উন্নত বিশ্বে পুলিশের হাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় যুক্তরাষ্ট্রে
যুক্তরাষ্ট্রের পথগুলো এখন উত্তাল জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদে। এই বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুধু একজন জর্জ ফ্লয়েডের কারণে হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ হেফাজতে বিশেষত অশ্বেতাঙ্গদের মৃত্যুর হারই এমন বিক্ষোভের কারণ। আর এই বিক্ষোভই এ সম্পর্কিত নানা তথ্যকে সামনে নিয়ে আসছে। এমন নানা তথ্যের মধ্যে যে তথ্যটি সবাইকে নতুন করে ঝাঁকুনি দিচ্ছে, তা হলো, ধনী ও উন্নত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশি লোক পুলিশ হেফাজতে বা পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার তুলনামূলক তথ্য বিশ্লেষণ করে জানায়, ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে এ তিন দেশে পুলিশ হেফাজতে বা পুলিশের গুলিতে মৃত্যু বিবেচনায় সবার ওপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময়ে যুক্তরাজ্যে এমন মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। অস্ট্রেলিয়ায় এ সংখ্যা ২১ জন। আর যুক্তরাষ্ট্র এ সংখ্যা ১৩৪৮। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে প্রতি লাখে মৃত্যুর দিক থেকেও সবার ওপরে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতি লাখে যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রলিয়ায় এমন মৃত্যুর সংখ্যা ২ ও ৫ জন হলেও যুক্তরাষ্ট্রে এ সংখ্যা ১২ জন।'মাসের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মাসে ১৩৫ জন, বা দিনে চারজন পুলিশের হাতে মারা যাচ্ছে। আর মার্কিন ব্যুরো অব জাস্টিস স্ট্যাটিস্টিকসের দেওয়া পরিসংখ্যানেই কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা দৃষ্টিকটুভাবে বেশি।
প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে কত লোক গ্রেপ্তার হচ্ছে, পুলিশের নির্যাতনে বা বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া এক কথায় অসম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও এমনকি এ তথ্য পাওয়া যায় না। বিশেষত পুলিশের হাতে দেশটিতে প্রতি বছর কত লোক মারা পড়ছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই।
এ বিষয়ে ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাউস জুডিশিয়ারি কমিটির সামনে দেওয়া বক্তব্যে এফবিআইয়ের সাবেক পরিচালক জেমস কোমি বলেছিলেন, ‘এ নিয়ে আমাদের পক্ষে আলোচনা করাটা সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের হাতে কোনো তথ্য নেই। গত সপ্তাহান্তে কত লোক সিনেমা দেখতে গেছে, তার পরিসংখ্যানও এমনকি আছে। অথচ গত সপ্তাহে, গত মাসে, গত বছর বা এমন যেকোনো সময়কালে কত লোক পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই।’
এফবিআইয়ের এক তথ্যে দেখা যাচ্ছ, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ ৪০৭ জনের ওপর গুলি চালিয়েছে। এর প্রতিটিই কিন্তু চালানো হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এফবিআইয়ের এই পরিসংখ্যানও পূর্ণাঙ্গ নয়। কারণ, একই বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের গুলিতে আরও বেশি মানুষের নিহতের খবর খোদ মার্কিন সংবাদমাধ্যমের কাছেই আছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে সিএনএনের প্রতিবেদনে।
ওয়াশিংটন পোস্ট জানাচ্ছে, ২০১৯ সাল যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজার চারজন ব্যক্তি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। আর এ বিষয়ে কাজ করা সংগঠন ম্যাপিং পুলিশ ভায়োল্যান্স জানাচ্ছে, এ সংখ্যা ১ হাজার ৯৯। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের দেওয়া তথ্য যে সত্য নয়, তা তো এফবিআইয়ের সাবেক পরিচালকের হাউস কমিটির সামনে দেওয়া বক্তব্যেই পরিষ্কার।
অথচ যুক্তরাজ্য (নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম) ও নিউজিল্যান্ডের মতো দেশে পুলিশ এমনকি সব সময় আগ্নেয়াস্ত্রও বহন করে না। জি–সেভেনভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেকানাডার অভিমুখ বরং অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের মতো। তারপরও সেখানে ২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ৪৬১টি। এ সংখ্যা অবশ্য সরকারি হিসাব মোতাবেক।
গ্রেপ্তারের সংখ্যার দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের ধারেকাছে নেই উন্নত বিশ্বের বাকি দেশগুলো। সিএনএন জানাচ্ছে, ২০১৮ সালে দেশটিতে মোট গ্রেপ্তারে সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৩ লাখ ১০ হাজার ৯৬০টি। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ৩২ মার্কিন নাগরিকের একজন গ্রেপ্তার হয়েছে। আর এই গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে এমন ব্যক্তির মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গরাই এগিয়ে।
আর ২০১৬ সালে আমেরিকান জার্নাল অব হেলথে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধের তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশের তৎপরতার কারণে শ্বেতাঙ্গদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের নিহত হওয়ার ঝুঁকি তিনগুণ বেশি।
লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড প্রিজন ব্রিফের দেওয়া তথ্যমতে, কয়েদি সংখ্যার দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্র সবার ওপরে। দেশটির জেলখানাগুলোয় ২০ লাখের বেশি কয়েদি রয়েছে, যা ওয়াশিংটন ডিসি, মিয়ামি ও বোস্টনের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। এই কয়েদিদের এক–তৃতীয়াংশই কৃষ্ণাঙ্গ। অথচ. দেশটির মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশের কিছু বেশি অংশ কৃষ্ণাঙ্গ। এ নিয়ে কিছুদিন পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহর ও রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ ওঠে, যার অনেকগুলোই প্রকারান্তরে তারা স্বীকার করে নেয় বা নিচ্ছে। গত বছরই যেমন নিউইয়র্ক পুলিশের বিরুদ্ধেও অনুরূপ তদন্ত হয়েছে এবং এর সত্যতাও পাওয়া গেছে। এবার আবার জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিষয়টি সামনে এসেছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র যে আন্দোলন দেখছে, তা শুধু একজন জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর কারণেই নয়।