একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে অনেকটাই বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জনসমর্থনে প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের চেয়ে গড়ে সাড়ে সাত পয়েন্টে পিছিয়ে রয়েছেন। বেশির ভাগ মার্কিন নাগরিক মনে করেন, ট্রাম্পের নেতৃত্বের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ করোনা মহামারির কারণে চলতি সংকট। অর্থনীতিও মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে পারছে না। নিজেকে ‘আইন ও শৃঙ্খলা’র প্রেসিডেন্ট হিসেবে উপস্থাপন করার যে কৌশল ট্রাম্প নিয়েছিলেন, তা-ও সেভাবে কাজ করেনি। এই অবস্থায় আগামী ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজের ভাগ্য ফেরাতে তাঁর মনোযোগ এখন করোনাভাইরাসের একটি কার্যকর টিকার দিকে। যেভাবেই হোক, নির্বাচনের আগে তাঁর টিকা চাই-ই চাই। অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে কি করোনার টিকাই হতে চলেছে ট্রাম্পের ‘অক্টোবর-বিস্ময়’?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ আগে নির্বাচনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া নাটকীয় যেকোনো ঘটনাই মার্কিন রাজনীতিতে ‘অক্টোবর-বিস্ময়’ নামে পরিচিত। সে রকম একটি ঘটনা ছিল ২০১৬ সালের ২৮ অক্টোবর মার্কিন কংগ্রেসের কাছে পাঠানো যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার (এফবিআই) তৎকালীন প্রধান জেমস কোমির চিঠি। নির্বাচনের আগমুহূর্তে পাঠানো ওই চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন, ওই নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ব্যক্তিগত ই-মেইল সার্ভারের মাধ্যমে সরকারি ই-মেইল চালাচালি করেছেন। অনেকেই মনে করেন, নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে এমন বোমা ফাটানোর জন্যই সেবার হিলারি পরাজিত হয়েছিলেন।
নির্বাচনের আগমুহূর্তে যেভাবেই হোক, করোনার একটি টিকা বাজারে আসার ঘোষণা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ট্রাম্প। গত সপ্তাহেও এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জোর দিয়ে বলেন, অক্টোবরের শেষেই বাজারে আসছে টিকা। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এখন সম্ভাব্য যে টিকাগুলোর পরীক্ষা চলছে, তার মধ্যে যেকোনো এক বা একাধিক টিকা দ্রুত অনুমোদন দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন ট্রাম্প। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, ট্রাম্প আগামী ১ নভেম্বরের মধ্যে এই টিকা বাজারে আসার ঘোষণা দেওয়ার পক্ষে। নির্বাচনে নিজের অব্যাহত পতন ঠেকাতে এটিই হবে তাঁর ‘ট্রাম্প কার্ড’।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে অভিজ্ঞ সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ এবং হোয়াইট হাউসের করোনা মহামারি টাস্কফোর্সের অন্যতম সদস্য অ্যান্থনি ফাউসি তাড়াহুড়া করে কোনো টিকা আনার বিরোধিতা করেছেন। তাঁর ধারণা, জরুরি ভিত্তিতেও যদি কোনো টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়, তাও সেটা কোনোভাবেই চলতি বছরের শেষ অথবা আগামী বছরের শুরুর আগে পাওয়া সম্ভব হবে না। ওষুধ প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তাও একই কথা বলেছেন। টিকার অনুমোদনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পিটার মার্কস বলেছেন, পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে যদি কোনো টিকার অনুমোদনের জন্য হোয়াইট হাউস থেকে চাপ দেওয়া হয়, তাহলে তিনি পদত্যাগ করবেন।
টিকায় অনাস্থা
ট্রাম্পের জন্য সমস্যা হলো, করোনাভাইরাসের মহামারি নিয়ে তিনি ইতিমধ্যে জল অনেক ঘোলা করে ফেলেছেন। কাজেই নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তে যদি আসলেই কোনো টিকা বাজারে চলে আসে, তিনি এর সুফল পাবেন না বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ, বেশির ভাগ মার্কিন নাগরিক তাঁকে অন্তত এ বিষয়ে বিশ্বাস করেন না। জনমত জরিপ সংস্থা কেএফএফের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের ৬২ শতাংশ মানুষ মনে করেন, ট্রাম্পের চাপের মুখে ওষুধ প্রশাসন কোনো না কোনো টিকার অনুমোদন দিতে বাধ্য হবে। এই সংস্থার প্রধান ড্রু আল্টম্যান বলেছেন, টিকা নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন যেভাবে রাজনীতি করছে, তাতে এর নিরাপত্তা নিয়ে মার্কিন জনগণের মধ্যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
এই সংশয় বা অনাস্থার বড় কারণ ট্রাম্প নিজেই। বিখ্যাত অনুসন্ধানী সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড তাঁর প্রকাশিতব্য বইয়ে উল্লেখ করেছেন, গত ফেব্রুয়ারির গোড়াতেই ট্রাম্প জানতেন, করোনাভাইরাস সাধারণ ফ্লুর তুলনায় পাঁচ গুণ ভয়াবহ। ট্রাম্পের নিজের কণ্ঠে সে কথা গত কয়েক দিন রেডিও-টিভিতে অনবরত বেজে চলেছে। অথচ জনসমক্ষে তিনি ক্রমাগত বলে গেছেন, জাদুর মতো এই ভাইরাস উধাও হয়ে যাবে। অথচ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ছয় মাস পরও যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন এই মহামারিতে। ট্রাম্প অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন, ‘আমি মিথ্যা বলিনি। শুধু কেউ যাতে ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে পড়েন, তার চেষ্টা করেছি।’ ট্রাম্পের দাবি, এটাই নাকি প্রকৃত নেতার লক্ষণ। তবে তাঁর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার এই চেষ্টায় খুব বেশি মানুষ আশ্বস্ত হয়নি। উল্টো বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ট্রাম্প প্রশাসন যদি সত্যিটা জানার পর তা লুকিয়ে না রেখে দ্রুত যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিত, তাহলে হয়তো ৫০ হাজার বা তার বেশি মানুষের জীবন রক্ষা পেত।
বাইডেনের হাতে নতুন অস্ত্র
ট্রাম্পের এই ব্যর্থতা এবারের নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেনের হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দিয়েছে। করোনা থেকে মার্কিন জীবন রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য কয়েক দিন ধরে তিনি বারবার কঠোর ভাষায় ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন। সম্প্রতি মিশিগানে এক জনসভায় তিনি বলেছেন, ‘তিনি (ট্রাম্প) জানতেন, এই ভাইরাস কতটা মারাত্মক। জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেননি তিনি। এর চেয়ে ঘৃণ্য আর কী হতে পারে!’ পরে সিএনএনকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ট্রাম্পের সত্যি লুকানোর একমাত্র কারণ ছিল পুঁজিবাজারে পতন ঠেকানো। এটি মস্ত এক অপরাধ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছর হেমন্তে করোনার পাশাপাশি ফ্লু-জাতীয় অন্য ভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এমনিতেই প্রতিবছর ফ্লুতে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এবার তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কোভিড-১৯। এ দুটোই শ্বাসতন্ত্রের রোগ। কাজেই কোনটা কোভিড-১৯ আর কোনটা ফ্লু, তার পার্থক্য করা এবার চিকিৎসকদের জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এমনটা হলে চিকিৎসাক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। এই পরিস্থিতি আঁচ করেই পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য পরিচালক মন্তব্য করেছেন, ‘এই হেমন্তে যে কী হাল হবে, তা এক খোদাই জানেন।’
এই জটিল সময়ে একটি নির্ভরযোগ্য, নিরাপদ ও কার্যকর টিকা উদ্ভাবনের খবরই হতে পারে সবার জন্য কাঙ্ক্ষিত ভালো খবর। কিন্তু নির্বাচনী প্রয়োজনে যদি বিজ্ঞানীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে তেমন কিছু বাজারে ছাড়া হয়, তাতে ট্রাম্পের খুব যে উপকার হবে, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। বাইডেনের রানিং মেট ও নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিস বলেছেন, ‘ভরাডুবি ঠেকাতে ট্রাম্প যেনতেন একটা টিকা বাজারে ছাড়তেই পারেন। কিন্তু শুধু তাঁর কথায় সে টিকা আমি কখনোই নেব না।’