গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভরসা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
দীর্ঘদিন ধরেই গোয়েন্দাগিরিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবহৃত হচ্ছে। কম্পিউটারের ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে উন্নত হচ্ছে মেশিন লার্নিং, নিউরাল নেটওয়ার্ক, কম্পিউটারের সৃজনশীলতার মতো প্রযুক্তি। একই সঙ্গে বাড়ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির কাজের ধরন কিংবা এর কর্মক্ষমতা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রযুক্তিগুলোর একটি হিসেবে মনে করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাঁদের কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চাশা প্রকাশ করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এ ক্ষেত্রে কত দূর এগিয়েছে, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট।
যন্ত্র যখন বুদ্ধিমান মানুষের মতো কাজ করে বা প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেটাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। স্বাভাবিকভাবে যেসব বিষয়ের জন্য মানুষের প্রয়োজন হয়, যেমন কারও চেহারা দেখে বা কণ্ঠ শুনে তাকে চিনতে পারা, বিশেষজ্ঞের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বদৌলতে এখন যন্ত্রের মাধ্যমে সেগুলো করা সম্ভব হয়ে উঠছে।
ইকোনমিস্ট বলছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করার ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) ও ব্রিটেনের গভর্নমেন্ট কমিউনিকেশনস হেডকোয়ার্টার্স (জিসিএইচকিউ) প্রাথমিকভাবে এআই ব্যবহারের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল এআই ব্যবহার করে সোভিয়েত ফোনকলে আড়ি পেতে বিপুল পরিমাণে প্রতিলিপি তৈরি এবং অনুবাদ করতে সহায়তা পাওয়া। ষাট ও সত্তরের দশকে এর ব্যবহার আরও বাড়িয়েছিল তারা।
তবে ওই সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি অপরিণত ছিল। সাবেক এক ইউরোপীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি যে কাজে যুক্ত ছিলেন, তাতে ২০০০ সালের দিকে আফগানিস্তানে স্বয়ংক্রিয় প্রতিলিপি বা অনুবাদের কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা হয়নি। এর বদলে তাঁরা স্থানীয় ভাষাভাষী লোকদের ওপর নির্ভর করেছিলেন। তবে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত সফটওয়্যারগুলো আরও ভালো করার আশা জোগাচ্ছে তাঁদের।
২০৩০ সাল নাগাদ আমেরিকার ১৭টি বা তার চেয়ে বেশি গোয়েন্দা সংস্থা মিলে একটি বিশেষ অ্যানালিটিক ইঞ্জিন তৈরি করবে। এই ইঞ্জিন সাধারণ বুদ্ধিমত্তা থেকে শুরু করে স্যাটেলাইটের ছবি পর্যন্ত বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য ঝুঁকি নির্ণয় করবে।
এআই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নত হয়েছে। ব্যবসা ক্ষেত্রে এআইয়ের ব্যবহারকে আকর্ষণীয় করে তোলার ক্ষেত্রে আরও বেশি ডেটা বা তথ্যের সহজলভ্যতা, উন্নত অ্যালগরিদম ও আরও প্রসেসিং ক্ষমতা বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো যুক্ত রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঘিরেই উচ্চাশা পোষণ করতে শুরু করেছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কর্মক্ষেত্র কীভাবে বদলে দিচ্ছে, তা নিয়ে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের গভর্নমেন্ট কমিউনিকেশনস হেডকোয়ার্টার্স একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। ওই নিবন্ধে বিশেষ প্রযুক্তি টুলভিত্তিক ফ্যাক্ট চেকিং ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে ভুয়া ছবি ও ভুয়া তথ্য শনাক্ত করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক বিশেষ এ ব্যবস্থায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো বট ব্যবহার করে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হলেও তা সহজে ধরা যাবে।
এর বাইরে বিভিন্ন যন্ত্রের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে সাইবার হামলা ঠেকাতে পারবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আর্থিক লেনদেনের সন্দেহজনক শৃঙ্খল চিহ্নিত করে আর্থিক অপরাধ ঠেকাতেও সাহায্য করতে পারে এআই।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের সুফলগুলো ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পেতে শুরু করেছে। উদাহরণ হতে পারে নিউক্লিয়ার থ্রেট ইনিশিয়েটিভ নামের একটি মার্কিন বেসরকারি সংস্থা। তারা সহজলভ্য তথ্যের ওপর মেশিন লার্নিং প্রয়োগ করেছে। এতে তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উপাদানগুলোর অবৈধ বাণিজ্যে যুক্ত থাকতে পারে, এমন সন্দেহভাজন প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সহজে পাওয়া যায়, এমন তথ্যের ব্যবহারেই আটকে থাকে না।
অনেকেই মনে করেন, ব্যক্তিগত তথ্যে গোয়েন্দাদের নজরদারির সক্ষমতা থাকায় কৃত্রিম বুদ্ধিমান অ্যাপ্লিকেশনগুলোকে তারা আরও ক্ষমতাশালী করে তুলতে পারে। এতে প্রায়োগিক বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রটিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কমিশন ১ মার্চ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান এরিক স্মিড ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপপ্রতিরক্ষা সচিব বব ওয়ার্ক।
ওই প্রতিবেদনেও গোয়েন্দাগিরিতে এআইয়ের ব্যবহার নিয়ে উচ্চাশার কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ আমেরিকার ১৭টি বা তার চেয়ে বেশি গোয়েন্দা সংস্থা মিলে একটি বিশেষ অ্যানালিটিক ইঞ্জিন তৈরি করবে। এই ইঞ্জিন সাধারণ বুদ্ধিমত্তা থেকে শুরু করে স্যাটেলাইটের ছবি পর্যন্ত বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য ঝুঁকি নির্ণয় করবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে পেন্টাগন কোভিড-১৯ মোকাবিলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। কয়েক ডজন উপাত্তের সেট (ডেটা সেট) ব্যবহার করে কোভিড-১৯–এর হটস্পট শনাক্ত, চাহিদা ও জোগানের বিষয়টি একত্র করতে সক্ষমতা দেখিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে যা সম্ভব করে দেখিয়েছে, তা সব সময় জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রয়োগ সম্ভব নয়। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবহার–সংক্রান্ত আইনি বাধ্যবাধকতা মানতে হয়।
জিসিএইচকিউ তাদের গবেষণাপত্রে বলেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত পক্ষপাতিত্বের বিষয়েও সচেতন হতে হবে। ভয়েস রিকগনিশন সফটওয়্যার কিংবা অ্যালগরিদমের অনিশ্চয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। অবশ্য মার্কিন গোয়েন্দারা মানবিক মর্যাদা, অধিকার এবং স্বাধীনতাকে সম্মান করার কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস) সম্প্রতি ‘ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্স জোট’ সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করেছে। পাঁচটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে গঠিত বিশ্বের শীর্ষ গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ফাইভ আইজ। দেশগুলো হলো আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা ও নিউজিল্যান্ড।
সিএসআইএস বলছে, দেশগুলো তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা–সংক্রান্ত তথ্য একটি ক্লাউড সার্ভারে তথ্য রাখতে সম্মত হয়েছে। সেখান থেকে সবাই তা শেয়ার করতে পারবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে একটি বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছে এর প্রয়োগ ও নৈতিকতার দিকটি। যান্ত্রিক শিক্ষা বা মেশিন লার্নিং এখন বিভিন্ন প্যাটার্ন বা ধরন শনাক্ত করতে পারে।
যেমন মোবাইল ফোন ব্যবহারের নির্দিষ্ট ধরন সহজেই বুঝতে পারে এটি। তবে কারও আচরণের বিষয়ে পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে এখনো যথেষ্টই দুর্বল এআই। তথ্যের স্বল্পতা থাকলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আরও দুর্বল হয়ে ওঠে। কাউন্টার টেররিজম বা সন্ত্রাস দমনের ক্ষেত্রেও এর প্রয়োগের বিষয়টিতে এখনো দুর্বলতা রয়ে গেছে। প্রতিবছর সাধারণ চুরির ঘটনা থেকে তথ্য নিয়ে পুলিশের জন্য চুরির মডেলের পূর্বাভাস দিতে পারলেও সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পূর্বাভাস এআই থেকে এখনো পাওয়া কঠিন। এর বাইরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগে রোগনির্ণয়ের মতোই ‘ফলস পজিটিভ’ সৃষ্টির ঝুঁকিও তৈরি হয়। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেল তৈরির ক্ষেত্রে যত্নশীল হলে ফলস পজিটিভ হার কমিয়ে আনা যায়।
গোয়েন্দা ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফলতার ক্ষেত্রে তথ্য বা ডেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় যেসব তথ্য তাদের হাতে থাকে, তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের উপযুক্ত না–ও হতে পারে। ড্রোন ক্যামেরার তথ্য, স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য বা ফোনে আড়ি পেতে পাওয়া তথ্য বর্তমানে এমন কোনোভাবে ব্যবহার করা যায় না, যাতে তা মেশিন লার্নিংয়ের ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে। এগুলো পরিশ্রমসাধ্য, সময়সাপেক্ষ ও কর্মী–নির্ভর কাজ। এখনো এসব কাজ করতে মানুষের সাহায্য লাগে। এগুলো ঠিক গোয়েন্দাদের কাজের মধ্যে পড়ে না।