করোনা চিকিৎসায় বড়ির যুগ শুরু

মার্কিন প্রতিষ্ঠান মার্কের তৈরি মলনুপিরাভির বড়ি
ছবি: রয়টার্স

খুব সাধারণ খাওয়ার বড়ি যদি কোভিড সারিয়ে তুলতে পারে, তবে কেমন হয়? যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান মার্ক ও ফাইজার এ রোগের চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার বড়ির পরীক্ষায় উৎসাহব্যঞ্জক ফলাফল পেয়েছে। এ ছাড়া বিষণ্নতাপ্রতিরোধী এক ওষুধও কোভিড চিকিৎসায় ভালো ফল দেখিয়েছে।

বার্তা সংস্থা এএফপি এসব তথ্য জানিয়ে বলেছে, মুখে খাওয়ার এ বড়ি মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি নতুন অধ্যায় খুলতে পারে।

এটা কী ধরনের চিকিৎসা?

কোভিড-১৯–এর উপসর্গ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুখে খাওয়ার এই বড়ি গ্রহণ শুরু করতে হয়। এতে গুরুতর অসুস্থতা ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার বিষয়টি এড়ানো সম্ভব। বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি শুরুর পর থেকেই এ ধরনের ওষুধের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছিল। কয়েক মাস ধরে গবেষণার পর মার্ক ও ফাইজার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছে।

গত অক্টোবরের শুরুতে মার্ক কর্তৃপক্ষ বলেছিল, করোনার চিকিৎসায় তারা মলনুপিরাভির নামের বড়ি ব্যবহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রশাসনের কাছে অনুমোদন চেয়েছিল। আর গত শুক্রবার ফাইজার অনুমোদন চাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। এই দুই কোম্পানির ওই বড়ি অ্যান্টি-ভাইরাল বা ভাইরাসপ্রতিরোধী হওয়ায় তা ভাইরাসের অনুরূপ সৃষ্টির বিষয় কমিয়ে দিতে পারে। এতে রোগ ছড়িয়ে পড়ার গতি কমে আসে। দুটি কোম্পানির পক্ষ থেকেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অত্যন্ত ভালো ফল পাওয়ার দাবি করা হয়েছে। এতে রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমতে দেখা গেছে।

পরীক্ষায় দেখা গেছে, মলনুপিরাভিরের কার্যকারিতা যাচাইয়ে ৭৭৫ জন রোগীর ওপরে একটি গবেষণা চালায় মার্ক। সেখানে দেখা যায়, যেসব রোগীর চিকিৎসায় এটি ব্যবহার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে মাত্র ৭ দশমিক ৩ শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে।

আর এটি গ্রহণ করা কোনো রোগী মারা যাননি। এদিকে প্যাক্সলোভিড বড়ি গ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঝুঁকি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে বলে দাবি করেছে ফাইজার। তবে মার্ক ও ফাইজারের বড়ির সরাসরি তুলনা করা ঠিক হবে না। কারণ, দুই কোম্পানির ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নিয়মনীতি ছিল আলাদা।

এদিকে বাজারে থাকা ফ্লুভক্সামিন নামে বিষণ্নতাপ্রতিরোধী ওষুধ ব্যবহারেও কোভিড রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়ার দাবি করেছেন গবেষকেরা। গত অক্টোবর মাসে ব্রাজিলের গবেষকেরা এ–সংক্রান্ত নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন ‘ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ’ নামের সাময়িকীতে।

মুখে খাওয়ার বড়ি কেন গুরুত্বপূর্ণ?

কোভিড ঠেকাতে মুখে খাওয়ার বড়িগুলোর কার্যকারিতা যদি নিশ্চিত করা যায়, তবে তা মহামারি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হয়ে উঠতে পারে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে টিকার পাশাপাশি মুখে খাওয়ার বড়িও গুরুত্বপূর্ণ থেরাপি হিসেবে ব্যবহৃত হবে। বর্তমানে করোনার যে চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে, তার বেশির ভাগই সিনথেটিক অ্যান্টিবডি আকারে। তবে এ ধরনের অ্যান্টিবডি চিকিৎসা কেবল গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। আর মুখে খাওয়ার বড়ি সহজেই বাড়িতে বসে গ্রহণের জন্য পরামর্শ দিতে পারবেন চিকিৎসকেরা।

মার্ক ও ফাইজারের তৈরি করা বড়িতে এখন পর্যন্ত গুরুতর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। পাঁচ দিনে ১০টি বড়ি গ্রহণ করতে হয় রোগীকে।

ব্রিটিশ ভাইরোলজিস্ট স্টিফেন গ্রিফিন বলেন, ‘এই ওষুধের সাফল্য সার্স কোভ-২ সংক্রমণের গুরুতর পরিণতি প্রতিরোধ করতে একটি নতুন যুগের সূচনা করবে।’

সীমাবদ্ধতা কী কী?

মার্ক ও ফাইজার এখন পর্যন্ত কেবল বড়ির কার্যকারিতা নিয়ে বিবৃতি প্রকাশ করেছে। তাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তথ্য এখনো সামনে আনেনি। তাই তাদের বড়ি দিয়ে চিকিৎসার বিষয়টি ঠিক ঠিক মূল্যায়ন করা এখনই কঠিন।

ফ্রান্সের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ কারিন ল্যাকোম্ব গত সেপ্টেম্বরে সতর্ক করে বলেছিলেন, যত দিন পর্যন্ত গবেষণা মূল্যায়ন না করা হয়, তত দিন পর্যন্ত এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ঘোষণা সতর্কতার সঙ্গে নেওয়া উচিত। এ ধরনের চিকিত্সা ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রুপগুলোর জন্য সম্ভাব্য বাজার সৃষ্টি করে থাকে।

অবশ্য মার্ক ও ফাইজারের ক্ষেত্রে কিছু তথ্য শুধু প্রতিশ্রুতি বলে মনে হচ্ছে না। তারা গবেষণার ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম মেনেছে। স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষণ কমিটি তা মূল্যায়ন করেছে। ফ্লুভক্সামিনের ক্ষেত্রে তথ্য সহজলভ্য হলেও তা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে।

কখন বাজারে আসবে?

গত বৃহস্পতিবার করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসায় প্রথমবারের মতো ‘মলনুপিরাভির’ বড়ি ব্যবহার করার বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাজ্যের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। করোনায় আক্রান্ত ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর ক্ষেত্রে মলনুপিরাভির বড়ি দিনে দুবার প্রয়োগ করতে হবে বলে জানা গেছে।

যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ বলেন, যেসব ব্যক্তি দুর্বল ও যাঁদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম, তাঁদের ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশের জন্য আজ এক ঐতিহাসিক দিন। কেননা, বিশ্বে এখন যুক্তরাজ্যই প্রথম দেশ, যেখানে কোভিডের চিকিৎসায় একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হলো।’

যুক্তরাজ্যের ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এমএইচআরএ বলেছে, যাঁদের মৃদু থেকে মধ্যম ধরনের করোনার উপসর্গ রয়েছে ও জটিলতার মুখে পড়ার অন্তত একটি ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান যেমন স্থূলতা, বেশি বয়স, ডায়াবেটিস বা হৃদ্‌যন্ত্রের অসুখ রয়েছে, তাঁদের ওপর এ ওষুধ প্রয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষও জরুরিভাবে ওষুধটি পর্যালোচনা করছে। ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি বৃহস্পতিবার বলেছে, তারা দ্রুত বিষয়টি পর্যালোচনা করবে। তবে তারা নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করেনি।

ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ ‘মলনুপিরাভির’ বড়ির ফরমাশ দিয়েছে। এর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি প্রথম দফায় ১৭ লাখ কোর্সের বড়ির ফরমাশ দিয়েছে। এক একজনের পাঁচ দিনের কোর্সের জন্য বড়ির দাম পড়ছে ৭০০ মার্কিন ডলার।
ফাইজারের প্যাক্সলোভিড বড়ির দাম এখনো জানা যায়নি। তবে তারা সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ভাষান্তর: মিন্টু হোসেন