একটি সরস আড্ডা

আড্ডায় যোগ দেওয়া নারীদের সঙ্গে লেখক

নিউইয়র্ক থেকে কয়েকজন জানালেন, লেখক-সাংবাদিক আড্ডা হবে। এবারের ট্যুর ভার্জিনিয়ায়। শুক্রবার রাতে তাঁরা আসবেন, ওয়াশিংটন ডিসি ঘুরে দেখবেন। শনিবার বিকেলে আড্ডা হবে, তারপর ডিনার শেষে সে রাতেই ফিরে যাবেন নিউইয়র্ক।

খুব অল্প সময়ে আয়োজন সম্পন্ন হলো। একেকটি কাজে একেকজন স্বেচ্ছাসেবী এগিয়ে এলেন। আমার কিছুই করতে হলো না। শুধু আড্ডার মেজাজ নিয়ে চারটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে গিয়ে পৌঁছালাম। ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এক পক্বকেশ ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নামলেন। তাঁর হাতে ফুল। আমাকে দেখে উদ্যোক্তা ভেবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কি লেখক-সাংবাদিক আড্ডা হচ্ছে? আমি সাংবাদিক-লেখক নই। তবু পেছনে বসে কি আড্ডা শুনতে পারি?’

তাঁকে এগিয়ে নিয়ে লিফটে তুলে দিলাম। তিনি ফেসবুকে এমন একটি আয়োজনের খবর দেখে এসেছেন। আর ইব্রাহীম চৌধুরীকে তিনি বহুদিন থেকেই চেনেন, তাঁর জন্য ফুল এনেছেন।

ছোট্ট একটা ক্যাফেটেরিয়া রুমকে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী পাঁচ মিনিটের মধ্যে আড্ডা রুম বানিয়ে ফেলেছেন। দেয়ালে দুটি ছোট পোস্টারের মতো টাঙানো হলো। সুবীর কাস্মীর পেরেরা মনে করে একটা মাইকও নিয়ে এসেছিলেন। দেখতে দেখতে ঘরে ঠাসাঠাসি অবস্থা।

এই আড্ডাটি অনেক কারণেই অনন্য। তাঁর কয়েকটি বলি—সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঘোষণা এল, একজন বীর প্রতীক সেখানে উপস্থিত আছেন। ক্যাপ্টেন সৈয়দ মঈন উদ্দিন আহমেদ। সবাই দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করলেন।

সঞ্চালনা শুরু করলেন নিউইয়র্ক থেকে আসা ইব্রাহীম চৌধুরী আর ভার্জিনিয়ার লেখক আনোয়ার ইকবাল। তাঁরা নিজেদের একজন আরেকজনের থেকে এক কাঠি বেশি রসিক বলে প্রমাণ করতে লাগলেন। ইব্রাহীম চৌধুরী বললেন, তাঁদের ১৩ জনের মধ্যে একজনও বক্তৃতায় বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারেন না। দম দেওয়া পুতুলের মতো দুই মিনিট হলেই ‘শাট ডাউন’ হয়ে যান। আশ্চর্যের বিষয়, তাঁদের ১৩ জনের একজনও দুই মিনিটের বেশি সময় নেননি। এই দেখে ভার্জিনিয়াবাসীদের বোধোদয় হলো। স্থানীয় সঞ্চালক চ্যালেঞ্জ দিলেন, তাঁরাও ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করতে পারেন, বাধা সময়ে কথা শেষ করতে পারেন। এই চ্যালেঞ্জের কারণেই কিনা, এই দিকের প্রায় ২৫-৩০ জন মানুষের একজনও দুই মিনিটের বেশি সময় নিলেন না।

আশীফ এন্তাজ রবি মাইক ধরে দু-একটা কথা বলতেই পুরো ঘর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। অবশ্য আমার জন্য এটা নতুন কিছু নয়, তাঁর মতো রসিক মানুষ দ্বিতীয়টি আছে কিনা জানি না। পরে বুঝলাম, এবারে তাঁর রসিকতার লক্ষ্য বস্তু আমি নিজেই। ভালো করে ব্যাপারটা শুনিনি বলে রাগ হলো, আমিও বোকার মতো হাসি হাসি মুখ করে থাকলাম।

আড্ডায় ছিল র‌্যাফেল ড্রর আয়োজন। একটি করে টিকি ধরিয়ে দেওয়া হলো। যখন নম্বর ডাকা শুরু হলো, তখন দেখলাম সবাই উদ্বেগের সঙ্গে এ পকেট ও পকেট হাতড়াচ্ছেন। লেখক মাহবুব লীলেন এসেছেন সপরিবারে। তাই তিনি টিকিট পেয়েছেন চারটি। সেখানে উপস্থিত সর্বকনিষ্ঠ তাঁর কন্যা। সবার মুখে হাসি ফুটিয়ে সেই প্রথম পুরস্কার জয়ী হলো।

নাম উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকতে চাইছি। কারণ ৪০-৫০ জন মানুষের মধ্যে ১০ জনের নাম উল্লেখ করলে বাকিরা বলবেন, ‘আমাকে কী আপনার চোখে পড়েনি?’ তারপরও দু-একটা নাম তো আসবেই। সর্বশেষ মাইক গেল ভয়েস অব আমেরিকার আনিস আহমেদের কাছে। তিনি বললেন, তিনি নিজেকে নিয়ে এমন একটি কৌতুক বললেন, নিউইয়র্কবাসীরা হেসে কুটিকুটি।

একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রতিটি মানুষ কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন, প্রত্যেকেই কিছু না কিছু বলছেন, সবার জন্য বরাদ্দ সময় সমান এবং সবাই সংক্ষেপে কথা বলেছেন—দ্বিতীয় এমন কোনো অনুষ্ঠান আমি জীবনেও দেখিনি। এর কাছাকাছিও কিছু দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বিষয়টা নিঃসন্দেহে উপভোগ্য এবং অনেক উৎসাহব্যাঞ্জক।

আড্ডায় নতুন বইয়ের পরিচিতি হলো। আশীফ এন্তাজ রবির নজরুলের জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘আমারে দেব না ভুলিতে’, আনোয়ার ইকবালের যুক্তরাষ্ট্রের জীবনভিত্তিক গ্রন্থ ‘আহমেরিকা’, আনিস আহমেদের ‘দূরের জানালা কাছের মানুষ’, আমার ‘অনুরোধের ঢেঁকি’ ও ‘ইল্যুমিনাতি’। আর যেই বইটির জন্য সবাই অপেক্ষা করেছিলেন, গত বছরের ভয়াবহ অতিমারি নিয়ে ইব্রাহীম চৌধুরীর সেই বইটি—‘মহামারি করোনা: ডেটলাইন নিউইয়র্ক’।

এই অতিমারি, তার কারণে মানুষের অপরিসীম দুর্ভোগ, মানুষের সাহসিকতা, মানবিকতা, পরার্থে জীবন উৎসর্গ করা, যুক্তরাষ্ট্রে অকল্পনীয় লকডাউন, হাসপাতালে ভয়াবহ সংকট, প্রিয়জনদের মৃত্যু, সবকিছু দিন তারিখ দিয়ে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর কাছ থেকে অটোগ্রাফসহ বইটি সংগ্রহ করতে লাইন পড়ে গেল।

হলটি রাত আটটার মধ্যে ছেড়ে দিতে না হলে আড্ডা শেষ হতো না। শেষে গ্রুপ ছবি তোলার হিড়িক পড়ে যায়। একবার সবাই মিলে, একবার শুধু নিউইয়র্ক গ্রুপ, একবার শুধু ভার্জিনিয়ার, একবার এ-ওকে বই দিচ্ছে, এমন সব ছবির সমাহার।

এরপরে অতিথিরা গেলেন একটি দেশি খাবারের রেস্টুরেন্টে। অনেকে সেখানেও যোগ দিলেন। যদিও নিউইয়র্কের মতো সুস্বাদু খাওয়া পৃথিবীর আর কোথাও নেই, কিন্তু আর্লিংটনের কাবাব কিং নামের এই দেশি রেস্টুরেন্টে তাঁদের খাইয়ে, নাজির উল্লাহ ভাই অবাক করে দিলেন।

খাওয়া শেষে আরেক দফা ছবি তোলা হলো। অল্প সময়ে মানুষের সঙ্গে অনেক সৌহার্দ্য হতে পারে, তাঁদের কাজ নিয়ে অনেক কিছু জানা যেতে পারে, আবার বিরক্ত না হয়েও একটা সুন্দর সাহিত্য আড্ডা হয়ে যেতে পারে। ৫ জুনের সেই মনোরম বিকেলে সেটাই উপলব্ধি করলাম।

ওই যে একটা কথা প্রচলিত আছে—‘বাঙালি কথায় বেশি, কাজে কম’, তা কিন্তু মোটেও ঠিক নয়। বাঙালি কথায় খুবই সরেস এবং সংক্ষিপ্ত, কাজে পটু।