থাকেন ফরিদ ভাই। তারপর একপর্যায়ে ব্যবসা রাজনীতি সব ছেড়ে লন্ডন চলে যান। মাঝেমধ্যে দেশে আসলেও লন্ডনেই থাকতেন। পরে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হন। ৫ মে পরিবার–পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও সংসারের মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। পেছনের দিকে যখন তাকাই, অনেক সহকর্মী বন্ধুই ফরিদ ভাইয়ের মতো আজ স্মৃতি। ফরিদ ভাইয়ের মৃত্যুতে সত্যিই মর্মাহত। বারবার পুরোনো স্মৃতি মনের মধ্যে যখন উঁকি দেয়, আবেগে আপ্লুত না হয়ে পারি না। ফরিদ ভাই তুমি যেখানেই থাকো আমি এবং তোমার সহকর্মী বন্ধুরা তোমার চলে যাওয়ায় গভীরভাবে শোকাহত। আমাদের ভালোবাসা দেওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে তোমাকে দেওয়ার আর কিছু নেই। তুমি ভালো থেকো।
তৃতীয় সংবাদটি ৭ মে দেন আমার স্ত্রী। অনুজ বিশ্বনাথ বণিক। মূল বাড়ি টাঙ্গাইল। স্বাধীনতার বেশ আগে থেকে তার পরিবার সিলেট শহরের মিরাবাজারে বাস করতেন। স্বাভাবিকভাবে তাঁর পড়ালেখাও সিলেটে। ছাত্র ইউনিয়নের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। মিরাবাজারে ছাত্র ইউনিয়নের একটি শক্তিশালী গ্রুপ ছিল। বিশ্বনাথ তাদেরই একজন। আগপাড়ার বাবুল পাল ও বিশ্বনাথ ছিল হরিহর আত্মা। দুজনই আমার স্ত্রীকে ধর্মের বোন বানিয়েছিল। এক সময় বিশ্বনাথ আমার বাসায়ও কিছুদিন থেকেছে। বাবুল ও বিশ্বনাথ দুজনই সাম্যবাদে দীক্ষিত ছিলেন।
পঁচাত্তরের পর বাবুল চলে যান লিবিয়ায়। একপর্যায়ে বন্ধু বিশ্বনাথকেও নিয়ে যান। তারপর বাবুল চলে আসেন আমেরিকায়। এখন নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় থাকেন। আর বিশ্বনাথ চলে যান ইতালি। প্রায়ই ফোনে কথা হতো। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে দেশে চলে যান। আর্থিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না। বাবুল বলেছিল আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বিশ্বনাথ চিকিৎসা করাতে পারছে না। আমার স্ত্রী ও বাবুল তাঁর চিকিৎসায় কিছু অর্থ পাঠানোরও পরিকল্পনা করেছিলেন। অর্থ আর পাঠানো হয়নি, তার আগেই বিশ্বনাথের যাওয়ার ডাক এসে গেছে। এ বেদনা বিশ্বনাথের মৃত্যু সংবাদের চেয়ে বেদনাদায়ক আমি, আমার স্ত্রী ও বাবুলের কাছে। বিশ্বনাথ বয়সে আমাদের ছোট। কিন্তু নিয়তির কাছে সম্ভবত ছোট–বড় কোন ভেদাভেদ নেই। তাই বিশ্বনাথকে চলে যেতে হয়েছে। এই নিষ্ঠুর নিয়মের গ্লানি আমরা বহন করে চলেছি। বিশ্বনাথের আত্মা শান্তি পাক, এই কামনা করি।