করোনাভাইরাস মহামারির কারণে উড়োজাহাজের ফ্লাইট বাতিল হলেও অর্থ ফেরত পেতে প্রবাসীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক ট্রাভেল এজেন্সি গ্রাহকদের ফোন ধরছে না। কেউ কেউ অর্থ ফেরত দেওয়ার কোন সময়সীমাও জানাচ্ছে না। আবার অনেকে অর্থ ফেরতের সময় কোন নীতিমালা না মেনে নিজের মতো করে গ্রাহকদের অর্থ কেটে নিচ্ছে। এভাবে কিছু কিছু ট্রাভেল এজেন্সির কাছে অভিবাসী বাংলাদেশিরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন।
অতীতে ‘নাটাব’ নামে উত্তর আমেরিকার ট্রাভেল এজেন্টদের একটি সংগঠন ছিল। অসাধু ট্রাভেল এজেন্টদের হাতে কেউ প্রতারিত হলে অনেক সময় সংগঠনটি এগিয়ে আসত। তৎকালীন নাটাবের সভাপতি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ট্রাভেলসের মালিক নাজমুল হুদা নিজেই গ্রাহকদের লাখ লাখ ডলার হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে গেলে সংগঠনটি কার্যত বিলুপ্ত বয়ে যায়। এখন আর এ সংগঠনের কোন কার্যক্রম চোখে পড়ে না। ফলে ট্রাভেল এজেন্টদের কোন অভিভাবক সংগঠন না থাকায় গ্রাহকেরা কিছু অসাধু ট্রাভেল এজেন্সির হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশি অভিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উত্তর আমেরিকার বেশির ভাগ ট্রাভেল এজেন্সি টিকিট কাটার সময় ১০ বা ১৫ ডলার লাভ করছে বলে জানালেও রিফান্ড দেওয়ার সময় তারা প্রতি টিকিটে ৫০ থেকে ১০০ ডলার, আবার অনেকে তারও বেশি অর্থ অন্যায়ভাবে গ্রাহকদের কাছ থেকে কেটে নিচ্ছে। এ ব্যাপারে তারা কারও প্রতিবাদ বা আপত্তি কানে তুলছে না।
সম্প্রতি বাংলাদেশিদের কাছে জনপ্রিয় এমিরেটস এয়ারলাইনসের চিফ কমার্শিয়াল অফিসার আদনান কাযিম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে, ৩১ মে’র আগে যারা টিকিট কিনেছিলেন এবং ৩১ আগস্টের মধ্যে ট্রাভেল করার কথা ছিল, তারা তিনটি সুযোগ নিতে পারেন—
প্রথমত, তাদের টিকিট স্বয়ংক্রিয়ভাবে ৭৬০ দিন সময় বৃদ্ধি হয়ে যাবে। এ সময়ের মধ্যে তারা যেকোনো সময় এমিরেটস কর্তৃপক্ষ বা ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে টিকিট রি–বুকিং করতে পারবেন। এ জন্য তাদের কোনো ফি দিতে হবে না।
দ্বিতীয়ত, গ্রাহকেরা ট্রাভেল ভাউচারও নিতে পারবেন। টিকিট বুকিংয়ের সময় তারা যে পরিমাণ অর্থ দিয়েছিলেন, ভাউচারেও তার সমপরিমাণ অর্থের কথা উল্লেখ থাকবে। যে তারিখে ট্রাভেল ভাউচার ইস্যু হবে, তার পরবর্তী ১ বছর তা ব্যবহার করে টিকিট ক্রয় করা যাবে। এক বছর এই ভাউচার ব্যবহার না করা হলে পরবর্তী আরও এক বছরের জন্য ভাউচারের মেয়াদ বাড়ানো যাবে। যে নামে টিকিট ইস্যু করা হয়েছে, সেই নামেই ভাউচার ইস্যু হবে এবং সেটি ইমেইলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এই ভাউচার যিনি টিকিট কিনেছিলেন তিনি ছাড়াও ‘ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলি’–এর যে কেউ এই ভাউচার ব্যবহার করতে পারবেন।
তৃতীয়ত, ইচ্ছে করলে গ্রাহকেরা তাদের সমুদয় অর্থ ফেরতও নিতে পারবেন। এ জন্য কোন ফি কাটা হবে না।
কুয়েত এয়ারওয়েজ তাদের ওয়েবসাইটে এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, চলতি বছরের বিগত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যাদের ফ্লাইট করার কথা ছিল, তাদের টিকিট রিফান্ড, রি–ইস্যু অথবা রি-রাউটিংয়ের জন্য কোন পেনাল্টি দিতে হবে না।
অভিযোগ উঠেছে, এসব এয়ারলাইনস কোনো অর্থ না কাটলেও বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি রিফান্ডের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে নিজের মতো করে অর্থ কেটে নিচ্ছে। নিউইয়র্কের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হাবিব রহমানের কাছ থেকে জ্যাকসন হাইটসের ডিজিটাল ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস ছয়টি টিকিটের বিপরীতে ৬৫০ ডলার কেটে রেখেছে। হাবিব রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ১৫ মার্চ সৌদি আরব যাওয়ার জন্য গ্লোবাল ট্যুরস থেকে কুয়েত এয়ারের ছয়টি টিকিট কিনেছিলেন। এ জন্য তিনি ৫ হাজার ৪০০ ডলার দেন। কুয়েত এয়ারওয়েজ ফ্লাইটটি বাতিল করে এবং গ্লোবাল এয়ারের অ্যাকাউন্টে ১১ মার্চ ৫ হাজার ২৮১.২৬ ডলার ট্রান্সফার করে। কিন্তু গ্লোবাল দীর্ঘদিন পর ২৫ মে ৪ হাজার ৭৫০ ডলার ফেরত দেয়। ৬৫০ ডলার সার্ভিস ফি হিসাবে কাটা হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট মো. শামসুদ্দিন উল্লেখ করেন।
ব্রঙ্কসের সাফওয়ান ট্রাভেল থেকে বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য কুয়েত এয়ারওয়েজের চারটি টিকিট কিনেছিলেন বোরহান খান। তাঁর যাত্রার তারিখ ছিল ২ জুলাই। বোরহান খান ইতিমধ্যে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হন। তিনি তার টিকিট বাতিল করলে প্রতি টিকিটে ২৫০ ডলার করে কাটা যাবে বলে জানানো হয়। ঘটনাটি ৫ জুন তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ২৬ জুন প্রতি টিকিটে ৫০ ডলার করে কেটে তাঁকে বাকি অর্থ ফেরত দেওয়া হয়। ফরহাদ খান প্রথম আলোকে বলেন, টিকিট কাটার সময় তাকে জানানো হয়েছিল, প্রতি টিকিটে তাঁরা মাত্র ৪ ডলার করে লাভ করছেন। অথচ অর্থ ফেরত দেওয়ার সময় প্রতি টিকিটে ৫০ ডলার করে কেটে রাখা হয়েছে। প্রথম আলোতে সংবাদ প্রকাশিত না হলে হয়তো প্রতি টিকিটে ২৫০ ডলার করে কেটে রাখা হতো।
জ্যাকসন হাইটসের প্রিমিয়াম রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার আবদুল জে খান স্থানীয় একটি ট্রাভেল এজেন্সি থেকে কুয়েত এয়ারওয়েজের চারটি টিকিট কিনেছিলেন। প্রতি টিকিটে বড়দের জন্য ৭৫ এবং ছোটদের জন্য ৫০ ডলার করে কাটা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন। জ্যাকসন হাইটস ৭৩ স্ট্রিটের ডিউ ট্রাভেলসের প্রেসিডেন্ট এবং সিইও মো. মানির উদ্দীন প্রতি টিকিটে ৫০ ডলার করে কেটে রাখার পক্ষে প্রমাণ হিসাবে এয়ারলাইনসের ভাউচার পাঠাবেন বলে জানালেও পরে বারবার তাগাদা দিলেও তিনি তা পাঠাননি।
তবে ব্যতিক্রমও আছে অনেক ট্রাভেলস। তারা গ্রাহকদের কোনো অর্থ কাটেন না। অর্থ ফেরত দেওয়ার পলিসি সম্পর্কে জানতে চাইলে এস্টোরিয়া ডিজিটাল ট্রাভেলসের মালিক নজরুল ইসলাম বলেন, তিনি রিফান্ডে কোন অর্থ কেটে রাখেন না। বরং কেউ আসতে না পারলে তিনি সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে অর্থ ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ট্রান্সফার করে দেন।
জ্যাকসন হাইটসের মেঘনা ট্রাভেলসের মালিক এম রহমান বলেন, ‘এয়ারলাইনসকে অর্থ পরিশোধের সময় ক্রেডিট কার্ড প্রসেসিং বাবদ সামান্য ফি দিতে হলেও কাস্টমারকে ধরে রাখার স্বার্থে আমরা কোন ফি না কেটে সমুদয় অর্থ ফেরত দিয়ে দিই।’
জ্যাকসন হাইটসের ডিজিটাল ওয়ান ট্রাভেলস থেকে কুয়েত এয়ারওয়েজের পাঁচটি টিকিট কেটেছিলেন ব্রঙ্কসের ইসলা উদ্দীন। তাঁর ভ্রমণ তারিখ ছিল ৪ জুন। ডিজিটাল ওয়ান কর্তৃপক্ষ তার সমুদয় অর্থ ফেরত দিয়েছে বলে তিনি এই প্রতিবেদককে জানান। জ্যাকসন হাইটসের মেঘনা ট্রাভেলস থেকে কুয়েত এয়ারের চারটি টিকিট কেটেছিলেন সাংবাদিক দিদার চৌধুরী। তিনিও তার সমুদয় অর্থ ফেরত পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
অন্যদিকে অভিযোগ উঠেছে, তার্কিশ এয়ারলাইনস বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট চালুর অনুমোদন পাওয়ার আগেই অনেক ট্রাভেল এজেন্সি সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনসের টিকিট বিক্রি করেছে। এই টিকিটের অর্থ রিফান্ড বা রি–রাউটিং, তারিখ পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ব্যাপারে অসাধু ট্রাভেল এজেন্টরা গ্রাহকদের হয়রানি করতে পারেন বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।